রবিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:১৪:৩২

মোবাইল চুরির অপবাদে কিশোরীকে পুড়িয়ে হত্যা

মোবাইল চুরির অপবাদে কিশোরীকে পুড়িয়ে হত্যা

নরসিংদী থেকে : আজিজা বেগম, বয়স চৌদ্দ। নরসিংদীর শিবপুর থানার খৈনকুটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। এই কিশোরীর বিরুদ্ধে ১৫ দিন আগে উঠে মোবাইল চুরির অভিযোগ।

চুরির অভিযোগ দূরের কারো কাছ থেকে নয়- আপন চাচী বিউটির কাছ থেকে। এরপর চাচী তাকে হুমকি দেন, পুড়িয়ে মারার। শেষ পর্যন্ত পুড়িয়েই হত্যা করা হলো তাকে । নির্মম এ মৃত্যুতে হতবাক এলাকার মানুষ।

নিহত আজিজার বড় ভাই সুজন ও তার মা রেহেনা খাতুন জানান, মোবাইল চুরির অপবাদ দিয়ে দু’সপ্তাহ আগেই আজিজাকে পুড়িয়ে মারার হুমকি দেয়া হয়েছিল। গত শুক্রবার রাতে আজিজাকে অপহরণের পর তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

স্থানীয়রা জানান, স্থানীয় এক কবিরাজ ‘দুই মেয়ে বিউটির মোবাইল ফোনটি চুরি করেছে’- এমন কথা বলার পর আজিজা ও তার বোন মাফিয়াকে বিউটি সন্দেহ করতে থাকে। এরপর শুক্রবার রাতে খৈনকুটার এক ফলের বাগানে আগুন জ্বলতে দেখে গ্রামবাসী হাত-পা-মুখ বাঁধা জ্বলন্ত আজিজাকে উদ্ধার করে।  

শুক্রবার মধ্যরাতে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করা হয়। তার শরীরের ৯৬ ভাগই আগুনে পুড়ে গেছে বলে জানান চিকিৎসকরা।

তাকে ফেরানোর চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে গতকাল সকাল সাড়ে ৭টায় না ফেরার দেশে চলে গেছে আজিজা। মৃত্যুর আগে স্বজন ও পুলিশকে তার চাচী ও চাচীর এক ভাইসহ আরো তিন অপরিচিত লোক তাকে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে বলে জানিয়ে গেছে আজিজা। এমন তথ্য জানিয়েছেন তার স্বজনরা।

আজিজা খৈনকুটা এলাকার একটি পোল্ট্রি ফার্মের মালিক আব্দুস সাত্তারের মেয়ে। আজিজাসহ তার ৫ মেয়ে ও ২ ছেলে ছিল। তিনি তখন তার পোল্ট্রি ফার্মে ছিলেন। আগুন দেখে তিনিও ছুটে যান। গিয়ে দেখেন তার মেয়ে দগ্ধ হচ্ছে তাতে। হাত-পা বাঁধা থাকায় প্রাণে বাঁচার চেষ্টাও করতে পারছিল না আজিজা। এরপর তাকে উদ্ধার করা হয়।

আদরের মেয়েকে হারিয়ে তিনি বাকরুদ্ধ। বার বার চেতনা হারাচ্ছেন আজিজার মা রেহেনা খাতুন। গতকাল দুপুরে হাসপাতাল থেকে লাশ গ্রহণ করে তার বড় ভাই সুজন গ্রামের উদ্দেশে রওয়ানা দেন। এই ঘটনার পর থেকে খৈনকুটায় এক শোকের আবহ তৈরি হয়েছে। তার বাড়িতে প্রতিবেশীদের ভিড় লেগে আছে।

নিহত আজিজার বড় ভাই সুজন ও তার মা রেহেনা খাতুন মানবজমিনকে বলেন, গত ১২ই অক্টোবর তার চাচী বিউটির একটি স্যামসাং মোবাইল সেট হারিয়ে যায় বা চুরি হয়। এরপর মোবাইলটির সন্ধান পেতে তিনি স্থানীয় কবিরাজের কাছে যান। কবিরাজ নাকি ‘দুই মেয়ে মোবাইলটি চুরি করেছে’ বলে জানায়।

এরপর থেকে বিউটি তার ভাসুরের দু’মেয়ে আজিজা ও মাফিয়াকে সন্দেহ করতে থাকেন। কয়েকদিন আগে মোবাইল না দিলে তাদেরকে পুড়িয়ে মারার হুমকি দেয় বিউটি। তারপর শুক্রবার রাত ৮টার পর অন্য বাড়িতে যাওয়ার পথে আজিজাকে অপহরণ করা হয়। নিয়ে যাওয়া হয় কিছুটা দূরের একটি ফল বাগানে। তারপর তার হাত-পা ও চোখ বাঁধা হয়।

গায়ে ঢেলে দেয়া হয় আগুন। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকলে ছুটে যান স্থানীয়রা। ততক্ষণে পালায় দুর্বৃত্তরা। তাকে পুড়তে দেখে উদ্ধার করে নেয়া হয় নরসিংদী জেলা হাসপাতালে। সেখান থেকে আশংকাজনক অবস্থায় রাতেই ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। গতকাল ভোরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় আজিজা।

আহাজারি করতে করতে মা রেহানা বেগম বলেন, চাচী বিউটির মোবাইল চুরি হয়েছে কিনা তা আমরা জানি না। কিন্তু কবিরাজ নাকি বলেছে, আমার দুই মেয়ে মোবাইল চুরি করেছে।

আর এ কারণেই দেড় সপ্তাহ আগে বিউটির মা সানোয়ারা এসে হুমকি দিয়ে যায়, মোবাইল ফিরিয়ে না দিলে আমার মেয়েদের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেবে। আর আজ তারা সত্যিই আমার মেয়েকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেললো। যারা আমার ফুলের মতো মেয়েকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে- আমি তাদের বিচার চাই।

এই হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত দাবি করে নিহতের ভাই সুজন বলেন, আজিজাকে পুড়িয়ে মারার কয়েকদিন আগে আমার পিতার ফুফু তমুজা খাতুনের (৫৫) বাড়িতে চাচী বিউটি ও আর কয়েকজন আত্মীয় মিটিং করে। তমুজাকে পুলিশ আটকও করেছে। হুমকির পর অবশেষে একটি মোবাইল চুরির সন্দেহে তাকে পুড়িয়ে মারা হলো। আমরা এর বিচার চাই।

আগুনে পোড়ার পর মৃত্যুর আগে আজিজা স্বজন ও পুলিশের কাছে ঘটনা জানিয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমার কাকী বিউটি, তার এক ভাই ও আরো ৩ জন আজিজাকে তুলে নিয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে হাত, পা, মুখ বেঁধে পুড়িয়ে দিয়েছে বলে জানায়।

শুধু পোড়ার আগে নয়, পোড়ার পর মৃত্যুর আগেও বার বার বলে গেছে যে, সে মোবাইল চুরি করেনি। তারপরও মিথ্যা অপবাদে পুড়িয়ে দেয়ার বিচারও সে চেয়ে গেছে। আমরাও এই হত্যার বিচার চাই।

ঢামেক বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন ডা. পার্থ শংকর পাল বলেন, আজিজার শ্বাসনালী, মুখমণ্ডলসহ শরীরের ৯৬ ভাগই আগুনে পুড়ে গেছে। শোচনীয় অবস্থায়ই সে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। ফলে আমাদের প্রাণান্ত চেষ্টা থাকলেও তাকে ফেরানো যায়নি।

শিবপুর মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মজিবুর রহমান বলেন, মেয়েটি যে পুড়ে মারা গেছে- এটা নিশ্চিত। কিন্তু ঠিক কিভাবে তা পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পরিবারের দাবির বিষয়টিও আমরা তদন্ত করছি। এ ব্যাপারে থানায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। -এমজমিন
এমটিনিউজ/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে