এমআরপি ঝুঁকিতে ২৯ লাখ প্রবাসী
নিউজ ডেস্ক: আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) নির্দেশ অনুযায়ী চলতি মাসের ২৪ তারিখের পর হাতে লেখা পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে ভ্রমণ ও অবস্থান করা যাবে না। যারা ছুটি নিয়ে দেশে আসতে চান কিংবা চাকরি শেষে স্বদেশে ফিরতে চান তারা যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্ট বা এমআরপি ছাড়া বিমানে চড়তে পারবেন না। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এমআরপি না পেলে ঝুঁকিতে থাকবেন ২৯ লাখ প্রবাসী। জানা গেছে, স্বার্থসংশ্লিষ্টতা নিয়ে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কিছু আমলার মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তাদের কারণে প্রবাসীদের এমআরপি পেতে সময় ক্ষেপণ হচ্ছে। এ সুযোগে সেখানকার দূতাবাসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী অনিয়ম-দুর্নীতি যেমন করছেন, তেমনি অসহযোগিতা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে প্রবাসীদের।
জানা গেছে, ১৫৯টি দেশে প্রায় ৯০ লাখ বাংলাদেশি কাজের সন্ধানে অবস্থান করছেন। তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্টধারী। আইকাওয়ের বেঁধে দেওয়া সময়ের আগে প্রবাসীদের হাতে যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্ট (এমআরপি) তুলে দিতে সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু করে। গঠন করা হয় উপদেষ্টা কমিটি ও টাস্কফোর্স।
তৎকালীন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
পাশাপাশি আউটসোর্সিং কাজ আরও গতিশীল করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব আবুল কালাম আজাদকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। টাস্কফোর্সের অন্য সদস্যরা হলেন_ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোজাম্মেল হক খান, পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব খন্দকার ইফতেখার হায়দার এবং বহির্গমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এমএন জিয়াউল আলম।
সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে কাজের অংশ হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আগে থেকেই অতিরিক্ত জনবল সেখানে পাঠায়। সর্বশেষ সেখানে আরও জনবল সহায়তা দিয়ে দ্রুত কাজ শেষ করতে পৃথক দুটি দলে ১৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী পাঠানোর উদ্যোগ নেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত ৮ অক্টোবর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে মঞ্জুরি আদেশ জারি করার অনুরোধ জানিয়ে একটি চিঠি পাঠায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়ায় সর্বশেষ ২৭ অক্টোবর আদেশ জারি করতে ফের তাগিদ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জবাবে ২৮ অক্টোবর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ফিরতি চিঠি পাঠিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানায়, 'বিদ্যমান জনবল দিয়েই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সৌদি প্রবাসীদের হাতে এমআরপি প্রদান করা সম্ভব। এমতাবস্থায় সৌদি আরবের দুটি মিশনসহ অন্য কোনো বাংলাদেশ মিশনে অতিরিক্ত জনবল প্রেরণ করার আর কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।'
সর্বশেষ গত ৪ নভেম্বর পররাষ্ট্র সচিবকে পুনর্বার তাগিদ দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সুরাইয়া পারভীন শেলী স্বাক্ষরিত আরেকটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে রিয়াদ ও জেদ্দায় কনস্যুলেটে জনবল নিয়োগের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম সংযুক্ত করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, মধ্যপ্রাচ্যের দূতাবাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া নিয়ে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে মনস্তাত্তি্বক লড়াই চলে আসছে। তিন বছর ধরে এ দ্বন্দ্ব চলতে থাকায় এমআরপি কার্যক্রম অনেকটাই ধীরগতিতে চলতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ২৮ অক্টোবর মিশনে আর অতিরিক্ত জনবল প্রয়োজন নেই বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, 'এমআরপি কার্যক্রম সম্পন্ন করতে সৌদি আরবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের টিম পাঠানো হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। আশা করি যথাসময়ে প্রবাসীরা এমআরপি পেয়ে যাবেন।'
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা ৬৭ মিশনের মধ্যে ৪১টিতে যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্ট তৈরির সরঞ্জাম সংযুক্ত আছে। তবে, এর পরিমাণ ও কাজের গতি খুবই কম। তা দিয়ে যথাসময়ে বিপুলসংখ্যক পাসপোর্ট এমআরপি করা সম্ভব হবে না। ২০১০ সালের ১ এপ্রিলে এমআরপি সুবিধা চালু হওয়ার পর থেকে দেশ-বিদেশ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১ কোটি ২২ লাখ এমআরপি বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে দেশে বিতরণ করা হয়েছে এক কোটি। প্রবাসীদের এমআরপি দেওয়া হয়েছে মাত্র ২২ লাখ। জনবল কম থাকায় এমআরপি কার্যক্রম সম্পন্ন করতে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে লোক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। আউটসোর্সিং কোম্পানির সঙ্গে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের চুক্তি অনুযায়ী ২৪ নভেম্বরের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১০ লাখ, সৌদি আরবে ১৫ লাখ এবং মালয়েশিয়ায় ৬ লাখসহ এই তিন দেশে প্রবাসীদের মধ্যে মোট ৩১ লাখ এমআরপি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আউটসোর্সিং কোম্পানিগুলো পাসপোর্ট ইস্যু করেছে মাত্র ২ লাখ। অর্থাৎ এখনও টার্গেট অনুযায়ী বাকি রয়েছে ২৯ লাখ প্রবাসীর পাসপোর্ট।
দূতাবাসে এমআরপি পেতে হয়রানি :সম্প্রতি সৌদি আরবে একাধিক প্রবাসীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দেশের জনশক্তির বৃহৎ একটি অংশ সৌদি আরবে কর্মরত। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে। অথচ এমআরপি নিতে গিয়ে তারা চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
তারা অভিযোগ করে বলেন, দূতাবাসের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী বিভিন্ন ওয়ার্ক স্টেশনে পাসপোর্ট আটকে রেখে বাণিজ্য করছে। ২শ' থেকে ৪শ' সৌদি রিয়াল দিলেই দ্রুত এমআরপি মিলছে। না হলে মাসের পর মাস ঘুরতে হচ্ছে। আইকাওয়ের বেঁধে দেওয়া সময়কে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে না। বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন রিয়াদ দূতাবাসের তত্ত্বাবধানে শিপায় স্থাপিত ওয়ার্ক স্টেশনভুক্তরা। এখানে প্রায় ৪০ হাজার এমআরপি বিতরণের অপেক্ষায় রয়েছে।-সমকাল
০৮ নভেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/পিবি/পিপি