তসলিমা নাসরিন: মনে আছে হ্যাপির কথা? রুবেলের প্রতারণার কথা সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিল। তাতে কী হলো? রুবেল রুবেলের মতোই আছে, ক্রিকেট খেলছে, ঘটা করে বিয়েও করেছে, তার জনপ্রিয়তায় এতটুকু চির ধরেনি। আর ওদিকে হ্যাপির ক্যারিয়ারের বারোটা বেজেছে, লোকের নিন্দে শুনেছে হ্যাপি, গালাগালি খেয়েছে, শেষ অবধি বাধ্য হয়েছে মুখ লুকোতে।
অপু বিশ্বাস তাঁর স্বামী শাকিবের প্রতারণার কথাও সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন। অপু আর শাকিব দুজনই সিনেমা করেন। দুজনই জনপ্রিয় তারকা। কিন্তু বিয়ের পর স্যাক্রিফাইস কাকে করতে হলো? অপু বিশ্বাসকে। নিজের ধর্ম কাকে বদলাতে হলো? অপুকে। ক্যারিয়ারের কার বারোটা বাজলো? অপুর। ওদিকে শাকিব কিন্তু চমৎকার আছেন। সিনেমা করে যাচ্ছেন নতুন নতুন নায়িকার সঙ্গে। যে তাঁর সবচেয়ে বেশি ছবির নায়িকা, তিনি আউট, তাঁকে সবার আড়ালে চলে যেতে হবে, মুখ লুকোতে হবে, জনসমক্ষে বেরোলে তাঁর চলবে না। তাঁকে একা একা ভুগতে হবে, গর্ভাবস্থার যন্ত্রণা আর ঝুঁকি একা একা ভোগ করতে হবে, একা একা কাঁদতে হবে, একা একা জন্ম দিতে হবে সন্তান। অপুর সেই কষ্টের-যন্ত্রণার সন্তান হবে তাঁর স্বামীর সন্তান, সন্তানের নামের শেষে যোগ হবে অপুর নয়, শাকিবের সারনেম।
অপুকে বিয়ের খবর লুকিয়ে রাখতে বলেছিলেন শাকিব, তাই অপু লুকিয়েছেন। শাকিবও কাউকে বলেননি তিনি বিবাহিত। তিনি বিবাহিত, এ খবর প্রচার হলে তিনি মনে করেন, তাঁর ক্যারিয়ারের ক্ষতি হবে। কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, অন্য নারীদের সঙ্গে তাঁর প্রেম করায় ব্যাঘাত ঘটবে!
বাংলাদেশের টেলিভিশনে দুজনের যা বক্তব্য শুনেছি তাতে মনে হয়েছে শাকিব খুব আত্মম্ভরী, উদ্ধত, ধৃষ্ট, নারীবিদ্বেষী, গোঁয়ার, স্বার্থপর, ঈর্ষাকাতর। আর অপু বোকা, ভীতু, কনফিউজড, লস্ট। শাকিব পিতৃতান্ত্রিক সমাজের আর সব পুরুষের মতো। অপুও পিতৃতান্ত্রিক সমাজের আর সব নারীর মতোই। অপু সংসার বলতে বোঝেন, রান্না করা, বাসন মাজা, কাপড় ধোয়া। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘আমি তো শাকিবের সাথে সংসার করেই আসছি। এক বছর আগে আমি যখন বাইরে গেলাম তার আগে আমি তো সংসারই করেই আসছিলাম। আমি প্রতিদিন শুটিং করে এসে তার বাসায় গিয়ে রান্না করতাম, ঘরদোর গুছাতাম, পরিষ্কার করতাম। আমার শাশুড়ি একবার হজে গিয়েছিলেন দেড় মাসের মতো, সেই দেড় মাসে আমি নিজে ওই বাসা সামলেছি। সকালে উঠে সমস্ত রান্না করে, ঘরদুয়ার ঝাড়ু দিয়ে, পরিষ্কার করে আমি শুটিংয়ে যেতাম। আবার বিকালে শুটিং শেষ করে এসে আমি আবার সমস্ত কিছু পরিষ্কার করতাম। আমিও সংসার করেছি, শাকিবও সংসার করেছে। ’ ...শাকিব কী করে সংসার করেছেন, তা অবশ্য অপু বিশ্বাস বলেননি। শাকিবও কি ঘর ঝাড়ু দিতেন, রান্না করতেন, ঘরবাড়ি পরিষ্কার করতেন— শাকিবও কি এভাবে সংসার করতেন? নিশ্চয়ই নয়। অপু যে এই নারীবিদ্বেষী সমাজের একজন মগজ ধোলাই হওয়া নারী, তা ওঁর কথা শুনলেই বোঝা যায়। যে সংসারে মেয়েদের দায়িত্ব টাকা পয়সা ঢালা, ঘরবাড়ি ঝাড়ু দেওয়া, বাড়িঘর সাজানো-গোছানো, রান্না করা, পরিবেশন করা, বাসন ধোয়া, কাপড় ধোয়া, সন্তান পালন করা— আর পুরুষের দায়িত্ব টাকা পয়সা ঢালা, অর্ডার দেওয়া, পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকা... সেটি আসলে কোনও সংসার নয়, সেটি প্রভু-দাসির হারেম।
শাকিবের বড় রাগ অপুর ওপর। অপু কেন বিয়ের কথা, বাচ্চার কথা, সত্য কথা সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছেন, ...তার মানে অপুর কোনও বদ উদ্দেশ্য আছে। অপু শাকিবের আদেশ মানেননি, চুপ করে থাকেননি, আড়ালে থাকেননি। তার মানে অপু খুব খারাপ। শাকিব বলতে চাইছেন অপু শুধু শাকিবের বউ হয়ে থাকতে চাইছেন না, নায়িকা হতে চাইছেন, সুতরাং অপু লোভী। আমার প্রশ্ন, শাকিব কি শুধু অপুর স্বামী হয়ে থাকতে চাইছেন? চাইছেন না। তিনি তো দিব্যি নায়ক হচ্ছেন এবং ভবিষ্যতেও নায়ক হতে চাইছেন। তাহলে শাকিব কি লোভী নন? মুশকিল হলো, শাকিব লোভী, স্বার্থপর, ঈর্ষাকাতর হলেও তাঁকে কেউ বলবে না তিনি লোভী, স্বার্থপর, ঈর্ষাকাতর। বরং অপুকে বলবে। মেয়েরা পুরুষের জন্য যত ত্যাগ করবে, পুরুষ তত অভ্যস্ত হবে মেয়েদের ত্যাগে। তত তারা ভাববে, ত্যাগেই মেয়েদের জন্মের সার্থকতা, মেয়েরা ত্যাগ করতে ভালোবাসে, ত্যাগ তাদের ডি-এন-এ তে আছে, ত্যাগই চরিত্র তাদের। মা সন্তানের জন্য নিজের সর্বস্ব বিসর্জন দেবে, প্রেমিকা প্রেমিকের জন্য দেবে, স্ত্রী স্বামীর জন্য দেবে। এর অন্যথা হলেই মেয়ে বদ, মেয়ের চরিত্র নষ্ট।
অপু বিশ্বাস এই সমাজের আর সব নারীর মতো ভিকটিম। স্বনির্ভর হয়েও, স্বনামধন্যা হয়েও ভিকটিম। তিনি নারীবিদ্বেষী এই নষ্ট সমাজের করুণা পেতে চান, তাই স্বামীর বাড়ি গিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করে আসেন। প্রফেশন ছেড়ে দেওয়ার জন্য স্বামীর যে আদেশ, তা মেনে নেন, লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাওয়ার অন্যায় আবদারও মেনে নেন। অপু সর্বস্ব ত্যাগ করেন। শাকিব তাঁকে অপমান শুরু থেকেই করছেন। কিন্তু তারপরও তিনি অপমান সয়ে গেছেন। সম্ভবত শাকিবের ভিন্ন নারীসঙ্গের কারণে তিনি এমনই চূড়ান্ত অপমানিত বোধ করেছেন যে শাকিবের আদেশ অমান্য করে অন্তরাল থেকে সামনে এসেছেন। ত্যাগী হয়েও মেয়েরা সব সময় রেহাই পায় না। আদেশ অমান্য করার শাস্তি তাঁকে পেতে হবে। অপু চাইছেন সমাজে তাঁর সন্তান পিতার পরিচয় দিতে পারুক। অপু চাইছেন স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার করতে।
পরনির্ভর মেয়েরা যখন কাঁদে, আমি বুঝি তাদের অসহায়তা। কিন্তু প্রতারক স্বামীর জন্য স্বনির্ভর নারীদের চোখের জল আমাকে বড় বিষণ্ন করে। কেন স্বনির্ভর নারীরা অন্তত দেখিয়ে দিতে পারেন না তাঁরা পুরুষের দাসী নন, তাঁরা নারী-পুরুষের বৈষম্য মানেন না, নারীবিদ্বেষী পুরুষের কোনও স্থান নেই তাঁদের জীবনে, অপমান যারা করে বা করতে চায়, তাদের ঝেঁটিয়ে বিদেয় করার শক্তি তাঁদের আছে। স্বনির্ভর মেয়েদের এও বোঝাতে হবে, তাঁরা একা বাস করতে পারেন। একা তাঁদের সন্তানদের বড় করতে পারেন। দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল কতটা ভালো জানি না, তবে দুষ্ট পুরুষের চেয়ে একার সংসার ঢের ভালো।
অপুর অভিজ্ঞতা যেন মেয়েদের সচেতন করে, কাউকে যেন অপুর মতো ভুগতে না হয়। কোনও স্বনির্ভর মেয়েকে যেন কোনও অপ্রেমিক পুরুষের জন্য এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলতে না হয়। কোনও মেয়েকেই যেন শারীরিক মানসিক অত্যাচার করার সুযোগ কোনও পুরুষ না পায়। মেয়েরা যেন বোঝে, ত্যাগ মেয়েদের ধর্ম নয়, পুরুষদের মতো মেয়েদেরও সুখে সম্মানে স্বস্তিতে সানন্দে বেঁচে থাকার শতভাগ অধিকার আছে।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।
১৩ এপ্রিল ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/টিটি/পিএস