বৃহস্পতিবার, ০৯ মার্চ, ২০১৭, ১০:৩০:৪২

কয়েক শ’ বাংলাদেশি লিবিয়ার কারাগারে, জেনে নিন তারা কারা?

কয়েক শ’ বাংলাদেশি লিবিয়ার কারাগারে, জেনে নিন তারা কারা?

ফজলুর রহমান: সপ্তম শ্রেণির ছাত্র আহমদ আলী। পড়ত গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর জেলার রাজর থানার আড়াইপাড়া গ্রামের একটি স্কুলে। একদিন গ্রামের এক আদম বেপারি তার চাচাকে ধরে, ওই দালালের মাধ্যমে তাকে বিদেশে পাঠানোর জন্য। এরপর আহমদের বাবাকে বুঝিয়ে বলেন তার চাচা। পরে ৬ লাখ টাকা রফাদফা করে ওই আদম বেপারির হাতে টাকা তুলে দেয় তার পরিবার। সেই বেপারি তাকে ঢাকার আরেক বেপারি মাহবুবের কাছে পাঠায়।  মাহবুব আহমদসহ ১০ জনকে গত ঈদের দুই দিন পর ভিসা ও ফ্লাইট ঠিক করে পাঠিয়ে দেয় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ লিবিয়ায়। সেখানে যাওয়ার পর লিবিয়ান কয়েকজন নাগরিক তাদের বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করে একটি কক্ষে নিয়ে যায়। এরপর মাহবুবের পাঠানো লোকদের চিহ্নিত করে আলাদা একটি রুমে নিয়ে যায় মাহবুবের বিদেশি চক্র।
 
তারা আহমেদকে তার বাবা-মার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেয়। এরপর অমানুষিক নির্যাতন করে তার পরিবারের কাছ থেকে আরো টাকা হাতিয়ে নেয় তারা। এখানে পরিবার ছুটে যান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। ১০ দিন এভাবে নির্যাতন করে টাকা আদায়ের পর তাকেসহ অন্যদের নিয়ে হাওয়ায় চালিত একটি ট্রলার ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। কিন্তু সাগরে টহলে থাকা লিবিয়া পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে এবং তাদের আটক করে জেলে দেয়া হয়। দীর্ঘ ৬ মাস ৬ দিন জেল খাটার পর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা তাকে দেশে ফিরিয়ে আনে।

গতকাল বুধবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এরূপ নির্মম ও ভয়াবহ কষ্টের কথা বর্ণনা করেন আহমেদ। শুধু আহমেদই নয়; প্রিয়জনদের মুখে দুই মুঠো ভাত তুলে দিতে ভিটেমাটি বিক্রি করে পাচারকারীর মাধ্যমে বিদেশে গিয়ে শ শ যুবক বন্দিজীবন কাটাচ্ছে। দেশে থাকা শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে বিদেশে গিয়ে জীবন নিয়ে শঙ্কিত তারা। দালালদের খপ্পরে পড়ে লিবিয়ায় পাচার হওয়া এরূপ ২৭ ভুক্তভোগীকে দেশি ফিরিয়ে আনা হয়। গতকাল দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র‌্যাব-৩ অধিনায়ক সারোয়ার-বিন-কাশেস।
২৭ ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, লিবিয়ার কারাগারে কয়েক শ’ বাংলাদেশি নাগরিক মানবেতর জীবনযাপন করছে। চাহিদামতো মুক্তিপণ দিতে না পারায় সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করা বাঙালিদের কন্ডেম সেল কিংবা ম্যাসেজ কক্ষে দিন-রাত তাদের নির্যাতন করা হচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, চাকরি দেয়ার নামে দেশি-বিদেশি অর্ধশতাধিক চক্র প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বল্প আয়ের মানুষদের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে পাচার করছে। এসব চক্রের হাতে জিম্মি শ শ মানুষ বিভিন্ন দেশের বনে-জঙ্গলে কিংবা বদ্ধ ঘরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। নির্যাতনের কারণে অনেকের মৃত্যুও হচ্ছে। তবে এদের পাচারের সঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বিমানবন্দরের কর্মচারীরা জড়িত বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

ভুক্তভোগী আহমদ আলী জানায়, তাদের একটি অন্ধকার রুমে রাখা হতো। সকালে ছোট একটি রুটি আর রাতে নুডুলস খেতে দিতো। দুপুরে কোনো খাবার দেয়া হতো না।     লাইনের নুনতা পানি খেতে দিতো। এতে অনেকের ডায়রিয়াও হয়েছে। আরেক ভুক্তভোগী শেখ রনি জানান, তাদের যে রুমে রাখা হয়েছে সেই রুমকে ‘ম্যাসেজ রুম’ বলা হতো। কেননা বাংলাদেশি দালালদের আমাদের মতো ভুক্তভোগীর পরিবার টাকা দিলে তারা ওই রুমে থাকা দালালদের জানিয়ে দিতো। তারা আবার আমাদের বলতো, তোর পরিবার টাকা দিয়েছে, তোকে আর মারধর করা হবে না। তিনি জানান, তাদের মূলত ¯িপ্রড বোর্ডে ইতালি নেয়ার কথা। কিন্তু ওই রুমে ১০ দিন রাখার পর তাদের সাগরের তীরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের হাওয়ায় চালিত ট্রলারে উঠতে বলা হয়। ওই ট্রলারের হাওয়া শেষ হয়ে গেলে সবাই ডুবে মারা যাবে। তাই অনেকে উঠতে চায়নি। এ সময় দালালরা তাদের গুলি করার ভয় দেখিয়ে ট্রলারে উঠায়। ওই ট্রলারে ৪০ জন বাংলাদেশিসহ মোট ১১৭ জন ছিল বলে জানান তিনি। পরে তাদের জেলে নেয়া হলে বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে লোক গিয়ে তাদের ছবি ও নাম পরিচয় নিয়ে আসে এবং ১৫ দিনের মধ্যে তাদের দেশে পাঠানোর আশ্বাস দেয়। কিন্তু দূতাবাসের লোকজন আর যায়নি।  ছয় মাস জেল খাটার পর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা তাদের দেশে ফিরিয়ে আনে। তিনি জানান, বাংলাদেশি অনেক নাগরিক দীর্ঘ দিন ধরে লিবিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। তারা শত শত বাংলাদেশি নাগরিক আটকে রেখে নির্যাতন করছে। এমন অনেক লোক রয়েছে, যারা ৭-৮ মাস ধরে তাদের নির্যাতন সহ্য করে যাচ্ছে। পরিবার টাকা দিতে না পারায় তাদের ছাড়ছে না, এমনকি বৈধ কাগজপত্র না থাকায় কাজেও দিচ্ছে না।

র‌্যাব জানায়, মানব পাচারকারী চক্রের ২৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলো- শফিকুল ইসলাম ওরফে গুরু, আবুল বাসার, ফরহাদ হোসেন, সোহাগ হোসেন, তানজিল আহম্মেদ শোভন, ইসমাইল হোসেন, জাবেদ আলী, আল তামজিদ, হেলাল উদ্দিন শেখ, আছির উদ্দীন, সমেশ শেখ, মবিন মিয়া, নিজামুল ইসলাম পালাশ, ইমরান, কপিল উদ্দিন, দেলোয়ার হোসেন, রাজীব, আব্দুর রশীদ, শওকত আলী, শাহাদৎ হোসেন,  রবিউল আলম, শফিউল্লা ও রফিকুল ইসলাম। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৫১৩টি পাসপোর্ট, ৫০টি কভার, ছয় লাখ ৩২ হাজার ৮৮৪ টাকা, মালয়েশিয়ান ভিসা ২৩টি, সীলমোহর ১২০টি, মনিটর ১০টি, সিপিইউ ১০টি, স্কানার মেশিন তিনটি, কি-বোর্ড ৮টি, প্রিন্টার মেশিন ১০টি, বিদেশি সীমকার্ড ৩০টি, কার্ড কাটার মেশিন একটি, আইপিএস একটি, রিবনের তৈরি পরিচয়পত্র ৩১টি, বিমান টিকেট আটটি, জালভিসার প্রিন্ট কাগজ ও বিভিন্ন প্রকার প্রিন্ট কাগজসহ ৩১টি, পেনডাইভ একটি, রিবন ও স্টিকার পেপার ৬৬৫টি, সরকারের বর্হিঃ গমন কার্ড ৬৫টি, মানিব্যাগ ৪টি, বিদেশি সীমের রিচার্জেবল কার্ড ১৯টি, স্পেশাল ব্রাঞ্চ ঢাকার ইমিগ্রেশন সংক্রান্ত নোটিশ ১১ কপি, বিএমইটি কার্ড আটটি, মোবাইল ফোন ৩৭টি, মালয়েশিয়া স্টুডেন্ট প্রেরণ সংক্রান্তে জাল মেডিকেল রিপোর্ট ১০ সেট, জব সিকারস রেজিস্ট্রি ফরম দুই কপি, মালয়েশিয়ান মুদ্রা ৪১ রিঙ্গিত, সিঙ্গাপুরী মুদ্রা এক ডলার ৯০ সেন্ট, ইন্দোনেশিয়ান মুদ্রা ৫০০ রুপি, ১১৫ ইউরো সেন্ট, তিনটি কপি ব্যাংক ষ্টেটমেন্ট, একটি ল্যাপটপ, বিভিন্ন ব্যাংকের ছয়টি চেক বই ও তিনটি এটিএম কার্ড। আর লিবিয়া থেকে ২৭ জন ভিকটিম উদ্ধার করে দেশে আনা হয়। এ ছাড়া অবৈধ পথে মালয়েশিয়া পাচারকালে বিমানবন্দর এলাকা থেকে ১০ জনকে উদ্ধার করা হয়। তারা হলো- আমিনুর ইসলাম, রনি মিয়া, বাবু, আনোয়ার হোসেন, ফালান মিয়া, মাইদুল ইসলাম, আব্দুল মতিন, মোহন আলী, আবুল হোসেন, মনির, রেজাউল করিম, শেখ রনি, ইসরাফিল সিকদার, রুবেল মুন্সি, সুরুজ, রাজিব মাতুব্বর, আলমগীর শেখ, রবিউল ইসলাম, মাহাবুবুল শেখ, জামির আলী, ইলিয়াস মাতুব্বর, বাচ্চু মিয়া, বাবু খলিফা, আসাদুল ইসলাম, রুহুল আমিন খাঁন, মতিউর রহমান, মোহাম্মদ আলী, মোহাম্মদ আলম, কামরুজ্জামান, করিম মন্ডল, সোহান খাঁন, জাহিদুল ফকির, আহামেদ আলী, রাসেল মাতুব্বর, রনি মুন্সি, মাহাবুব খালাসি ও রবিউল ব্যাপারী। র‌্যাব প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে মানবপাচার রোধকল্পে ১৫৫ টি অভিযান পরিচালনা করে চক্রের ৪৭২ জন সদস্যকে গ্রেফতারসহ ৭২৯ জন ভিকটিমকে উদ্ধার করেছে বলে র‌্যাব সূত্র জানিয়েছে।

র‌্যাব-৩ অধিনায়ক সারোয়ার-বিন-কাশেম জানান, গতকাল ভোর রাতে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা ও লিবিয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় এদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। মানবপাচারকারী চক্র এদেরকে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলীতে জিম্মি করে অত্যাচারের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে মুক্তিপণ আদায় করে। ভিকটিমদেরকে কয়েক ধাপে বিভিন্ন চক্রের কাছে বিক্রি করে। অবৈধভাবে লিবিয়া থেকে সমুদ্র পথে ইতালিতে যাওয়ার সময় লিবিয়ান পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করে জেলে প্রেরণ করে। সাজা শেষে তাদের ফিরিয়ে আনা হয়। তিনি জানান, ট্যুরিস্ট ভিসার মাধ্যমে প্রথমে ইন্দোনেশিয়া ও পরে ট্রলারের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় কর্মী হিসাবে পাচার করতে বিমানবন্দরে জড়ো করা হলে গত ১ তারিখে ১০ জনকে উদ্ধার করা হয়। মালয়োশিয়া ফেরত শফিকুল ইসলাম ওরফে গুরু এবং প্রবাসী আবুল বাসার আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের মূল হোতা। এরা লোক দিয়ে টাঙ্গাইল,পাবনা, মাগুরা, নওগা, যশোর এবং ঢাকার আশেপাশে থেকে বিদেশে গমন ইচ্ছুক লোকদের খুঁজে বের করে। পরে মোটা অংকের টাকা নিয়ে লিবিয়া, মালয়েশিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্য, ইতালি, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে পাঠায়।  

র‌্যাবের একটি সূত্র জানায়, মানব পাচারে জড়িত দালাল চক্রের একাধিক ধাপ রয়েছে। গ্রাম পর্যায়ের একজন দালাল সর্বোচ্চ ঢাকায় থাকা কয়েক জনকে চিনে। যাদের পাচার করা হয় তাদের ভিসা করাতে আরেকটি চক্র কাজ করে। কাগজপত্র ঠিক না থাকা সত্ত্বেও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মচারী টাকার বিনিময়ে সব কিছু ওকে করে দেয়। বিমানবন্দরের কিছু কর্মচারীও চক্রের সঙ্গে জড়িত। তারা ভিকটিমদের ইমিগ্রেশন পাড় করিয়ে দেয়। এরপর পাচারকারী চক্রের সঙ্গে বিমান এয়ারলাইন্সের লোকদের হাত রয়েছে। দালালরা কতো সংখ্যক লোক পাঠাবে তা আগে বিমান এয়ারলাইন্সের লোকদের বলা হলে তারা সেই অনুযায়ী টিকিট রেখে দেয়। নির্দিষ্ট দেশে পৌঁছার পর সেখানকার বিমানবন্দরের কর্মচারীরাও পাচারকারীদের কাগজপত্র যাচাই করছে না।

তবে পাচারকারী চক্রটি যাদের কাছ থেকে ভুয়া ভিসা সংগ্রহ করে এমন অনেককে এর আগে আটক করেছে র‌্যাব। গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর র‌্যাব নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ, বাসাবো, উত্তরা থেকে ১৭ জনকে আটক করে। এরা গ্রাফিক্স ডিজাইনের মাধ্যমে নকল ভিসা তৈরি করে। পরে দালাল চক্র তা পাচারের কাজে কিনে নেয়। র‌্যাব জানায়, আটক ১৭ জনের মধ্যে একজনের নাম হাসান। সে এসএসসি পাশ। জিজ্ঞাসাবাদে সে জানিয়েছে, ডেফোডিল ইউনিভার্সিটির এক ছাত্রের কাছ থেকে সে গ্রাফিক্স ডিজাইনের কাজ শিখে। পরে ১১ বছর ধরে ভুয়া ভিসা তৈরির কাজ করে। সে মূলত একটি আসল ভিসার নাম, ঠিকানা ও ছবি এডিট করে ভুয়া ভিসা তৈরি করতো। র‌্যাব জানায়, এর আগে পাচারে জড়িত বিমানবন্দরের এক ক্লিনারকে আটক করা হয়। সেও জানিয়েছে, দালালরা তার সাথে যোগাযোগ করলে সে তার পরিচিত এক লোককে বলতেন।-ভোরের ডাক
০৯ মার্চ ২০১৭/এমটি নিউজ২৪ডটকম/এএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে