রবিবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৬, ১০:৩৭:২৯

আমি যদি ফিদেল কাস্ত্রো হতাম : তসলিমা নাসরিন

আমি যদি ফিদেল কাস্ত্রো হতাম : তসলিমা নাসরিন

তসলিমা নাসরিন : আমি ভাবছিলাম আমি যদি কাস্ত্রো হতাম। কিউবার সিয়েরা মায়েস্ত্রো পাহাড় থেকে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে স্বৈরাচারি বাতিস্তা সরকারের পতন যদি শেষ অবধি ঘটাতাম, তাহলে কী করতাম? প্রথমেই গণতান্ত্রিক উপায়ে সরকার গঠনের ব্যবস্থা করতাম। রাজনৈতিক দল সরকার চালাতো, আমি কিউবার বিপ্লবের ‘প্রিয় কমান্দান্তে’ হিসেবেই রয়ে যেতাম।

আর যদি আমাকেই হাল ধরতে হতো দেশের, অর্থাৎ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যদি আমিই নির্বাচিত হতাম, তাহলে সমতা আর সমানাধিকারের ভিত্তিতে দেশের সংবিধান আর আইন তৈরি করে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্বচ্ছলতা, স্বাধীনতা ইত্যাদির সুষম বন্টনের ব্যবস্থা করে, আমার টার্ম শেষ হলে বিদায় নিতাম। যেহেতু আমি স্বাধীন করেছি দেশ, সুতরাং যতদিন বেঁচে আছি, দেশটাকে আমার সম্পত্তি বলে মনে করবো, কোনও বিরোধী কণ্ঠস্বরকে মানবো না, না, এমনটি কিছুতেই করতাম না। কিন্তু কাস্ত্রো করেছেন। কাস্ত্রো করেছেন বলে শত ভালো কাজ করার পরও সামান্য কিছু খারাপ কাজ করার কারণে লোকে তাকে ধিক্কার দেয়।

কাস্ত্রো ধনীর ছেলে ছিলেন। আমাদের দেশের রাজনীতিকদের মতো কিউবার ধন সম্পদ তিনি কিছু চুরি করেননি। কিউবাকে আদর্শ একটি দেশ হিসেবে গড়তে চেয়েছিলেন, তার চাওয়ায় কোনও ত্রুটি ছিল না। নব্বইয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে কিউবায় শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক দুরবস্থা, খাদ্যের অভাব। আমেরিকার এম্বারগো এই অভাবের অন্যতম একটি কারণও বটে। এম্বারগোর বিরুদ্ধে কাস্ত্রো লড়েছেন। কিন্তু খাদ্যের স্বল্পতা ঘোচানো সম্ভব হয়নি তার পক্ষে।  

মাঝে মাঝে ভাবি গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা না করার আর বাক স্বাধীনতাকে মূল্য না দেওয়ার শিক্ষা তিনি কোথায় পেয়েছিলেন? সম্ভবত ১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাইয়ে মনকাদা ব্যারাকে হামলা করার পর জেলখানায় বসে কমিউনিস্ট গুরুদের যে সব বই পড়ে তিনি কমিউনিজমে দীক্ষিত হচ্ছিলেন, সে সময়ই শিখেছিলেন গণতন্ত্রের চেয়ে একনায়কতন্ত্র উত্তম, বিভিন্ন মতের চেয়ে এক মত উত্তম। জেলখানায় যাওয়ার আগে তিনি কলম্বিয়ায় আর ডোমিনিকান রিপাবলিকে গিয়ে যে ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, তা ছিল নিতান্তই উপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন, তখনও তিনি ভিন্ন মতে বিশ্বাস হারাননি।  

একটা ছোট্ট দ্বীপ থেকে তিনি যে ভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশকে চ্যালেঞ্জ করে গেছেন তা বিস্ময় জাগায়। কতটুকু আত্মবিশ্বাসী আর অহঙ্কারী আর অকুতোভয় হলে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব, তা অনুমান করতে পারি। কিউবার জনসংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের  জনসংখ্যার শতকরা ৩ ভাগ। কিউবার আয়তন যুক্তরাষ্ট্রের আয়তনের শতকরা ১ ভাগ। এই দ্বীপটিকে দখল করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র হেন কাজ নেই করেনি।

কাস্ত্রোকে হত্যা করার জন্য কী চেষ্টাই না করেছে, এমনকি কাস্ত্রোর সিগারের প্যাকেটে বোমা ভরে দেওয়ার প্ল্যান করেছিল, তবে সিআইএর সব প্ল্যান শেষ অবধি ব্যর্থ হয়েছে। ষাট দশকের গোড়ার দিকে কিউবা যেহেতু নিজের দেশে সোভিয়েত ইউনিয়কে তাদের  মিসাইল রাখার জায়গা দিয়েছিল, সে কারণে কিউবার ওপর রাগ আমেরিকার? নাকি নিজেদের উঠোনে নিজেদের নির্বাচিত স্বৈরাচারি শাসক বসাতে পারছে না বলে রাগ? আমেরিকার দেওয়া অর্থনৈতিক এম্বারগোর কারণে কিউবার মানুষ যে খাদ্যাভাবে ভুগেছে, তার সব দায় একা কাস্ত্রোর, আমেরিকার কিছুই নয়?

গ্যারি কাস্পারভ কিউবাকে জেলখানা বলেছেন। কিন্তু এই জেলখানা অন্য জেলখানার চেয়ে আলাদা। এই জেলখানা থেকে যে কেউ যখন খুশি বেরিয়ে যেতে পারে। প্রচুর কাস্ত্রো-বিরোধী লোক চলে গেছে আমেরিকায়, বাসা বেঁধেছে সমুদ্রের উপকূলে মায়ামিতে। তারা গতকাল উৎসব করেছে কাস্ত্রোর মৃত্যুতে। কারো মৃত্যু হলে যারা আনন্দ উৎসব করে, তাদের আমার খুব নিষ্ঠুর বলে মনে হয়। আমি আমার চরম শত্রুর মৃত্যুতেও আনন্দ করতে পারিনা। সব মৃত্যুই আমার কাছে বেদনাময়।

লাতিন আমেরিকার ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা মোটেও উজ্জ্বল নয়। কমিউনিস্ট নেতাদের, সে নেতারা যতই জনপ্রিয় হন না কেন, ধংস করে দিতে চেষ্টা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এক বারাক ওবামাই সম্ভবত এম্বারগো তুলে নেওয়ার আর  কিউবার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো করার কথা প্রথম বলেছেন। আমেরিকা থেকে সরাসরি কিউবা ভ্রমণ করার ব্যাপারে এতকাল যে নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল, সেটিও তিনি বাতিল করে দিয়েছেন।

নিজে কিউবা গিয়ে রাউল কাস্ত্রোর সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। তিপ্পান্ন জন বন্দি রাজনীতিককে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছেন রাউল। রাউলের বয়স এখন ৮৫। ফিদেলের চেয়ে তার জেদ এবং তেজ কম। তিনি হয়ত আরো কিছু সংস্কার করবেন। শুধু রাউলই কি আপস করেন?  ফিদেলও তো আপস করেছেন? নাস্তিক হয়েও পোপকে সম্বর্ধনা দিয়েছেন কিউবায়। আমি নিতান্তই ভদ্র নম্র লেখক, আমিও তো কোনোদিন এতটা আপস করিনি।

ফিদেল কাস্ত্রোকে আমেরিকা পছন্দ করতো না, কারণ ফিদেল কাস্ত্রো একনায়ক ছিলেন। এ কথা সত্য নয়। আমেরিকা অনেক দেশের এক নায়কককে পছন্দ করে। সৌদি আরব আমেরিকার পরম বন্ধু। শুধু মধ্যপ্রাচ্যেই নয়, লাতিন আমেরিকাতেও নিজেদের নির্বাচিত একনায়কদের বসিয়ে গিয়েছে।

কাস্ত্রোর দম্ভ, আমেরিকার কাছে নতি স্বীকার না করা– এসব ছিল মূল কারণ এম্বারগোর আর হত্যার চেষ্টার। চে গুয়াভারাকে হত্যা করেছে আমেরিকা। আজ যদি চে বেঁচে থাকতেন, তাকেও হয়তো তিরস্কার সহ্য করতে হতো, কাস্ত্রোকে যেমন হয়েছে। দুই স্বপ্নবান বিপ্লবী শুধু নিজেদের ভূখণ্ডকেই স্বাধীন করেননি, সারা পৃথিবীকেই অন্যায় অত্যাচার আর শোষণ থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন। আফ্রিকার এবং লাতিন আমেরিকার অনেক দেশেই কাস্ত্রো তার সৈন্য পাঠিয়েছেন শোষকের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য।

কাস্ত্রোর ভুল ছিল। তার ভুলের কারণে হাজারো মানুষকে দুর্ভোগ দিয়েছেন। হাজারো মানুষকে জেলখানায় ভরেছেন, হাজারো মানুষকে দেশান্তরী করেছেন। কিন্তু সমাজ সংস্কারের যে বিশাল কাজ কাস্ত্রো একা করেছেন, তা শক্তিশালী  আমেরিকার পক্ষে আজো করা সম্ভব হয়নি--- সবার জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা, সবার জন্য অবৈতনিক শিক্ষা, শিক্ষিত'র হার প্রায় শতভাগে নিয়ে যাওয়া। লাতিন আমেরিকার বড় বড় দেশ থেকে উন্নত চিকিৎসা পেতে মানুষ কিউবা নামের ছোট্ট দ্বীপটিতে যায়। ভাবা যায়?

ফিদেল নেই, রাউলও হয়তো বেশিদিন নেই। রাউল চলে গেলে ক্ষমতায় যিনি-ই আসুন, হয়ত আমেরিকার এম্বারগো না থাকলে অর্থনৈতিক উন্নতিও ঘটাতে পারবেন। আমেরিকা থেকে কাস্ত্রোবিরোধী কিউবানরা ফেরত এসে সমাজতন্ত্রকে হঠিয়ে পুঁজিবাদের চাষ শুরু করবেন হয়তো। জানি না বাতিস্তার মতো আবার কোনও অপদার্থকে ক্ষমতায় বসাবে কি না আমেরিকা। যদি বসায়, তবে কিউবা পিছিয়ে যাবে অনেক। ধনী আর দরিদ্রে, নারী আর পুরুষে আগের মতো বিস্তর ফারাক তৈরি হবে।

কমান্দান্তের মৃত্যুতে আশা করছি,  যা তিনি দিতে পারেননি, তা যেন ভবিষ্যতের নেতারা কিউবাকে দেন--- গণতন্ত্র, আর মত প্রকাশের অধিকার। আরো একটি আশা, স্বৈরাচারি ফিদেল কাস্ত্রো কিউবাকে আমেরিকার পর্যটকদের পিকনিক স্পট না বানিয়ে একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বানিয়েছিলেন, সেটি যেন অন্তত টিকে থাকে।  বাংলা ট্রিবিউন
 
লেখক: কলামিস্ট ও নির্বাসিত লেখিকা

২৭ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে