শনিবার, ১৯ আগস্ট, ২০২৩, ১২:২০:০৮

সবাইকে অবাক করে দিলেন বস্তায় আদা চাষ করে!

সবাইকে অবাক করে দিলেন বস্তায় আদা চাষ করে!

এমটিনিউজ ডেস্ক: একসময় ছিলেন স্থানীয় বাজারের মনোহারি দোকানি। ব্যবসায় ক্রমাগত লোকসান হওয়ায় ছেড়ে দেন ব্যবসা। এরপর ইউটিউব দেখে সিদ্ধান্ত নেন বাড়িতে থাকা ছায়াযুক্ত ১০ শতক জমিতে করবেন আদা চাষ। সবাইকে অবাক করে যেই কথা সেই কাজ।

স্থানীয় উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা এবিএম লুত্ফর রহমানের পরামর্শে ও কৃষি অফিস থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেন বস্তায় আদা চাষ। আর এ কাজে আজ সফল তিনি। এই কৃষি উদ্যোক্তার নাম মো. ফয়জুর রহমান সুমন। তার বাড়ি ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার গাজিরভিটা ইউনিয়নের পূর্ব সোমনিয়াপাড়া।

তার পিতা স্কুলশিক্ষক মো. মফিজুর রহমান এ কাজে তাকে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন।  কৃষি উদ্যোক্তা মো. ফয়জুর রহমান সুমন বলেন, গাজিরভিটা ইউনিয়নের সূর্যপুর বাজারে আমার ছোট্ট একটি মনোহারি দোকান ও বিকাশের দোকান ছিল। কিন্তু ক্রমাগত লোকসানে পড়ে গেল বছর দোকানটি বন্ধ করে দিয়েছি। বাড়িতে বসে ভাবলাম কিছু একটা করা দরকার।

সে মতে ইউটিউবের মধ্যে প্রতিদিন বিভিন্ন উদ্যোক্তার ভিডিও দেখতাম। একদিন ইউটিউবে দেখলাম বাড়ির পাশে ছায়াযুক্ত জমিতে একজন কৃষক বস্তায় আদা চাষ করছেন। যা দেখে আমার খুবই ভালো লাগে। আমার বাড়িতে ছায়াযুক্ত জমির পরিমাণ বেশি। তাই আদা চাষকেই বেছে নিলাম।

আমি যেহেতু ব্যবসায়ী ছিলাম, তাই কৃষির সাথে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। আমাদের এখানে দায়িত্বে থাকা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা এবিএম লুত্ফর রহমানের সাথে আদা চাষের জন্য পরামর্শ চাইলাম। উনি আমাকে কৃষি অফিসে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিলেন। 

আমি প্রশিক্ষণ শেষ করেই চলতি বছরের মার্চে আদা চাষের জন্য আমি বিভিন্ন জায়গা থেকে ৮৫০টি প্লাস্টিকের বস্তা ক্রয় করে সেখানে পরিমাণমতো মাটি ও রাসায়নিক ও জৈব সার দিয়ে দেশি জাতের আদা চাষ শুরু করি। প্রতিটি বস্তায় আমার সর্বমোট আমার ৫০ টাকা খরচ হয়েছে। 

এ কাজে যেহেতু বেশি পরিচর্যার প্রয়োজন নেই, তাই এর পাশাপাশি আমি গরু লালন-পালন করছি। আমি আশা করছি আমার এখানে যে পরিমাণ আদার গাছ রয়েছে আগামী জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসেই প্রতিটি বস্তা থেকে আমি তিন থেকে চার কেজি পরিমাণ আদা উঠাতে পারবো। 

এতে করে একদিকে যেমন আমার বাড়ির পাশে বিভিন্ন গাছ দিয়ে ঘেরা ছায়াযুক্ত জায়গা আবাদের আওতায় নিয়ে এসেছি, পাশাপাশি আমার প্রতিটি বস্তা থেকে ৫০০-৭০০ টাকা লাভ হবে। আমার পরামর্শ থাকবে, যাদের বাড়িতে ছায়াযুক্ত পতিত জায়গা রয়েছে তাদের সবারই এ পদ্ধতিতে আদা চাষ করা উচিত। এ ক্ষেত্রে যদি কৃষি অফিস থেকে উপকরণ পেতাম তাহলে আরো বেশি জায়গা নিয়ে আদা চাষ করতে পারতাম। 

