জুলকার নাইন : ভাগ্য পরিবর্তনের প্রত্যাশায় বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশিদের অনেকেই জড়িয়ে পড়ছেন অপরাধে। জড়িয়ে পড়ছেন স্বদেশিদের খুনোখুনি, নিজেদের মধ্যে মারামারি, মাদক ও নারী পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধে।
বিদেশি খুনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন বাংলাদেশিরা। খুনের মামলায় ২২ বাংলাদেশি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে আছেন বিভিন্ন দেশে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়ে আছেন ১২ জন। শুধু খুনোখুনি বা অবৈধ অবস্থান নয়, উন্নত দেশগুলোয় প্রতারণার সঙ্গেও জুড়ে আছে বাংলাদেশিদের নাম। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডায় হামেশাই বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, ইন্স্যুরেন্স জালিয়াতির অভিযোগ উঠছে। অবৈধ অভিবাসনেও আছেন অনেকে।
আবার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় চলছে বাংলাদেশির হাতে বাংলাদেশি অপহরণের ঘটনা। সরকারি হিসাবেই বিশ্বের ৪৯ দেশের কারাগারে নানা অপরাধে জড়িত হয়ে ৯ হাজার ৯৬৭ জন বাংলাদেশি বন্দীর তথ্য রয়েছে। যদিও খোদ সরকারি কর্মকর্তারাই বলছেন, বাস্তবে কারাগারে থাকার সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। কারণ অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়া অনেক বাংলাদেশি এমন কিছু দেশে বন্দী থাকতে পারেন যেখানে কারাগারের প্রচলিত কাঠামোই নেই।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্যানুসারে, বর্তমানে বিশ্বের কমপক্ষে ১১ দেশে খুনের মতো অপরাধে বিচার সম্পন্ন হয়েছে ৩৪ জনের। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন ২২ জন। বাকি ১২ জনের হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের সেসব দেশের আইন অনুসারে শিরশ্ছেদ অথবা গুলি করে হত্যা অথবা ফাঁসি কার্যকর হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার। তবে হত্যা ও নারী সন্মান নষ্টর মতো অপরাধে বিচারের মুখোমুখি আছেন আরও কমপক্ষে ২৬ বাংলাদেশি। তারাও মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। তাদের বেশির ভাগ স্বদেশি বাংলাদেশিদের হত্যা করেছেন।
তবে বিদেশি নাগরিককেও হত্যার সঙ্গে জড়িত প্রবাসে ফাঁসির দণ্ডে আছেন বেশ কয়েকজন। সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরব আমিরাতে ৫ জন, সৌদি আরবের কারাগারে শিরশ্ছেদের অপেক্ষায় ৪ জন। কাতারে তিন, জর্ডানে দুই, কুয়েত, বাহরাইন, ওমান ও মিসরে আছেন একজন করে। মালয়েশিয়ায় আছেন তিনজন ও সিঙ্গাপুরে একজন। এর মধ্যে সৌদি আরব ও কাতারে থাকা ৭ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে শিরশ্ছেদের মাধ্যমে। আমিরাতের ৫ জনকে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হবে। বাকি দেশগুলোতে বাংলাদেশের মতো মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত দড়িতে ঝুলিয়ে ফাঁসি কার্যকর করা হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, নানা অপরাধে জড়িত হয়ে ৯ হাজার ৯৬৭ জন বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারাগারে আটক রয়েছেন। বিশ্বের ৪৯টি দেশের কারাগারে এরা আটক রয়েছে। আটক বাংলাদেশিরা বন্দী আছেন মিয়ানমারে ৫৭ জন, সিঙ্গাপুরে ৮৭, নেপালে ১২, যুক্তরাষ্ট্রে ২৬, ভারতে দুই হাজার ৬৯৭, গ্রিসে ১২৩, জাপানে ৬৫, থাইল্যান্ডে ২৩, পাকিস্তানে ১৯, ফ্রান্সে ৪৬, যুক্তরাজ্যে ২১৮, কাতারে ১১২, সৌদি আররে ৭০৩, জর্ডানে ৪৭, মিসরে ৫, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৬, তুরস্কে ৩৬, জর্জিয়ায় ২৬, কিরগিজস্তানে ১, ওমানে ১ হাজার ৪৮, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৩০, বাহরাইনে ৩৭০, লেবাননে ২, মালয়েশিয়ায় ২ হাজার ৪৬৯, চীনে ৫, হংকংয়ে ২৪, মঙ্গোলিয়ায় ১, সংযুক্ত আরব আমিরাতে এক হাজার ৯৮, ব্রুনাইয়ে ৫, ইতালিতে ৫১, ইরাকে ১২১, মরিশাসে ৭, মেক্সিকোতে ৯৭, আজারবাইজানে ৬, মরক্কোতে ২, দক্ষিণ আফ্রিকায় ১১, ব্রাজিলে ১, অস্ট্রেলিয়ায় ৩৯ ও কুয়েতে ২৬১ জন।