এম এ মান্নান: সম্প্রতি ৩৬০ আউলিয়ার দেশ সিলেট সফর করে এলাম। মনে হল সিলেটের প্রায় প্রতিটি জায়গাই যেন একেকটি মনোমুগ্ধকর পার্ক। বন জঙ্গল পাহাড় পর্বত, চা বাগান ও আগর বাগানসহ আল্লাহ পাকের হাজারও নিয়ামত ও রহমতে ঘেরা হযরত শাহ জালাল, শাহ পরান ও অলী আউলিয়ার দেশ সিলেট বৈচিত্র্যময় এক অপরূপ সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি। ২৩ মার্চ বুধবার রাতে ময়মনসিংহের ফুলপুর এক্সিলেন্ট স্কুল এন্ড মাদ্রাসা থেকে তারাকান্দা উপজেলার আল জামিয়া শামছুল উলূম বাহেলা মাদ্রাসায় গিয়ে সফরে শামিল হই। রাত সাড়ে ১১টায় শুরু হয় লন্ডন প্রবাসি বন্ধুবর মাওলানা এনামুল হকের সৌজন্যে এই সফর। ২৪ মার্চ বিশ্বনাথ মিয়ার বাজার জামে মসজিদে ফজর নামাজ আদায়ান্তে গিয়ে উঠি আলহাজ্ব আব্দুল মালেক মিয়ার বাড়িতে। মন জুড়ানো বিশাল বাড়ি। এখানে দুধালো সেমাই, ফলফলাদি বিস্কুট আর চা নাশতা খাই। তারপর আব্দুল মালেক সাহেবের দেয়া একটি জেনারেটর আমাদের নোয়াহ (ঢাকা মেট্রো-চ ৫৩-৩৭০১) গাড়িতে নিয়ে রওনা হই শহর পানে। জিয়ারত করি শাহ জালাল (রহ.), শাহ পরান (রহ.)’র মাজার। এরপর একে একে চাসনির পীর, শায়খ নূর উদ্দিন গহরপুরী (রহ.), বরুনার পীর আল্লামা লুৎফুর রহমান (রহ.), বহরগ্রামের আলীম উদ্দিন ভাইয়ের বাবার কবরসহ বেশ কয়েকটি কবর জিয়ারত করি। পথে দর্শনীয় স্থানগুলো আমরা হাতছাড়া করিনি। জাফলং ও মাধবকুন্ডে যাওয়ার পথে দেখা হয়েছে অনেক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। ঐ জায়গাগুলোতে গিয়ে নানা জাতের পাথর, বাগান, ঝর্ণা ও নদনদীসহ যা দেখেছি সব লেখা সম্ভব নয়। জাফলংয়ে গিয়ে সে যে কী দেখেছি তা বুঝাব কেমন করে! সে এক অন্য রকম অপূর্ব দৃশ্য! এ কোন ঝর্ণা বা পাহাড়ের দৃশ্য নয়। ভারতের মেঘালয়, গোহাটা আর আমাদের বাংলাদেশী মানুষদের মাঝে গভীরতা ও ভালবাসার সে দৃশ্য। যা আগে কখনও দেখা হয়নি। যেন মার পেটের হারানো ভাই ফিরে পাওয়া। জিরো পয়েন্টে অনায়াসে আমরা পরস্পর সীমা ভেদ করে আলাপে মজেছিলাম। আলাপ হয়েছিল গোহাটার অ্যাডভোকেট বদরুজ্জামান, মেঘালয়ের একজন ইমাম ও বিএসএফ বিজিবির সাথে। বিএসএফ আর বিজিবি ছিল অত্যন্ত আন্তরিক। ভারতের মানুষও আমাদের ভাই। মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নাই, হোক না সে পরদেশি। সে দৃশ্যই যেন সেখানে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছিল। মূলত: যত আইন যত বাধা নিষেধ সবই অপরাধী দুষ্কৃতিকারীদের জন্য। আমরা যদি সুন্দর হই আদর্শ হই তবে অদূর ভবিষ্যতে ভিসা ছাড়াই ঘুরে দেখা যাবে পুরা বিশ্ব। গত বছর ইন্টারনেট মেলায় এমনটিই বলেছিলেন ফুলপুরের সাবেক ইউএনও সুব্রত পাল। কাছ থেকে ভারতের পাহাড় পর্বত ঝর্ণা রাস্তা ঘাট গাড়ি ঘোড়া বড় বড় পাহাড় পর্বত দেখা হল। দেখলাম জাফলংয়ের পিয়াইন নদীর তীরে শত শত একর জমি নিয়ে গড়ে ওঠা ছোট বড় নানা জাতের পাথর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সেখান থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাথর সাপ্লাই দেয়া হয়। শুধু কি তাই, জাফলংয়ে ছেলে বুড়ো সকলে মিলে গোসল করা আর পানি ছিটাছিটির যে প্রাণবন্ত জীবন্ত দৃশ্য তা যেন যায় না ভুলা।
মাধবকুন্ডে ঝর্ণা প্রবাহিত হওয়ার মনকাড়া আকর্ষণীয় দৃশ্য আরও ভাল লেগেছিল। সেখানে যাওয়ার সরু পাকা পথটি ছিল অত্যন্ত চমৎকার। এক পাশে ঝর্ণা ধারা বয়ে যাওয়া নদী আর অন্য পাশে বন জঙ্গল ও গাছগাছালিতে ঘেরা পাহাড় পর্বত। উপর দিকে তাকিয়ে দেখতে হয় মহান সৃষ্টিকর্তার দান অবদান অপরূপ সুন্দর পাহাড় আর যত দৃশ্য। নিচে তাকালে দেখা যায় নদীর বুকে বড় বড় পাথরের মধ্যে শিল্পীদের খোদাই করা বাঘ, হরিণ, বক, শালিকসহ নানা প্রজাতির প্রাণীর ছবি শোভা পাচ্ছে। মৌলভী বাজারের বড়লেখা হয়ে মাধবকুন্ডে যাওয়ার পথে আরও দেখলাম বহির্বিশ্বে প্রশংসা কুঁড়ানো সেরা আতর তৈরির সেই আগর বাগান।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও দেখা হয়েছে একেবারে কম নয়। শ্রীমঙ্গলের নামকরা প্রতিষ্ঠান জামিয়া লুৎফিয়া আনওয়ারুল উলূম বরুনা মাদ্রাসা, হযরত শাহ জালাল রহ. দরগাহ মাদ্রাসা, আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর মাদ্রাসা, এফ আর মুহিউস সুন্নাহ একাডেমি, গোলাপগঞ্জ কুশিয়ারা নদীর তীরে অবস্থিত বহরগ্রাম মাদ্রাসা, শিল্পপতি রাগিব আলী প্রতিষ্ঠিত জামেয়া গোয়াবাড়ি পাঠানঠুলা মাদ্রাসা, মরহুম লুৎফর রহমানের লন্ডন প্রবাসি ছেলে হাফেজ সালেহ আহমদের বাড়ির নূরানী ও হাফিজিয়া মাদ্রাসা, উসমানীনগর শিশু নিকেতন, আল্লামা মাহমুদুল হাসান মাদ্রাসা, খালিদ বিন ওয়ালিদ মাদ্রাসা, শাহ জালাল বিশ্ববিদ্যালয়, মাদানিয়া একাডেমী স্কুল এন্ড মাদ্রাসা, এমসি কলেজ, রাগিব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ, শাহ জালাল ক্যাডেট একাডেমি, মদীনাতুল উলূম স্কুল এন্ড মাদ্রাসাসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সময় বরুনার পীর সাহেবের রাজকীয় বাড়ি, হাফেজ শিব্বির সাহেবদের সিলকো টাওয়ার, মুঈন সাহেবদের সিয়েট টায়ার, মাতিউড়া চা বাগান, হাকালুকি হাওড়, মুফজ্জিল আলী প্রাইমারী ফ্রি মেডিকেল সেন্টার, জলঢুপ প্রভৃতিও মোটামুটিভাবে দেখা হয়েছে।
বিয়ানী বাজারের বড় বড় লন্ডনী বাড়ির বর্ণনা হয়ত আর দেয়া যাবে না। সংক্ষেপে শুধু এটুকুই বলতে পারি, পাহাড় পর্বত বা টিলার উপর নির্মিত ঐসব আলীশান বাড়ি যেন একেকটি এক্সিলেন্ট পার্ক। রাস্তার পাশ দিয়ে পুকুর বা বয়ে যাওয়া ছোট ছোট নদীর ওপারে বাড়িগুলোতে ঢোকার দরজায় মনের আল্পনা মিশিয়ে সে কী মনোরম ব্রীজ ও কারুকার্য খচিত সুন্দর সুন্দর গেইট! তা শুনে নয় শুধু দেখেই বুঝা সম্ভব। মন চায় যেন সেখানেই রয়ে যাই। ছেলে মেয়ে আর আমাদের ছোট্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মায়ায় আসতে হল। অবসরে ঘুরে আসতে পারেন অপরূপ সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি সিলেট। মনের খোরাক মিলবে সেখানে। ২৮ মার্চে শেষ হওয়া প্রায় এক সপ্তাহের এ সফরে আমাদেরকে বিভিন্নভাবে আদর আপ্যায়ণসহ সহযোগিতা করেছেন সময় দিয়েছেন এমন ক’জন বন্ধু হলেন, সিলেট মুহাম্মদপুর নিবাসি লন্ডন প্রবাসি হাফেজ মাওলানা শিব্বির আহমদ, বিয়ানী বাজারের মাওলানা হুসাইন আহমদ, গোলাপগঞ্জের আলীম উদ্দিন ভাই, জামেয়া গোয়াবাড়ি পাঠানঠুলা মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা ওয়ালি উল্লাহ, রাগিব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ মসজিদের ইমাম মাওলানা জহুর আলী, বাহেলার আতাউর প্রমুখ। ড্রাইভিং করছিলেন ভুলার মত মানুষ নয় ভোলার মাহবুব ভাই। কিছুক্ষণের সাথী দারুল উলূম লন্ডনের প্রিন্সিপাল গাজীপুর কাপাসিয়া নিবাসী মাওলানা নুরুল আবসার শাকের ভাই ড্রাইভার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলছিলেন মাহবুব লন্ডনের ড্রাইভারদের মতই দারুণ চালায়। পুরা সফরে সার্বিক সহযোগিতায় ও আমাদের মধ্যমনি হিসেবে সব সময় নেতৃত্বে ছিলেন লন্ডন প্রবাসি আল জামিয়া শামছুল উলূম বাহেলা মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী বন্ধুবর আলহাজ্ব মাওলানা এনামুল হক সাহেব দামাত বারাকাতুহুম।
১৫ এপ্রিল ২০১৬/এমটিনিউজ/প্রতিনিধি/এইচএস/কেএস