উদ্যোক্তা সুমনের স্কুলশিক্ষক বাবা মো. মফিজুল রহমান বলেন, ছেলের বাজারে মনোহারি দোকান করে দিয়েছিলাম। কিন্তু ব্যবসায় ক্রমাগত লোকসান হওয়াতে আমি তাকে নিয়ে খুবই চিন্তায় ছিলাম। সে একদিন আমাকে বললো বাড়িতে বস্তার মধ্যে আদা চাষ করবে। বিষয়টি আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। বস্তার ভেতর আদা চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে আমি আগে কিছুই জানতাম না। পড়ে সে আমাকে ইউটিউবে এ বিষয়ে একটি ভিডিও দেখায়। আমার ইচ্ছে না থাকলেও তাকে এ কাজের জন্য টাকা দিই। বর্তমানে তার এখানে প্রতিটি গাছেই আদা ধরেছে। আমি স্কুল শেষ করে প্রতিদিন আমার ছেলের এখানে দেখতে আসি। আমার ছেলে যেন ভালো ফসল পায় সে দোয়া থাকবে।

আদার বাগান দেখতে আসা রাজিব হোসেন বলেন, কৃষি অফিসে গিয়ে জানতে পারি এখানে বস্তায় আদা চাষ করেছেন একজন। আমি নতুন উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী। বিভিন্ন বিষয়ে অনেক উদ্যোক্তার সাথে তাদের বিভিন্ন  প্রজেক্ট দেখেছি। কিন্তু এটা ছিল খুবই ব্যতিক্রম। এর প্রধান কারণ হচ্ছে এটি ছায়াযুক্ত জায়গায় হয় এবং বাজারে মসলা জাতীয় ফসল হিসেবে আদার ব্যাপক চাহিদা। আমি আদা চাষের মৌসুমেই আমার বাড়িতে বস্তায় আদা চাষ শুরু করবো।

স্থানীয় কৃষক হাসেম আলী বলেন, আমরা প্রথমে বিষয়টি বুঝতে পারিনি। আসলে বলতে গেলে আমাদের এলাকায় এইভাবে আদা চাষ কেউ করেনি করতেও দেখিনি। এখন আমরা বুঝতে পারছি বস্তায় আদা চাষ কতটা সহজ ও লাভজনক। সুমনের দেখাদেখি আমরাও আমাদের বাড়ির আঙিনায় আদা চাষ করবো।

ওই এলাকার দায়িত্বে থাকা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. লুত্ফর রহমান নয়ন বলেন, গেল বছরের শেষ দিকে সুমন আমার কাছে আদা চাষের বিষয়ে পরামর্শ নিতে আসে। আমি তাকে এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি। আসলে বস্তায় আদা চাষের জন্য আলাদা করে জমির দরকার নেই। 

আমাদের গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি বাড়িতেই এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা সম্ভব। অনেকেই এই পদ্ধতিতে আদা চাষ করার কথা জানেন না। বস্তায় আদা চাষের ব্যাপক সুবিধা রয়েছে। এখানে অতিবৃষ্টি বা বন্যায় ফসল ডুবে নষ্ট হওয়ার ভয় নেই। আবার একটি ফসল তোলার পর সেখানে আলাদা করে কোনো সার ছাড়াই আরেকটি ফসল ফলানো যায়। খরচ নেই বললেই চলে। সিমেন্ট, বিভিন্ন খাদ্যের বা আলুর বস্তায় খুব সহজেই আদা ফলানো যায়। এই পদ্ধতিতে একদিকে যেমন মাটিবাহিত রোগের আক্রমণ অনেক কমে যায়, অন্যদিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলে বস্তাগুলোকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। 

হালুয়াঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমরা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে উদ্যোক্তা মো. ফয়জুর রহমান সুমনকে প্রশিক্ষণ করিয়েছি। আমাদের উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে তাকে সবসময় বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকি। ছায়াযুক্ত জায়গাতে এই পদ্ধতিতে চাষ করা খুবই সহজ। 

সাধারণত বাঁশবাগানের তলায় কোনো ফসল চাষ হয় না। ফলে জায়গাটা পড়েই থাকে। সেই বাঁশবাগানেও বস্তায় আদা চাষ করা যায়। পিথিয়াম এফানিডারমেটাম নামক ছত্রাকের আক্রমণের কারণে রাইজম নামক  রোগ হলে আদা বড় হতে পারে না ও গাছ দ্রুত মরে যায়। এ পদ্ধতিতে এ রোগের সংক্রমণ কম থাকে। ফলে কৃষক লাভবান হয়। আগামীতে উদ্যোক্তা সুমনকে আমরা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে ব্যাগের ব্যবস্থা করে দেবো এবং আশা করবো এ খাতে যেন নতুন নতুন উদ্যোক্তা গড়ে উঠে।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে