তসলিমা নাসরিন : ২০০৮ সাল। জানুয়ারি।
মন্ত্রীমশাই ভ’বাবু বললেন, ‘আপনার সঙ্গে আমি এই কারণে কথা বলতে এসেছি যে, আপনি তো এ দেশের সম্মানিত অতিথি, আপনি নিশ্চয়ই, যেহেতু আমরা কথা দিয়েছি যে, এ দেশের আতিথ্য আপনি পাবেন, আপনি ভিসা পাবেন, নিশ্চয়ই পাবেন। আপনার ভিসার মেয়াদ আমরা সামনের ফেব্রুয়ারিতে বাড়াবো। নিশ্চয়ই বাড়াবো।
তাই আপনি যদি এ সময় ফ্রান্সে যে পুরস্কারটা আপনি পেয়েছেন, সেটা আনতে যান, খুব ভালো হয়। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে আমি বলেছি, এরকম তো নিয়ম নেই যে ফ্রান্সের পুরস্কার ভারতে দেওয়া যাবে। যে দেশ পুরস্কার দেয়, সেই দেশে অথবা যে দেশের মানুষকে পুরস্কার দেওয়া হয়, সেই দেশে পুরস্কার দিতে হয়’।
আমি বলে উঠি, ‘কিন্তু পুরস্কার তো .....’
ভ’বাবু কঠিন স্বরে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আমার কথা শুনুন’।
আমি চুপ হয়ে যাই। তিনি বলতে থাকেন, ‘আপনি তো ভারতের নাগরিক নন, সে কারণে এ দেশে তো পুরস্কার দেওয়া যাবে না। আপনাকে হয় বাংলাদেশ যেতে হবে, নয়তো ফ্রান্সে যেতে হবে পুরস্কার নিতে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট আপনাকে ফ্রান্সেই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ওখানে আপনার যাওয়ার সব ব্যবস্থাও করে দেওয়া হবে। আমরাই করে দেব। কোনও অসুবিধে নেই। আপনি পুরস্কার নিতে যান।
আমি ক্ষীণ কণ্ঠে বলি, ভ’বাবুর দিকে বড় সরল চোখে তাকিয়ে, ‘যে পুরস্কারটা আমি পেয়েছি সেটার অনুষ্ঠান গত নয়ই জানুয়ারি প্যারিসে হয়ে গেছে। ওখানে আমার প্রকাশক পুরস্কার গ্রহণও করেছেন। সার্টিফিকেটটা তার কাছে আছে, ওটা আমার কলকাতার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে বলেছি’।
‘হুম’। ভ’বাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘আপনি যদি ফ্রান্সে কিছুদিনের জন্য যান, ভালো হয়। আমি মন্ত্রী হিসেবে বলছি, আপনার কোনও অসুবিধে হবে না বিদেশে থাকার। এখান থেকে সব ব্যবস্থা করেই আমরা পাঠাবো। ফ্রান্সে কোথায় থাকবেন তার কথা ভাবতে হবে না আপনার। ফ্রান্স থেকে যদি আপনি অন্য কোনও দেশে বেড়াতে যেতে চান, সেই ব্যবস্থা আমরা করে দেব। টাকা পয়সার ব্যাপারে আপনি কোনও চিন্তা করবেন না। সব ভারত সরকার করবে’।
ভ’বাবুর দিকে তাকালাম। তিনি আমার দিকে নয়, অন্য দিকে তাকিয়ে আমার উদ্দেশে কথা বলে যাচ্ছেন। তার পাশের লোকটি লিখে নিচ্ছেন খাতায় কথাবার্তা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জয়েন্ট সেক্রেটারি প্রভুও খাতা বের করে লিখছেন। আমরা যা কথা বলছি, তা আমাদের দু’দিকে দু’জন বসে লিখে যাচ্ছেন। সেই হাসি মুখের আন্তরিক মানুষটি কোথায়! এই মুখে সেই মুখটি খুঁজি। নেই। তিনি বিরতিহীন বলে যাচ্ছেন— ‘আপনার কলকাতা যাওয়ার ব্যাপারে এ সময় তো নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। ওরা আবার হৈ চৈ শুরু করতে পারে, ভিসা বাড়ানোর আগে আগে। সতেরো তারিখে আপনার ভিসার এক্সটেনশন হবে, ষোলো তারিখেই একটা হৈ চৈ করবে ওরা।
তখন ওদের বলা যাবে যে ‘উনি দেশে নেই। ওনাকে আনার ব্যাপারে পরে বিবেচনা করা হবে’। পরিস্থিতি শান্ত হলে নিশ্চয়ই আপনি ফিরে আসতে পারবেন। আপনার যদি মনে হয় আপনি আর আসতে পারবেন না এ দেশে, তাহলে তো ভুল। নিশ্চয়ই পারবেন। আমি তো তপন রায় চৌধুরীকে বলেই দিয়েছি। উনি তো খুব স্নেহ করেন আপনাকে। আপনার বয়সী ওনার মেয়েও আছে। খুব মেয়ের মতো স্নেহ করেন। তাকে বলেছিলাম আপনাকে বলার জন্য। আপনি ইচ্ছে করলে তার বাড়িতে, অক্সফোর্ডে তার বাড়িতেও থাকতে পারেন। কোনও দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই আপনার। কবে যাবেন, তা যে এক্ষুণি ঠিক করতে হবে আপনার, তা তো নয়। আপনি দু’একদিন সময় নিন। দু’একদিন পর আপনার জানালেও চলবে’।
ভ’বাবু যখন আমাকে দেশ ছাড়ার পরামর্শ দিচ্ছেন, বলছেন কিছু দিনের জন্য যেন যাই, আমি শিরদাঁড়ায় টের পাই, এ যাওয়া কিছু দিনের জন্য নয়। এ যাওয়া জন্মের মতো যাওয়া। সারাজীবনের জন্য যাওয়া। বাংলাদেশেও বলেছিল, কিছু দিনের জন্য যাও, পরিস্থিতি শান্ত হলে ফিরে এসো। পরিস্থিতি শান্ত আজ প্রায় চৌদ্দ বছর হতে চলল, হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ থেকেও আমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার সময় বলেছে, দু’দিনের জন্য যাও, দু’দিন পর ফিরে এসো। তিন মাস হতে চললো, আজও পশ্চিমবঙ্গে আমার ফেরা হয়নি।
‘আপনি থাকুন কিছুদিন বাইরে, আপনি গেলে আমাদের পক্ষে সুবিধে হবে আপনাকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনা। তখন সোজা আপনি ফ্রান্স থেকে বা ইউরোপের যে কোনও দেশ থেকে সোজা কলকাতায় ফিরতে পারবেন। আপনার কোনও দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই। কী করে যাবেন না যাবেন, সব ব্যবস্থা আমরা করে দেব। আপনি এ দেশের সম্মানিত অতিথি। দেখুন, আপনার সঙ্গে কারও দেখা করতে দিচ্ছি না, সে নিরাপত্তার কারণে। পঁচানব্বইটা লোক ভালো, কিন্তু পাঁচটা লোক তো খারাপ হতে পারে। সে কারণেই কোনও রিস্ক আমরা নিচ্ছি না’।
কথা যখন বলছেন উনি, মাঝে মাঝে তাকাই তাঁর মুখের দিকে। কপালের ভাঁজগুলোয় স্পষ্টতই বিরক্তি। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এই মানুষটিই সেই মানুষ, একসময় যার বাড়িতে আমাকে নেমন্তন্ন করতেন। তিনি বসে বসে আমার কবিতা পড়তেন। বলতেন, কবিতা তার খুব ভালো লাগে। ভ’বাবুর কণ্ঠে এতটুকু মমতা নেই, তারপরও আমার বিশ্বাস হয় না তিনি সত্যিই এখন আমার শত্রু। আমার এই এক মুশকিল, কাউকে মন্দ লোক বলে বিশ্বাস হতে চায় না। তিনি বলতে থাকেন, ওই একই কথা, বারবার নানারকম ভাবে নানা দিক থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে থাকেন।
সংক্ষেপ করলে একটি বাক্যই বেরিয়ে আসে, ‘আপনি ভারত ছাড়ুন’। আমার শিরদাঁড়ায় আমি টের পাই, এই যাওয়াই আমার ভারত থেকে শেষ যাওয়া। আমি কি ছাড়বো ভারত? এককালে যাকে আমি সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতাম, যিনি আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, আজ রাজনীতি তাকে তার নীতি বা আদর্শ থেকে দূরে সরিয়েছে, আমার প্রতি মায়া মমতা স্নেহ যা ছিল সব ছুড়ে ফেলে তিনি একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাকে লোভ দেখাচ্ছেন, মুখোশটা পরে আছেন আমার শুভাকাঙ্ক্ষীর।
এখন বলার পালা আমার। খুব শান্ত কণ্ঠ আমার। অসম্ভব শান্ত স্বর। সবে মৃত্যুর মুখ দেখে আসা আমি। এখনও আমার আকাশ পাতাল করা রক্তচাপের কাঁধে বসে দুষ্টু মৃত্যু আমার সঙ্গে নিজে নিজেই লুকোচুরি খেলছে। জাগতিক সবকিছু আমার কাছে নিতান্তই তুচ্ছ। সেখানে রাজনীতির মারপ্যাঁচ, স্বার্থপরতা, নোংরামো আমার কাছ থেকে সহস্র আলোকবর্ষ দূরে। শান্ত কণ্ঠে বলি, ‘বিদেশে আমি দশ বছর ছিলাম। দশ বছরে একটি দিনের জন্য আমি ওই সমাজে, মনে করতে পারিনি যে আমি বিলং করি। আমি যদি কোনও সোসাইটিতে বিলং করি বলে না মনে করতে পারি, তবে সেই সোসাইটিতে জীবন খুব দুঃসহ হয়ে ওঠে।
যদিও আমার অনেক নাম ছিল, অনেক পুরস্কার পেয়েছি বিদেশ থেকে, কিন্তু কোনওদিনই আমি মনে করতে পারিনি বিদেশ আমার দেশ। এই ভারতবর্ষ, এখানে আমি অফিসিয়ালি বিদেশি, ফরেনার। কিন্তু কখনও আমার মনে হয় না আমি এখানে বিদেশি। আমি এ দেশে নিজের ভাষায় কথা বলছি। এখানের কালচার আমার কালচার। আমি জন্ম থেকে বড় হয়েছি এই বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে। তাছাড়া শুধু বাংলা নয়, ভারতের যে অংশে, যে অঞ্চলেই আমি যাই না কেন, মনে হয়, আমি এ দেশের, এ মাটির মানুষ। কখনও মনে হয় না আমি ফরেনার, কখনও মনে হয় না আমি এ দেশে বিলং করি না। একটিবারের জন্যও এই দেশে আমার মনে হয় না আমি বিদেশি। আগে তো টুরিস্ট ভিসা দেওয়া হতো, যখনই ভিসা পেতাম, চলে আসতাম কলকাতায়।
আর যখন থেকে রেসিডেন্স পারমিট দেওয়া হলো, তখন থেকে তো থাকতে শুরু করলাম। আমার যা কিছু ছিল বিদেশে, প্রায় সব নিয়ে এসেছি কলকাতার বাড়িতে। দেশ থেকে আমার দাদাদেরও পাঠিয়ে দিতে বলেছি আমার বইপত্র। আপনিই তো আমার রেসিডেন্স পারমিট এক্সটেনশন করে দিতেন। আপনি তো সবসময় এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করে এসেছেন। আপনি যদি আমার বাড়িতে যান কলকাতায়, দেখবেন, মনে হবে যেন তিরিশ বছরের সংসার, এমন। এই স্বপ্ন, এই সংসার ছেড়ে আমি যাবো কোথায়! আমি বাঙালি, বাংলায় লেখালেখি করি, তাই বাংলায় একটু জায়গা চাই। নিজের মতো করে থাকা, লেখালেখি করা। এর বেশি কিছু তো চাই না। বাংলাদেশে যদি সম্ভব হতো, চলে যেতাম। চেষ্টা যে করিনি, তা নয়।
—‘আপনার ল’ইয়ার তো সারা হোসেন, তাই না?’ ভ’বাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করেন।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘হ্যাঁ। ডক্টর কামাল হোসেনের সঙ্গেও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। উনি একেবারে আমার দেশে ফেরার ব্যাপারে কোনও কথাই বলতে চান না। ওর স্ত্রী হামিদা হোসেনকেও তো চিঠি লিখলাম। মোটেও আগ্রহ দেখালেন না। ফেরা সম্ভব হলে ফিরতাম। এখানে এই দেশে থাকার চেষ্টা করতাম না। কোথাও কোনও জায়গা নেই বলে এই দেশে থাকি। প্রাণের টানে, ভাষার টানে, শেকড়ের টানে থাকি।
এখানে লেখার মধ্যে থাকতে পারি, বাঙালি বন্ধু, বাঙালি পাঠক, এসবের মধ্যে থাকার প্রয়োজন তো খুব একজন বাঙালি লেখকের। দেশ থেকে কিছু আত্মীয় স্বজনও আসতে পারে। আমি তো ইসলাম নিয়ে এখন কিছু লিখিনি। অনেকদিন আগে লেখা বই দ্বিখণ্ডিত। ভারতে থাকা শুরু করার অনেক আগে। দ্বিখণ্ডিত বিদেশে বসে লেখা বই। ভারতে থেকে আমি ইসলাম নিয়ে লিখিনি কিছু। ওটা থেকে তো পার্লামেন্টে প্রণব বাবু বলার পর ডিলিটও করে দিলাম। আপনার সঙ্গে প্রণব বাবুর কথা হয় কী না জানি না। উনি জানেন আমি যে ডিলিট করেছি। ’
ভ’ বাবু মাথা নাড়লেন।
‘এখন যদি আমার রেসিডেন্স পারমিটটা এক্সটেন্ড না করেন, তবে তো আমাকে চলে যেতেই হবে এ দেশ ছেড়ে। বুঝবো আমার জন্য এই উপমহাদেশে কোনও জায়গা নেই’।
এ সময় আমার গলা বুজে আসে কান্নায়। বলতে থাকি আমি। দু’চোখ বেয়ে ঝরতে থাকে জল। বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে আর চোখ বেয়ে জল ঝরছে। ঝরেই যাচ্ছে। ভ’বাবু এত বড় একটি দেশের এত বড় ক্ষমতাবান ব্যক্তি, যে দেশটি অদূর ভবিষ্যতে ‘সুপার পাওয়ার’ হওয়ার মতো যোগ্যতা রাখছে, সেই দেশটি আমার মতো স্বদেশ হারা, স্বজন হারানো একটি অসহায় লেখককে জায়গা দিতে পারছেন না একশ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার দেশে, মাত্র হাতে গোনা কজন মৌলবাদী চাইছে না বলে আমি দেশে থাকি! অবিশ্বাস্য লাগে সবকিছু। মৌলবাদীদের সন্তুষ্টি করা ভোটের জন্য দরকার, ক্ষমতায় থাকার জন্য দরকার। শুনেছি। এত কী দরকার?
বলতে থাকি, চোখের জল মুছে নিয়ে বলতে থাকি, ‘বিদেশে আমি হয়তো প্রাণে বেঁচে থাকতে পারি, কিন্তু সেই বেঁচে থাকা সত্যিকার বেঁচে থাকা নয়। সত্যিকার বেঁচে থাকতে হলে,আমাকে বাংলাদেশে নয়তো ভারতে থাকতে হবে। ওসব দেশে আমি বেঁচে থাকতে পারবো, কিন্তু লেখক হিসেবে বেঁচে থাকতে পারবো না। আমি বিদেশে যেতে চাই না। ওসব দেশে থাকতে আমার ভালো লাগে না। ওসব দেশে আমি এক মুহূর্তের জন্য ভালো থাকি না। আমি কোথাও যাবো না। দিল্লিতেই থাকবো, যেখানে রেখেছেন সেখানেই। যেদিন কলকাতা যেতে দেবেন, সেদিনই যাবো কলকাতায়। তার আগ অবধি এখানেই থাকবো। আমাকে এ দেশের অনেকে তো ভালোওবাসে’।
ভ’বাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ তা নিশ্চয়ই বাসে’।
‘যারা চাইছে না আমি এ দেশে থাকি, ওরা তো অল্প কজন লোক। ওরা চাইছে বলে আমার জীবন নষ্ট হবে কেন! ওদের হুমকি তো আমার জীবনে নতুন কিছু নয়। ওরা এমন হুমকি কোনও একটা উদ্দেশ্যে দেয়, পরে আবার চুপ হয়ে যায়। এখন যদি এখানে, এই সেইফ হাইজে কিছুদিন থাকতে হয়, অপেক্ষা করতে হয়, আমার কোনও আপত্তি নেই। আমি শুধু চাইবো দু’একজন বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে যেন দেখা করতে দেওয়া হয়...’।
ভ’বাবুও তার কথাগুলো পুনরায় বললেন। আমিও অত্যন্ত শান্তকণ্ঠে একই কথা আবার বললাম। ‘কোথাও যাবো না’। এরপর তিনি হঠাৎ ঘড়ি দেখলেন। তার তাড়া আছে। যেতে হবে।
‘আপনাকে তো আমি ফোন করতে চাই। কিন্তু আপনার ব্যস্ততা আছে ভেবে ফোন করতে কুণ্ঠাবোধ করি’।
হেসে বললেন, ‘রাত দশটার পর ফোন করবেন। দেখি আমি পশ্চিমবঙ্গের সরকারের সঙ্গে কথা বলে দেখি..’
এতক্ষণের এই কথোপকথনের পর আমি ভাবলাম ভ’বাবুর মন বোধহয় আমার জন্য একটু নরম হয়েছে। কিন্তু কোথায় নরম! গাড়ি করে আমাকে যখন পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে কারাগারে অথবা তথাকথিত নিরাপদ বাড়িতে, পথে ফোন এল ভ’ বাবুর, প্রভুর কাছে। এক নম্বর, তিনি জেনুইনলি চাইছেন আমাকে হেল্প করতে। সুতরাং এটা যেন আমি বুঝতে চেষ্টা করি। দুই নম্বর, আজকের সাক্ষাতের কথা যেন মিডিয়া না জানে।
পথে প্রভুকে অনেক অনুরোধ করলাম চলুন কোনও ক্যাফেতে, কোথাও না কোথাও, কোনও রেস্তোরাঁয়, চলুন বাইরে কোথাও। আমি আসলে মাঝে মাঝে ভুলে যাই যে আমি বন্দি। তাই অমন আবদার করি। প্রভু আমাকে কোথাও নেন না। কারাগারে ফিরে আসেন। পায়চারি করি খোলা ছাদে। সঙ্গে প্রভু। উনি রহস্যময় মানুষ। বললেন, ‘আপনার প্রেজেন্টেশনটা দারুণ। আমি মুগ্ধ’।
আমি বলি, ‘আমি তো ওখানে অভিনয় করতে যাইনি। আমার মনের কথাগুলোই বলেছি’।
পায়চারি করার সময় মনে থাকে না, ভুলে যাই যে, আমি মাত্র সিসিইউ থেকে উঠে আসা। কোনও বাঁধন না মানা রক্তচাপ থেকে উঠে আসা। রক্তচাপ মেপে দেখলাম, ২২০/১২০।
—চলুন এক্ষুণি যেতে হবে হাসপাতালে। ভর্তি হতে হবে মনে হচ্ছে।
—কিন্তু ভর্তি করবে না। গিয়ে লাভ নেই।
— কেন করবে না। ওরাই তো বলেছিল ব্লাড প্রেসার স্টেবল না হলে হাসপাতাল থেকে ছাড়বে না। এখনও তো স্টেবল হয়নি। এই ব্লাড প্রেশার নিয়ে আমি হাসপাতালের বাইরে থাকবো না। কালই আমার রক্তচাপ দু’শ থেকে পঞ্চাশে নেমেছিল। আমি ভরসা পাচ্ছি না এখানে থাকতে।
প্রভুর যাওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই। কিন্তু আমি যাবোই। ভর্তি হওয়ার জন্য কিছু কাপড় চোপড়ও নিলাম। হাসপাতালে আরও কটা দিন থেকে যাওয়া উচিত, এ কথা ডাক্তাররাও বলেছিলেন। কিন্তু গেলে কী হবে। থাকতে দেওয়া হলো না আমাকে। প্রভু এবং ডাক্তারদের মধ্যে কী কথা হলো। যে ডাক্তাররা বলেছিলেন, থাকা জরুরি, তারাই বলে দিলেন, জরুরি নয়। এই হাসপাতাল সরকারি হাসপাতাল। সরকারি আদেশ মাথা পেতে নেবেনই সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা।
আমি ভাবছিলাম, খুব গভীরভাবে ভাবছিলাম, আমাকে যে ভ’বাবু দেশ ছাড়ার কথা বলেছেন, তা অতটা অমানবিক নয়, যতটা অমানবিক সিসিইউ থেকে রক্তচাপের রোগী উঠিয়ে পনেরো মাইল দূরে নিয়ে গিয়ে সবচেয়ে ভয়ংকর সংবাদটি দেওয়া। এর চেয়ে অমানবিক আর কি হতে পারে! আমার দুর্বল হৃদপিণ্ডটি তো বন্ধ হয়ে যেতে পারতো!
আর কোনও রাখ-ঢাক রইলো না। এ কথা এখন দিনের আলোর মতো, যে করেই হোক তারা চাইছেন চলে যাই। অসুখে বিসুখে মানুষের মন দুর্বল থাকে। দুর্বল সময়টাকেই বেছে নিয়েছেন কঠিন দাওয়াইটি দেওয়ার জন্য। আমি বললাম বটে আমি যাবো না, কিন্তু তিনি কি আর মানবেন! তিনি নিশ্চয়ই আগুন হয়ে আছেন আমার স্পর্ধা দেখে। হাল ছাড়েননি। একা মানুষ। তার আবার শক্তি কতটুকু। কতদিন সে বইতে পারবে একাকীত্ব আর পরাধীনতার যন্ত্রণা!
বাড়িঘর ছেড়ে, প্রিয় বেড়াল ছেড়ে, বইপত্র, বন্ধুদের ছেড়ে, নিজের জীবন ছেড়ে, অনিশ্চয়তার বোঁটকা-গন্ধ-কাঁথায় মুখ-মাথা ঢেকে, দিনের পর দিন পড়ে থাকা কোথায় পড়ে থাকা কতদিন কিছুই না জানা —হৃদপিন্ডকে দাঁতে নখে কামড়েছে ভীষণ।
তারপর তো হৃদয় স্তব্ধ হলে অগত্যা সিসিইউ। যায়-যায় জীবনকে কোনওমতে টেনে আনা হলো, ধুকধুক বুক ফিরে যেতে চায়, রুগ্ন শরীর ফিরে যেতে চায় ঘরে। বেড়ালের কাছে, বন্ধুর কাছে, স্পর্শের কাছে প্রিয়।
কে আর তোয়াক্কা করে হৃদয়ের! সিসিইউ থেকে তুলে নিয়ে তাকে শোনানো হল বড় গম্ভীর, গা কাঁপানো স্বর, অন্য কোনও দেশে চলে যাও, এ-দেশ ছাড়ো। কোথায় যাবো, কোথাও তো যাওয়ার নেই আর, মরলে এ মাটিতেই মাটি দিও।
মাটি খুঁড়ে দেখতে চাও তো দেখে নিও আমার শেকড়। কারই বা কী দায় পড়েছে দেখার, কারই বা দায় পড়েছে চোখের জলে ভেসে যাওয়া মানুষের কাতরানো দেখে কাতর হওয়ার! সিসিইউ থেকে আবার নির্বাসনে, আবার অন্ধকারের গায়ে আবর্জনার মতো ছুঁড়ে হাত ধুয়ে বাড়ি চলে গেলেন ওরা, ওরা খুব বড় বড় লোক, হাতজোড় করে নতমস্তকে নমস্কার করি ওদের। বাংলা ট্রিবিউন
লেখক: কলামিস্ট ও নির্বাসিত লেখিকা
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি