তসলিমা নাসরিন : কাল ঈদ ছিল, রাতে টের পেয়েছি। যখন ফেসবুকে ঢাকার রাস্তায় রক্তের স্রোত দেখলাম, তখন। গত ২২টা বছর এভাবেই পার করেছি। এভাবেই ঈদ কবে না জেনে। আমি ধর্মে বিশ্বাস করি না, ঈদে বিশ্বাস করি না। কবে ঈদ, এ খবর জেনেই বা আমার কী। না, আমার কিছু না।
ঈদের দিনগুলোয় আমাদের অবকাশে মা বাবা ভাই বোন যে যেখানেই থাকি, মিলিত হতাম। ঈদ ছিল আমাদের জন্য একটা গেট টুগেদার উৎসব। মা ছাড়া ধর্মে টর্মে বাড়ির কেউ বিশ্বাস করতো না। ২২ বছর আমি দেশের বাইরে। ঈদের সময়, ওই গেট টুগেদার উৎসবের সময়ও কেউ স্মরণ করে না আমাকে, না পরিবারের কেউ, না আত্মীয় স্বজনের কেউ। এখন তো মা নেই, বাবা নেই, ছোটদাও নেই। বড়দা, যাকে দাদা বলে ডাকি, শুনেছি ইদানীং সে হঠাৎ ধার্মিক হয়ে উঠেছে। ছোটদা’টা আবার পাঁড় নাস্তিক হয়ে উঠেছিল তার অসুখের সময়।
দাদা এদিকে দাড়ি রাখছে, নামাজও নাকি দিনে পাঁচবার পড়ছে। মা যখন দাদাকে নামাজ পড়তে বলতো, দাদা বলতো, ‘আল্লাহ আমাকে দিয়ে নামাজ না পড়ালে আমি কী করে নামাজ পড়বো, আমার কি কোনও শক্তি আছে নামাজ পড়ার?’ দাদাকে এখন বুড়ো বয়সে কেন আল্লাহ নামাজ পড়াচ্ছেন কে জানে! নামাজ রোজায় দাদার গভীর বিশ্বাস জন্মেছে। অসুখ বিসুখ হলে কেউ কেউ ধার্মিক হয়ে ওঠে, কেউ কেউ ধর্ম ত্যাগ করে। আমার দুটো ভাইয়ের মধ্যে এ দুটো ব্যাপারই দেখেছি।
কিন্তু যাই হোক, আমি তো তার বোন! ২২ বছরে আমাদের পুরোনো গেট টুগেদারের দিনে একবার কেন দেশের কারও আমাকে মনে পড়েনি? একবার কেউ কেন যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি! একটিবার খোঁজ নেয়নি? আমার তো কোথাও আর স্বজন নেই, পরিবার নেই। দাদা তার নিজের বউ ছেলেমেয়ে নাতি নাতনি নিয়ে ঈদের উৎসব করে।
সেই অবকাশেই করে, যে অবকাশ ছিল আমাদের মিলিত হওয়ার বাড়ি। আমিই হয়তো একা স্মৃতি কাতর। আমারই হয়তো চোখে এক সমুদ্র জল। আর সবাই হয়তো বিয়োগের ঘরে অনেক আগেই, আমার জানার বোঝারও আগে, আমাকে বসিয়ে রেখেছে। আমি এখন তাদের কোথাও আর নেই। না সম্মুখে, না হৃদয়ে। আমি দূরের এক অতীত। ভুলে যাওয়া একটা নাম শুধু।
-লেখিকার ফেসবুক থেকে
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি