প্রবাস ডেস্ক : বিস্ময়কর এক অর্জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তাফসিয়া শিকদারের। লন্ডনের দরিদ্র এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম পূর্ব লন্ডনের নিউহ্যামে তার বাস। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বসেরা দ্য ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) পড়ার জন্য বিরল সুযোগ পেয়েছেন তিনি, সঙ্গে দুই লাখ পাউন্ডের বৃত্তিও।
এটা সেই প্রতিষ্ঠান, যেখানে চন্দ্র অভিযানের কিংবদন্তি বুজ অলড্রিন পড়াশোনা করেছিলেন। তাফসিয়া এমন সুযোগ পাওয়ায় তিনি ও তার পরিবার যেন খুশিতে ‘চাঁদের দেশে’ পৌঁছে গেছেন। চারদিকে মেয়ের প্রশংসা শুনে পিতা মাহমুদ শিকদার (৪৬) ও মা লাইলা সুলতানার (৪৩) বুক গর্বে ভরে উঠছে। এ খবর দিয়েছে লন্ডনের অনলাইন দ্য ডেইলি মেইল।
এতে বলা হয়, বিশ্ববিখ্যাত ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউটে তাফসিয়া শিকদার পেয়েছেন দুই লাখ পাউন্ডের বৃত্তি। এ অর্থ তাকে দেয়া হচ্ছে টিউশন ফি, থাকা-খাওয়া ও বইপত্র কেনাবাবদ। লন্ডনের নিউহ্যামের ওয়েস্টহ্যামে তার বাসভবন ছেড়ে তাই তাকে এখন ছুটে যেতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের বস্টনে। সেখানে তিনি পড়াশোনা করবেন বিশ্বের সবচেয়ে স্মার্ট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে, যারা পড়াশোনা করবেন ইঞ্জিনিয়ারিং। তাফসিয়া বর্তমানে পড়াশোনা করেন নিউহ্যাম কলেজিয়েট সিক্সথ ফর্ম সেন্টারে।
ওই প্রতিষ্ঠানই হার্ভার্ডের একজন গ্রাজুয়েটকে সঙ্গে নিয়ে তাফসিয়ার সাক্ষাৎকার ও আবেদনপত্র প্রস্তুত করার আহ্বান জানায়। এমআইটি’তে সফলভাবে আবেদন করার পর আসে সাক্ষাৎকার পর্ব। মধ্য লন্ডনের একটি কফি শপে আয়োজন করা হয় সেই সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকার নেন এমআইটির ভর্তির সঙ্গে জড়িত এমন একজন। এরপরই তাফসিয়া যেন হাতে চাঁদ পেয়ে যান। তার কপাল খুলে যায়।
এমআইটিতে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন এমন খবরে তিনি বলেন, লন্ডনের ইস্ট অ্যান্ডের কারো এমআইটিতে কেন সুযোগ পাওয়া উচিত নয়, কেন আমরা বড় স্বপ্ন দেখতে পারবো না? আমার কাছে তো মনে হচ্ছে আমি এখন চাঁদের দেশে আছি। চাঁদের বুকে বাস্তবে পা রাখা দ্বিতীয় ব্যক্তি (বুজ অলড্রিন) যে প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছিলেন আমি সেখানে যাচ্ছি পড়তে। এতে আমি বিস্মিত, আনন্দে বিহ্বলিত। এমআইটিতে যেসব মানুষ পড়াশোনা করেছেন তাদের প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা প্রযুক্তি খাতে যে বড় বড় অগ্রগতি দেখতে পেয়েছি এগুলোর পেছনে রয়েছে তাদের ভূমিকা। সেখানে পড়তে যাওয়া হবে আমার জন্য বিরাট এক পাওয়া।
উল্লেখ্য, এমআইটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬১ সালে। তারপর থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয় কলকারখানা খাত, প্রকৌশল খাত, ইন্টারনেট খাত, আর্থিক খাতে শীর্ষ স্থানীয় উদ্ভাবন এসেছে। সেই প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন এই বাংলাদেশি কৃতী শিক্ষার্থী। তিনি এ-লেভেলে ৫টি বিষয়ে এ-স্টার পাবেন বলে পূর্বাভাস দেয়া হচ্ছে। বিষয়গুলো হলো ম্যাথস, ফারদার ম্যাথস, ফিজিক্স, বায়োলজি ও কেমিস্ট্রি। শুধু কি তা-ই! তিনি জিসিএসই’তেও ১১টি বিষয়ে পেয়েছেন এ-স্টার। এ ঘটনা ঘটিয়েছেন তিনি স্ট্রাটফোর্ডের কাছে মাধ্যমিক স্তরের স্কুল সারাহ বোনেল-এ পড়তে গিয়ে।
এমআইটিতে পড়ার সুযোগ পাওয়া সম্পর্কে তাফসিয়া বলেন, তারা চায় মেধাবী শিক্ষার্থী। তারা এটা দেখে না যে, কোনো একজন শিক্ষার্থীর ব্যাকগ্রাউন্ড কি বা সে কোথা থেকে এসেছে। আমি মনে করি না যে, কারো এটা ভাবা উচিত নয় যে, তাদের পিতা-মাতা গরিব। তাই তারা এমআইটি’তে আবেদন করতে পারবে না। এমন ধারণা হলো মানসিক প্রতিবন্ধকতা। এ রকম প্রতিবন্ধকতা মানুষকে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দেয়। আমার চারপাশে অনেক মানুষ আছেন, তারা এমআইটিতে আবেদন করতে পারবেন না ভাবেন এমনটা। ভাবেন সেখানে পড়ার সুযোগ পাবেন না। আমি তাদেরকে বলছি, ইয়েস ইউ ক্যান। হ্যাঁ আপনারাও পারেন। কেন লন্ডনের ইস্ট অ্যান্ডে বসবাসকারী কেউ এমআইটিতে যেতে পারবে না, কেন আমরাও বড় স্বপ্ন দেখতে পারবো না?
এমআইটি সম্পর্কে তিনি বলেন, তারা অনেক বড় জিনিস নিয়ে ভাবতে শিখায়, অনেক বড়, যতটা বড় আপনি ভাবতে পারেন। আমি সব সময় এমনটাই ভেবেছি। আর তা ধরা দিয়েছে আমার প্রত্যাশা ও কঠোর শ্রমের কাছে। সিক্সথ ফর্মে’র প্রথম দিনে তারা আপনাকে নিয়ে যাবে কেমব্রিজে একটি সফরে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখাবে। তারপর তারা আপনাকে বলবে, এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ তোমারও ধরাছোঁয়ার বাইরে নয়।
তাফসিয়া বলেন, এখানকার প্রিন্সিপাল আমার মতো একই ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উঠে এসেছেন। কিন্তু তিনি কাজ করতেন এই শহরে একজন আইনজীবী এবং একজন ব্যাংকার হিসেবে। তিনি সব সময়ই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি তাদেরকে বোঝান এ কাজ তারাও করতে পারে এবং তিনি তাদেরকে সহযোগিতা করবেন। তার এ উৎসাহ অনেক বেশি উৎসাহিত করে শিক্ষার্থীদের। তাফসিয়া যেখানে সিক্সথ ফর্মে পড়াশোনা করে সেখানকার ৯ জন শিক্ষার্থীকে আগামী বছর পড়ার জন্য এরই মধ্যে প্রস্তাব দিয়েছে অক্সফোর্ড অথবা কেমব্রিজ।
প্রতিষ্ঠানটির প্রিন্সিপাল হলেন মহসিন ইসমাইল। তিনি বড় হয়েছেন পাশের ইলফোর্ডে। ব্যাংকিং খাত ও আইনজীবী হিসেবে তার বেতন ছিল ছয় অঙ্কের। তিনি সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে মানুষ গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। এখন তিনি বিজনেস ও ইকোনমিক্স পড়ান। ২০১৪ সালে তিনি এ প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হাতে নেন। তার সামনে তখন একটিই উচ্চাকাঙ্ক্ষা। তাহলো শিক্ষার্থীদের কৃতী করে গড়ে তোলা।
প্রিন্সিপাল মহসিন ইসমাইল বলেন, যখন আমি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলি, তখন তাদেরকে বলি তোমাদের মধ্যকার কেউ একজন আগামী দিনে এই দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারো। আমার কথা শুনে তারা হাসেন। তারা মনে করে আমি কৌতুক করছি। কিন্তু আমি কৌতুক করি না। নিউহ্যাম ও একই রকম যেসব এলাকা রয়েছে তাদের কাছে তাফসিয়ার মতো ছাত্রছাত্রীরা হলো সিম্বল। কেউ যদি নজর দেয় তাহলে দেখতে পাবে তাফসিয়া যাচ্ছে এমআইটিতে। ৯ জন শিক্ষার্থী যাচ্ছে অক্সফোর্ডে, যখন তারা বিশ্বাস করতে পারবেন তাদের ও তাদের সন্তানদের পক্ষেও এটা সম্ভব। এটা আত্ম-উৎসাহে কাজ করে।
উল্লেখ্য, তাফসিয়ার পিতা মাহমুদ শিকদার একজন আইটি কর্মী। মা লায়লা সুলতানা স্কুলে লাঞ্চটাইমের সুপারভাইজার। তাদের সঙ্গে তিন ভাইকে নিয়ে ওয়েস্ট হ্যামের বাড়িতে বসবাস করেন তাফসিয়া। তিন ভাইয়ের মধ্যে দু’জন তার বড়। তারা হলেন সাইফ ও ফাহিম। অন্যজন ছোট। তার নাম ইউনূস। ১৯৯০-এর দশকে তাফসিয়ার বড়ভাই জন্ম নেয়ার ঠিক আগে বাংলাদেশ ছাড়ে তার পরিবার। তারা তখন বসবাস করতে থাকেন টাওয়ার হ্যামলেটের কাছে। এমজমিন
০৩ এপ্রিল ২০১৭/এমটি নিউজ২৪/এসবি