প্রবাস ডেস্ক : “রাতে গোসল করিয়ে আমারে পাতলা ফিনফিনে কাপড় পরতে দেয়। আমি পাতলা কাপড় পরতে না চাইলে মারধর শুরু করে। এরপর আমার ঘরে প্রথমে আসে ছেলে, পরে আসে বাপ। তারপর আমারে জড়ায়ে ধরে (প্রচার অযোগ্য শব্দ)। বাধা দিতে গেলে আমারে মাইরা-ধইরা, কামড়াইয়া-চিমড়ায়া কিছু রাখেনাই।"”
এভাবেই সৌদি আরবে থাকাকালীন নির্যাতনের ঘটনাগুলো বর্ণনা করছিলেন সেখান থেকে ফেরত আসা নারী শ্রমিক ময়না বেগম।
একটু ভালো থাকায় আসায়, পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে বাংলাদেশ থেকে পরিবার-পরিজন ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমায় লাখো মানুষ। এর মধ্যে একটি বড় সংখ্যক মানুষই নারী। আর মধ্যপ্রাচ্যেই এসব নারী শ্রমিকের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু কেন সেখানে এত নারী শ্রমিকের চাহিদা? কেমন আছেন সেখানে আমাদের মা-বোনেরা? এর জবাব দিয়েছেন সেখান থেকে ফিরে আসা বেশ কয়েকজন নারী। শুনে হতভম্ব হয়ে গেছেন উপস্থিত সকলে।
তাদের বর্ণনায় উঠে এসেছে নারী শ্রমিকদের ওপর ভয়াবহ যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের চিত্র। আর সেই নির্যাতনে শামিল হন একই পরিবারের একাধিক সদস্য। কখনো দুই ভাই, কখনো বাবা-ছেলে। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন হাসপাতাল, শপিং মল, রেস্ট্যুরেন্টে চাকরি দেওয়ার কথা বলে নারীদের মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো হলেও অধিকাংশ নারীর জায়গা হয় বিভিন্ন পরিবারে গৃহপরিচারিকার কাজে। আর সেখানে অনেকটা যৌনদাসী হয়ে পার করতে হয় দিন। প্রতিবাদ করলে নেমে আসে অকথ্য নির্যাতন। দেশে ফিরতে চাইলেও অনেক সময় সে সুযোগ মেলে না।
সৌদি আরব, জর্ডান, লেবানন বা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ থেকে কাজের জন্য যাওয়া নারীরা কেমন আছেন— এই বিষয়ে শনিবার ঢাকায় আয়োজিত এক গণশুনানিতে ফিরে আসা নারী শ্রমিকরা যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন নির্যাতনের ভয়াবহ বর্ণনা দেন। গণশুনানিতে নারী শ্রমিকদের কথা শোনেন বাংলাদেশের কয়েকজন সাবেক বিচারপতি, মানবাধিকার কর্মী, অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও শ্রমিকনেতারা।
বাংলাদেশে একটি হাসপাতালে ১২০০ টাকা বেতনে কাজ করতেন ময়না বেগম। হাসপাতালে চাকরির কথা বলে সৌদি আরবে ভালো বেতনে কাজের জন্য পাঠানো হয় তাকে।
কিন্তু সেখানে গিয়ে তাকে একটি বাড়িতে কাজের জন্য নেওয়া হয় এবং শিকার হতে হয় যৌন নির্যাতনের। ‘প্রথমে আমাকে বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে নিতে আসেন দুই পুরুষ। দেখে ভয় পাই। পরে ওই বাড়িতে ঢুকে যখন এক মহিলা দেখি তখন মনে সাহস আসে। কিন্তু রাতে গোসল করিয়ে আমারে পাতলা ফিনফিনে কাপড় পরতে দেয়। আমি পাতলা কাপড় পরতে না চাইলে মারধর শুরু করে। এরপর আমার ঘরে প্রথমে আসে ছেলে, পরে আসে বাপ। তারপর আমারে জড়ায়ে ধরে নির্যাতন করে। বাধা দিতে গেলে আমারে মাইরা-ধইরা, কামড়াইয়া-ছিমড়াইয়া কিছু রাখে নাই। ’
গতকাল ঢাকায় ওই গণশুনানিতে নিজের ওপর সৌদি আরবে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের কথাগুলো এভাবেই বলছিলেন ময়না বেগম। লাল কাপড় দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে মঞ্চে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন তিনি, ‘নয় মাস এমন নির্যাতনের ফলে আমার প্রজনন অঙ্গে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে তাতে এখনো চিকিৎসার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। আমার স্বামী নাই। স্বামী থাকলে আমারে ঘরে উঠাইত না। অনেক কষ্টে ছেলেরে নিয়া আছি।’
এ অনুষ্ঠানে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ছাড়া নারী শ্রমিক পাঠানোর বিষয়ে বিরোধিতা জানিয়েছেন শ্রমিকনেতা, মানবাধিকার কর্মী ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। সেখানে অভিবাসী নারী শ্রমিকদের ওপর বিদেশে নির্যাতনের বিষয়ে সরকারের আরও জোরালো পদক্ষেপের দাবি উঠে আসে।
অভিবাসী বা পাচার হয়ে যাওয়া নারীদের আইনি সহায়তা প্রদানকারী সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রধান সালমা আলী বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসী নারী শ্রমিকদের মধ্যে ৯৯ শতাংশই শারীরিক-মানসিক সব ধরনের নির্যাতনের শিকার। অনেক শ্রমিক সেখানে নির্যাতনের মুখে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হচ্ছেন।’
এমটিনিউজ/এসএস