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বললেন, মন্ত্রণালয় বা বিএমইটি বা মিশনের লেবার উইংয়ের সঙ্গে সবাই যোগাযোগ করেছেন তা বলা যাবে না। শুধু কারাগারে আটক থাকা ব্যক্তিদের পরিবার বা অন্য কোনো দেশ বা সংস্থা বা কেউ যখন আটককৃতদের বিষয়ে তথ্য দেয় ঠিক তখনই তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া সম্ভব হয়। তারপরও বিচ্ছিন্নভাবে তালিকা সংরক্ষণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়ে থাকে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, ২৩টি দেশে থাকা সাড়ে ৫ হাজার বন্দীকে আইনি সহায়তা দিতে সরকারের বিশেষ কার্যক্রম চলছে। ওই দেশগুলোয় বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে বন্দী বা আটকদের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় এ সংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রথম ধাপে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও মালয়েশিয়ায় বন্দীদের আইনি সহায়তা দেওয়ার নির্দেশনা ছিল। সে হিসেবে খণ্ডকালীন আইনজীবীও নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল সে দেশগুলোয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনস্যুলার অনুবিভাগের কর্মকর্তারা জানান, আটক বা বন্দী বাংলাদেশির তথ্য জানার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দূতাবাসের কনস্যুলার শাখার কোনো এক কর্মকর্তা ওই বাংলাদেশির সঙ্গে কারাগারে সাক্ষাতের অনুমোদন চান। পরে কনস্যুলার অ্যাক্সেসে সাক্ষাতের পাসপোর্ট বা অন্যান্য কাগজপত্র থাকলে পরীক্ষা করা হয়। না থাকলে আটক ব্যক্তির দাবিকৃত তথ্যগুলো সংগ্রহ করে দেশে সে দাবির সত্যতা নিশ্চিত করা হয়। নাগরিকত্বের প্রমাণ হাতে আসার পর দ্রুততম সময়ে তাদের মুক্তি বা সহায়তা দিয়ে থাকে দূতাবাস। দূতাবাস মুক্তিপ্রাপ্ত অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি নাগরিকদের দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য ট্রাভেল পারমিট প্রদান করে থাকে।
এ ছাড়া যেসব দেশে রক্তমূল্যের বিনিময়ে ফাঁসির আসামির মুক্তি বা মামলা প্রত্যাহারের সুযোগ থাকে সেসব দেশে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ ও অন্যান্য সহযোগিতাও করে থাকেন দূতাবাস কর্মকর্তারা। মধ্যপ্রাচ্যের প্রচলিত প্রথা অনুসারে, শাস্তি যাই হোক নিহতের পরিবার যদি আসামিকে ক্ষমা করে দেয় তাহলে আসামি মুক্তি পেতে পারেন। এ ক্ষেত্রে নিহতের পরিবার ক্ষতিপূরণ হিসেবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ রক্তমূল্য হিসেবে দাবি করে থাকে।
যেমন কুয়েতের একটি শহরে ২০০৭ সালের জুলাই মাসে দোহারের ফজলকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন জামালপুরের আবদুল আলিম (দেওয়ানগঞ্জ), মাগুরার তবিবুর বিশ্বাস (সদর) ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মকবুল (নবীনগর)। পরে তারা নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সব কাগজপত্র আদালতে উপস্থাপন করে মুক্তি পেয়ে দেশে আসেন।
২০০৬ সালে খুন হওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের আক্তার হোসেনকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হবিগঞ্জের তোজাম্মেল হোসেন (বানিয়াচং) এবং মাশুক মিয়া (চুনারুঘাট) নিহতের পরিবারকে রক্তমূল্য বা ক্ষতিপূরণ দিয়ে মুক্তি পান। একই প্রক্রিয়ায় আরব আমিরাত থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরেছেন মৌলভীবাজারের সাদেকুর রহমান (সদর), চট্টগ্রামের কফিল উদ্দিন (বহদ্দারহাট) ও কুমিল্লার মনোয়ারা বেগম (কোতোয়ালি)। তবে সব ক্ষেত্রেই নিহতের পরিবার এ ধরনের সমঝোতায় আসবে তা আশা করা যায় না। বিডি প্রতিদিন
১২ ডিসেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস