জাকারিয়া পলাশ : পরকীয়ায় স্ত্রীকে হারালেন ফাহাদ। হলেন ডাকাতি মামলার আসামি। ক্রসফায়ারের হুমকীও তার মাথায়। সবমিলিয়ে নরসিংদীর ফাহাদের জীবন এখন জেরবার। কী করবেন তিনি? ঘটনার শুরু ২০১৩ সালে। ওই বছর জুন মাসে বিয়ে করেছিলেন সুন্দরী স্বর্ণা আকতারকে। পুরো নাম ফখরুল হাসান ফাহাদ। সুখেই চলছিল তাদের সংসার।
নরসিংদী জেলার মনোহরদি উপজেলার লেবুতলা ইউনিয়নের তাতারদি গ্রামে তাদের বাড়ি। ফাহাদের বাবার মৃত্যু হয়েছে আগেই। চার বোনই বিবাহিত। শুধুমাত্র বৃদ্ধা মা সংসারে। পোল্ট্রি ফার্মের ব্যবসা আছে ফাহাদের। বিয়ের ছয় মাস পর পুলিশের এস আই আবদুল লতিফ মিয়া (বিপি নং: ৭৪৯০৪০৫৮৯) একদিন ওই বাড়িতে যান পানি পানের ছুঁতোয়। পরিচয় হন ফাহাদের স্ত্রীর সঙ্গে। তারপর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ। এভাবে কাটে তিন মাস। একদিন তুমুল ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে যায় গৃহবধু স্বর্ণা। ফাহাদের পরিবার বিষয়টি মিমাংসার জন্য দ্বারস্থ হয় স্থানীয় চেয়ারম্যানের।
অন্যদিকে ফাহাদকে ফাসাতে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে এস আই লতিফ। এরই মধ্যে একদিন ফাহাদের চাচার মৃত্যু হয়। চাচাশ্বশুরের লাশ দেখতে যান গৃহবধু স্বর্ণা। ফাহাদের পরিবারের অভিযোগ, ওই দিন সুযোগ বুঝে আলমারি খুলে গহনা-টাকা পয়সা নিয়ে একটা সিএনজিতে তুলে চম্পট দেয়ার উদ্যোগ নেয় স্বর্ণা। মৃত্যু বাড়িতে এ নিয়ে লেগে যায় হইচই। বাড়িতে সেদিন ছিল ফাহাদের মা, চার বোন ও ভগ্নিপতিরা। সেখানে হাতাহাতি হয়। স্বর্ণা থানায় মামলা করেন নারী নির্যাতনের অভিযোগে। এস আই পেয়ে যান মোক্ষম সুযোগ। মামলার তদন্তের দায়িত্ব নেন তিনি। ফাহাদের পরিবার তখন চেয়ারম্যানের কাছে যায় মিমাংসার জন্য।
স্থানীয় শালিসের মাধ্যমে বিয়ে বিচ্ছেদ করতে চায় তারা। দেন মোহরের আড়াই লাখ টাকা দিয়ে তালাক রেজিস্টারের প্রস্তাব দেন চেয়ারম্যান। কিন্তু, ততক্ষণে এস আই লতিফ স্বর্ণার অভিভাবকের ভূমিকায়। তিনি ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। মিমাংসা না হওয়ায় ফাহাদকে গ্রেপ্তার করে হাজতে নেয়া হয়। ২০১৪ সালে ১৯ দিন হাজত খাটেন ফাহাদ। পরে জামিনে মুক্তি পেয়ে ফাহাদ আবারও এস আই লতিফের কাছে ধর্ণা দেন মিমাংসার জন্য।
এবার পিপি’র উপস্থিতিতে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে মামলার সুরাহা হয় ২০১৫ সালের মে মাসে। বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে ফাহাদ ও স্বর্ণার। ততক্ষণে, এস আই লতিফ ও স্বর্ণা আক্তারের পরকীয়ার খবর এলাকায় সবার জানা। এ খবর জেনে যান এস আই’র প্রথম স্ত্রীও। দুই সন্তানের মা তার পুলিশ-স্বামীর এহেন পরকীয়ার ঘটনায় নালিশ জানান থানার ওসির কাছে। পরকীয়ার খবর স্ত্রী জেনে যাওয়ায় এস আই ক্ষুব্ধ হন ফাহাদের উপর। তাকে হুমকী দেন দেখে নেয়ার।
এদিকে ঝামেলামুক্ত হয়ে ফাহাদ উদ্যোগ নেন নতুন বিয়ের। বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে পুনঃরায় বিয়ে ঠিক হয় তার। সেই গ্রামেই ২০১৫ সালের ২৪শে মে তারিখে ডাকাতির প্রস্তুতির অভিযোগে ছয় যুবক আটক হয়। ডাকাতির প্রস্তুতিকালে আটক হওয়া ওই ছয় যুবকের বিরুদ্ধে থানার আরেক এস আই তানভীর বাদী হয়ে মামলা করেন। ওই মামলার এজহারে এস আই লতিফ কৌশলে ঢুকিয়ে দেন ফাহাদের নাম। ওই মামলায়ও তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পান এস আই লতিফ। আর এই সুযোগে শুরু করেন দ্বিতীয় দফা হয়রানি।
এসআই লতিফ মামলা থেকে ফাহাদের নাম কাটার জন্য তার কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করেন। অন্যথায় তাকে ক্রসফায়ারে দেয়ারও হুমকী দেন বলে অভিযোগ করেন ফাহাদ। এ ঘটনায় ফাহাদের মা সামছুন্নাহার নরসিংদী জেলা পুলিশ সুপারের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ লিখেছেন।
তিনি লিখেন, এস আই লতিফ দেশের সকল জেলায় ফাহাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়ার হুমকী দিয়েছেন। তাকে ক্রসফায়ারে দেয়ার হুমকী দিয়েছেন। ফাহাদ বলেন, হয়রানি থেকে বাঁচতে এসআই লতিফকে লক্ষাধিক টাকা দিয়েছেন। কয়েকদিন পর ওই মামলার আসামীদের তালিকা এনে এসআই লতিফ দেখান যে সেখানে ফাহাদের নাম নেই। সেই সুযোগে আরও ত্রিশ হাজার টাকা নেন তিনি। কিন্তু, পরে চার্জশিটে ঠিকই তার নাম দেয়া হয়। এ অবস্থায় বিনা অপরাধে জেল খাটার ভয়ে এলাকা থেকে পালিয়ে ঢাকায় অবস্থান করছেন ফাহাদ। হয়রানি থেকে মুক্তি পেতে তিনি ধরণা দিয়েছেন বিভিন্ন দপ্তরে।
তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক ও উপ-মহাপরিদর্শক বরাবরও অভিযোগ করেছেন পুলিশের এস আই লতিফের বিরুদ্ধে। ওই ডাকাতি-প্রস্তুতি মামলার বাদি এস আই তানভীরের সঙ্গে একজন মানবাধিকার কর্মীর ফোনালাপের একটি রেকর্ড এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। তাতে এস আই তানভীর বলছেন, ফাহাদ নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও এস আই লতিফ কৌশলে তার নাম এজহারে ঢুকিয়ে দেন। পরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হওয়ায় এসআই লতিফই ওই মামলার চার্জশিটে ফাহাদের নাম দেন। মামলায় আসামী ফাহাদের পক্ষে তিনি স্বাক্ষী দিতেও রাজি আছেন বলে জানান ওই ফোনালাপে।
এ ব্যাপারে এই প্রতিবেদকের কাছে অভিযুক্ত এস আই আবদুল লতিফ মিয়া বলেন, ফাহাদের সঙ্গে আমার কোনও সমস্যা নেই। পুলিশের বিরুদ্ধে কত লোকেরই তো অভিযোগ থাকতে পারে। মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, আপনারা তদন্ত করেন। আমি কিছু জানি না। অন্যান্য বিষয়ে জিজ্ঞেস করতেই বলেন, আমি ব্যস্ত আছি। পরে কথা বলব।
তবে, ফাহাদের ওই অভিযোগের কয়েকদিনের মধ্যেই এস আইকে উপরের নির্দেশে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। মনোহরদী থানার ওসি আলমগীর হোসেন বলেন, এস আই লতিফকে গত দুই দিন আগে থানা থেকে সরিয়ে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত রাখা হয়েছে।
লেবুতলা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম রতন বলেন, আমি বিষয়টি নিয়ে কয়েকবার সালিশ করেছি। কিন্তু, মেয়েটাকে কোনো সুরাহার বিষয়ে রাজি করাতে পারিনি। মেয়েটা অভিযোগ করেছিল থানায়। এসআই লতিফ অভিযোগের তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন। শুনেছি ওই মেয়েটাকে নাকি এসআই সাহেব বিয়ে করেছে। পরে ছেলেটাকে ডাকাতির প্রস্তুতির একটা মামলায় জড়িয়ে দেয় এসআই লতিফ। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। -মানবজমিন
২১ জুলাই ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস