জেবুননেসা চপলা, সাস্কাতুন (কানাডা) থেকে: মনে পড়ে রমজান মাসে আব্বা অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে ইফতারের জন্য শুকনা খেজুর, শসা, তরমুজ, আম, বাঙ্গি, জামরুল, পেয়ারা, তোকমা, লেবু আর ইসবগুলের ভুসি দিয়ে শরবত বানিয়ে খাওয়ার প্ল্যান করে বাড়িতে ফিরতেন। কী ধরনের খাবার খেলে পেট ঠান্ডা থাকবে, শরীর ডিহাইড্রেড হবে না সারা দিনের উপাসের পর এবং ইফতারের মেনু বাছাইয়ের মধ্যেও কীভাবে প্রকৃত সংযম প্রকাশ পাবে, সেটাতেই তিনি বেশি গুরুত্ব প্রদান করতেন।
আমার আম্মার ডালের বড়া আর ছোলা-মুড়ি প্রিয় ছিল বলে ইফতার আইটেম থেকে এটা কখনো বাদ পড়ত না। তবে সেটা অবশ্যই কম তেল-মসলা দিয়ে তৈরি করা হতো। ইফতার বলতে বাড়িতে ছোলা-মুড়ি আর দেশি ফলমুলকেই আমরা বুঝতাম। কিন্তু যখন থেকে কলোনাইজড খাবারের সংস্কৃতি বাণিজ্যিকীকরণ হলো অতিমাত্রায়, তখন নিজের অজান্তেই কখন যেন স্রোতে গা ভাসাতে শুরু করলাম পুঁজিবাদী ইফতার ইন্ডাস্ট্রিতে।
১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, মনে পড়ে সেই সময়টাতে ধানমন্ডির বাণিজ্যিক ইফতার প্যাকের ভীষণ জনপ্রিয়তা তৈরি হলো। ওগুলো না খেলে বড়লোকি দেখানোপনা টাইপ বন্ধুদের কাছে যেন আর ইজ্জত থাকে না। তাই পাল্লা শুরু করলাম সেসব অস্বাস্থ্যকর ও অহেতুক অর্থ ব্যয়ের কারখানাতে যেতে। মুখরোচক ইফতারি খাওয়ার লোভে আর সোশ্যাল স্ট্যাটাস বাড়াবার জন্য।
মনে পড়ে মোহাম্মদপুর থেকে বনানী, গুলশানেও গিয়েছি অভিজাত বিপণির ইফতার পরখ করতে। ঢাকার নানা অভিজাত ইফতার কারখানার ইফতারের তালিকায় হালিম, দইবড়া, নানা ধরনের প্যাটিস, জিভে জল আশা হাজার ধরনের জানা-অজানা নামের তৈলাক্ত কাবাব, ১০ -১২ ধরনের অস্বাস্থ্যকর ভাজাপোড়া, মিষ্টি, জিলাপি, লাড্ডু, বাকলাভা, টার্কিশ কাদাইফ শোভা পেত। আর সেই সঙ্গে তেহারি, বিরিয়ানি, মোগলাই পরোটা, ভেলপুরি, নানা রংবেরঙের চোখ রাঙানো শরবত, বোরহানি, ফালুদা ইত্যাদি দেখার পর বাসায় তৈরি করা মায়ের হাতের ইফতার আর খেতে ইচ্ছে করত না। মনটা পড়ে থাকত ওই সকল মুখরোচক ইফতারের জন্য।
আসলে চোখের খিদেটাই তখন বড় ছিল। আমরা ভাইবোনেরা মজা মজা করে প্রায়ই ওই সব অভিজাত ইফতার গিলে সুখ পাওয়ার চেষ্টা করতাম। যা আব্বা-আম্মা পছন্দ করতেন না। খেতেও প্রচুর নিষেধ করতেন। কারণ সারা দিন রোজা রাখার পর এত তৈলাক্ত সব খাবার স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। অসুস্থ হব সে কথা কে না জানে, কিন্তু আমি কথা শুনতাম না।
আজ উপলব্ধি করি, তারা কত সাদামাটা মানুষ ছিলেন। জীবনযাপনে ছিল সততা। লোভ করতেন না জাগতিক বিষয় নিয়ে। আর তাদের যাপিত জীবনে ছিল চোখে পড়ার মতো নির্লিপ্ততা। দেখানোপনার বালাই ছিল না একদম। ভূরিভোজের আয়োজন তারা কখনোই ইফতারে করতেন না। আমরাও সেটাই শিখে বড় হয়েছি। আব্বা-আম্মা বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন, ইফতারের বাণিজ্যিক ইন্ডাস্ট্রির কাস্টমার হতে পারার মধ্যে কোনো ক্রেডিট নেই। কারণ এই সব ধান্দাবাজ ব্যবসায়ীরা সাধারণ জনগণের ধর্মের সূক্ষ্ম অনুভূতিকে নিয়ে ব্যবসা করে অধিক মুনাফা লাভের আশায়! তারা শিখিয়েছেন, নিজেকে আলাদাভাবে সাদামাটা জগতের বাসিন্দা বানাতে পারলেই পরিতৃপ্তি আসবে মনে। সমাজের জন্যও তা সুফল বয়ে আনবে। মনের সংযম প্রথমত শুরু করতে হবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত, অভিজাত বিপণির ইফতার খাওয়ার লোভ সামলিয়েই। সংযমের মাস রসনা পূজা করবার জন্য নয়।
আজকাল মানুষ ইফতারে যত ধরনের চোখ ধাঁধানো মুখরোচক খাবার খাওয়ার সংস্কৃতি তৈরি করেছে, সেসব খাবারের নাম আমার দাদা বা আব্বা-আম্মার জানার প্রশ্নই আসে না। কারণ ওসব খাবার আমিও চিনি না এই প্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে। অবাক হয়ে যাই, যে রোজার অর্থ ‘সংযম’ সেখানে মানুষ উন্মাদ হয়ে অনেক মানুষ যা খেতে পারবে তা সে একাই বাড়িতে বানাচ্ছে এক রাতের ইফতার পার্টিতে।
অন্যদিকে ৩০ দিনের রোজায় দেখা যায় প্রায় ১৫-২০ দিনই ইফতার পার্টিতে অংশগ্রহণ করছে সমাজের একশ্রেণির লোক। নারীরা নিত্য নতুন স্টাইলের সালোয়ার-কামিজ পরতে ব্যস্ত প্রতিটি ইফতার পার্টিতে। সকলের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে একধরনের ইতিবাচক মিথস্ক্রিয়া হয় ইফতার পার্টিগুলোতে। সেটা আমি বুঝি ও সমর্থনও করি। কিন্তু টেবিল ভরা এত এত ইফতার প্রদর্শন ও গোগ্রাসে একনিমেষে তা ভক্ষণ করে ফেলা আর সকল খাবারের ছবি তুলে তা সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখানোপনার ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝি না! আবার এটাও দেখেছি, সমাজের কোনো প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির সান্নিধ্যে ইফতার খেয়ে সেটাও জাহির করা নিয়ে মানুষ ব্যস্ত।
সারা দিন বাড়িতে অদৃশ্য শেকলে যে দাসকে সময়ে-অসময়ে খাটানো হলো বা অধস্তন কর্মচারীদের খাটানো হলো ইফতার তৈরি করবার জন্য, তারা আগে পেটভরে খেতে পারল কিনা তা নিয়ে চিন্তা না করে নিজেই সকল ভালো ভালো টুকরাগুলো বা খাবারগুলো খেয়ে নিলেন। গৃহকর্তা হিসেবে তা যে চরম অসংযমী আচরণের আওতায় পড়ে, তা নিয়ে আর কত দিন না ভেবে থাকব আমরা? আজও আমাদের দেশের গৃহ পরিচারিকাদের খাবারের স্থান রান্না ঘরের মেঝেতে। তাদের জন্য বরাদ্দ টিনের প্লেট, প্লাস্টিকের গ্লাস, ছেঁড়া কাঁথা, বালিশ, মশারি আর ঘুমানোর স্থানও রান্না ঘরই। অথচ গৃহিণী ও গৃহকর্তা রোজা রাখছেন ২৯-৩০টি, নামাজ পড়ছেন পাঁচ ওয়াক্ত।
ইফতারকে কেন ‘পার্টি’ বলে তাতো আজও বুঝি না। শুনেছি আজকাল নাকি সাহরি পার্টিও করেন অনেকে। ইফতার ও সাহরি এগুলোতো প্রতিদিনকার ধর্মীয় প্রার্থনা। তাহলে কি কোনো একদিন শুনব নামাজ পার্টি হচ্ছে! ইংরেজি পার্টি শব্দটা উৎসব এবং আনন্দ প্রকাশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে বোঝাবার জন্য ব্যবহৃত হয় বলেই জানতাম। কিন্তু রোজা রাখাটা নিয়মিত নামাজ পড়ার মতোই একটা ব্যাপার। সেখানে সমাজের মানুষকে ইফতার পার্টিতে নেমন্তন্ন দিয়ে জৌলুশ দেখানো চোখ ধাঁধানো, টেবিল উপচে পড়া ইফতার খাওয়ার সংস্কৃতি তৈরি হলো কেন ঘরে ঘরে? আমরা কখনো কি ভেবে দেখেছি যে, সমাজের সবাই আমরা কমবেশি এই অধঃপতিত চর্চাগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত, যেখানে ধর্মের অন্তর্নিহিত শিক্ষা সংযমের কোনো বালাই নেই। জাতিগতভাবে যে পরিমাণ অসংযমী ইফতার পার্টি উদ্যাপন করা হয় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আর নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে, তার দায় কিন্তু আমাদেরই নিতে হবে। এই ধরনের লোক দেখানো ইফতার পার্টি সমাজে অসমতা তৈরি করে। এই ধরনের অসংযত সামাজিক চর্চাগুলো সমাজে মানুষের মাঝে নানা ধরনের মানসিক দূরত্ব তৈরি করে এবং একধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের মধ্যে ঠেলে দেয় মানুষকে নিজেদের অজান্তেই।
মুসলমানেরা তাদের নিজস্ব অধঃপতনের সব দোষের ভার ইহুদি, নাসারা আর পশ্চিমা দেশগুলোকে চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের দোষ ঢাকতে চেষ্টা করে। কিন্তু সত্যটা হলো ইহুদি, নাসারারা বাংলাদেশে গিয়ে আজকের অধঃপতিত প্রতিযোগিতামূলক সাহরি আর ইফতার পার্টির প্রচলন করেনি ঘরে ঘরে। মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করা এই আমরাই, মুসলিম কমিউনিটির সমর্থনে ঘরে ঘরে আমরা স্রোতে গা ভাসিয়ে এই অসম ও অসংযমী ইফতার ভক্ষণের সংস্কৃতি তৈরি করেছি। আমি, আপনি আমরা সকলে এই সামাজিক অসমতা তৈরিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রতিনিয়ত অংশগ্রহণ করেছি ও করছি। আমরা তা স্বীকার করি আর নাই করি, এটাই সত্য।
সত্যিকার ধর্মপ্রাণ পরিশীলিত, নির্লোভ, সংযমী আত্মার মানুষ আজ আর দেখি না কেন? সংযমের অর্থ ও তাৎপর্য আমরা মুসলিম ঘরে জন্ম নিয়ে, বেড়ে উঠে, সারা জীবন রোজা পালন করেও সংযমের অন্তর্নিহিত অর্থ জাতিগতভাবে বুঝি না কেন? রাষ্ট্রীয়ভাবে, জাতিগতভাবে জন্মের পর থেকেই ধর্ম জ্ঞান ঘরে ঘরে প্রচার করা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে ধর্ম স্কুল জীবন থেকে শেখাবার পরও আজ পৃথিবীর মুসলমানেরা ধর্ম কেন বোঝেন না এবং ধর্মের নামেই সকল অধর্ম কেন করে যাচ্ছেন তা নিয়ে কি এখনো ভাববার সময় হয়নি? আর কত দিন আমরা শুধুমাত্র সওয়াব বেশি পাওয়ার জন্য অর্থ না বুঝে, টেক্সট না জেনে, ব্যাখ্যা না বুঝে রমজান মাস এলেই আরবি ভাষায় কোরআন খতম দিতে মরিয়া হয়ে যাব? আর সংযম যে শুধুমাত্র রমজান মাসের জন্য নয়, তাই বা কেমন করে বুঝিয়ে বলি। সংযমের অনুশীলন করতে হবে জীবন চলার পথে প্রতিটি দিন। সংযম শুধু রমজান মাসে নয়, প্রতিটি ক্ষণ, জীবনের পড়তে পড়তে সংযম থাকতে হবে। পশ্চিমা বিশ্বে দেখেছি ক্রিসমাস এলে খাবারের দাম কমে যায়। যাতে করে সকলের সামর্থ্যের মধ্যে খাবারটা থাকে। আর এখানে ধনীর খাবার আর গরিবের খাবারে এত আকাশ-পাতাল পার্থক্য চোখে ধরা পড়ে না। অথচ আমাদের দেশে দেখেছি ব্যবসায়ীরা এই সংযমের মাসেই সবচেয়ে বেশি অনৈতিক কাজ করে এবং দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বি ঊর্ধ্বমুখী করে দেয়।
আমরা কেন ভুলে যাই আমাদের দেশে লাখ লাখ ছিন্নমূল শিশু ও অনাহারী মানুষ রাস্তার পাশের ডাস্টবিন থেকে খাবার কুড়িয়ে খায়। আপনার, আমার ইফতার পার্টির উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়েই তারা জীবন ধারণ করে। ধর্ম পালন মানে শুধুমাত্র জান্নাতের পাসপোর্ট অর্জন করা নয়, নিজের ভেতরের বিবেককে জাগ্রত করাটাই এর মূল লক্ষ্য। ধর্মীয় গ্রন্থে লুকিয়ে থাকা জ্ঞানকে উপলব্ধির অভাব, আত্ম জাগৃতির দ্বারগুলোকে বন্ধ করে দিয়ে এবং ধর্মকে আধ্যাত্মিক বিষয় মনে না করে বেশি নেকি বা নম্বর পেয়ে শুধুমাত্র পরকালের জন্য লোভ করা কোনো ধর্মেরই লক্ষ্য নয়। ধর্মচর্চার মধ্যে দিয়ে যেসব সামাজিক অনাচার তৈরি হয় তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেই হবে ধর্মের সম্মান বাঁচাবার স্বার্থেই। ধর্মচর্চার নামে সামাজিক অনাচার বন্ধের দায়িত্ব ঘর থেকেই নিতে হবে এবং ধর্মের নামে এই অসংযমী জীবন ব্যবস্থাকে রোধ করবার জন্য সচেতন হতে হবে প্রতিটি ঘরে ঘরে।
নামাজ যেমন একটি একান্ত নিজস্ব প্রার্থনা তেমনি সারা দিন উপাস থাকবার পর রোজা শেষ করে ইফতারি করাটাও একটা প্রার্থনা। মাঝ রাতে সাহরি করাটাও একটা প্রার্থনা। প্রার্থনার সময় মানুষ অন্তর্দৃষ্টি জাগ্রত করে, ধ্যান করে। সেখানে যদি এত হইচই, খাইদাই, হাপুসহুপুস করে নামাজ পড়া শেষ করে সেকেন্ড রাউন্ড মজাদার বিরিয়ানি খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকি, তাহলেতো সেটা আর প্রার্থনা হলো না, সেটা হলো রিয়েল পার্টি মুড। অনেকে ইফতার মাহফিল শব্দটা আজকাল ব্যবহার করছেন, কিন্তু সেই মাহফিলও যদি পার্টি স্টাইলে উদ্যাপন করা হয় তাহলেতো আবার সেই সমস্যাটা রয়েই গেল। মানুষ শুধু উপোস থাকবে। সত্যিকার সংযমের প্রার্থনাটা একলাই পড়ে থাকবে।
সত্যিকার সংযমের বাণী যদি আমরা পৌঁছে দিতে পারি, তাহলে অন্তত এই রোজার মাসে সমাজের খুন-ধর্ষণ, রাহাজানি, দুর্নীতি কিছুটা হলেও কমবে। সংযমের উদ্দেশ্য শুধু উপোস থাকা আর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইফতার খাওয়া নয়। হিংসা, ঘৃণা, লোভ কমিয়ে, সহিষ্ণুতা আর সহমর্মিতা বাড়ানোও অন্যতম লক্ষ্য। আশা করি এই সংযমের মাসে প্রভু আমাদের জ্ঞান দেবেন জাতিগত মূর্খতা ঘুচাবার জন্য এবং সংযমের অন্তর্নিহিত অর্থ উপলব্ধি করতে সহায়তা করবেন। আমিন।-প্রথম আলো
লেখিকা পিএইচডি গবেষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী।
২২ জুন ২০১৭/এমটিনিউজ২৪ডটকম/আ শি/এএস