তসলিমা নাসরিন : পদ্মাবতী নামের একটি চলচ্চিত্র নিয়ে ভারতবর্ষে কী যে কাণ্ড হচ্ছে— দেখলে দুঃখও হয়, ভয়ও হয়। বছরের শুরু থেকে শুরু হয়েছে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব দুর্ঘটনা। প্রথমে তো পদ্মাবতীর সেট-ই পুড়িয়ে দিল। তারপর পদ্মাবতীর পোস্টার পোড়ালো।
‘রাজপুত কর্ণী সেনা’ নামের একটি দল থেকে পদ্মাবতীর নায়িকা দীপিকা পাডুকোনের নাক কেটে দেবে বলে হুমকি দিল, পরিচালক সঞ্জয় লীলা বানসালির মাথার মূল্য পাঁচ কোটি টাকা ঘোষণা করে দিল। রাজস্থানের চিতোরের রানী পদ্মিনীর জীবন নিয়ে নির্মিত হয়েছে পদ্মাবতী। পদ্মাবতীকে নিয়ে নানা রকম গল্পকথা বা কল্পকথা প্রচলিত।
দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি চিতোর দখল করতে গিয়ে পদ্মাবতীর রূপে দিওয়ানা হয়ে তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পদ্মাবতী নিজেকে শত্রুর হাতে সঁপে দেওয়ার চেয়ে চিতোরের আরও মেয়েদের নিয়ে, যেই মেয়েদের স্বামীরা আলাউদ্দিনের সৈন্যদের হাতে নিহত হয়েছেন, আগুনে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন।
ইতিহাসবিদরা আলাউদ্দিনের চিতোর দখল আর ৩০ হাজার হিন্দু পুরুষকে হত্যা করার কথা লিখেছেন, কিন্তু চিতার আগুনে পদ্মাবতীর জ্যান্ত পুড়ে মরার কথা লেখেননি। সঞ্জয় লীলা বানসালির ছবিতে নাকি পদ্মাবতীর একটি স্বপ্নদৃশ্য দেখানো হয়েছে, ওই দৃশ্যে আলাউদ্দিন খিলজির সঙ্গে নাচছেন পদ্মাবতী।
যদিও বার বারই সঞ্জয় লীলা বলেছেন, এ রকম কোনো স্বপ্নদৃশ্য পদ্মাবতীতে নেই, তা ছাড়া হিন্দুদের অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে এমন কোনো দৃশ্যই ওতে নেই, তার পরও কর্ণী সেনা শান্ত হচ্ছে না। তারা পদ্মাবতীকে মুক্তি পেতেই দেবে না। চারদিকে জানিয়ে দিচ্ছে, পদ্মাবতীকে নিষিদ্ধ করতে হবে।
হিন্দু মৌলবাদী গোষ্ঠী অবিকল মুসলিম মৌলবাদী গোষ্ঠীর মতোই আচরণ করছে। এ ধরনের অসহিষ্ণুতার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে প্রায় তিন যুগ আগে। আমি অবাক হচ্ছি, অবশ্য অবাক কেনইবা হব, আমাকে নিয়েও রাজনীতিবিদরা কি একই কাণ্ড করেননি?
মৌলবাদীদের অগণতান্ত্রিক, অসভ্য, অশোভন, বাকস্বাধীনতাবিরোধী, নারীবিরোধী যুক্তিহীন আবদার তারা মেনে নিয়েছেন। আমার বেলায় রাজনীতিবিদরা মুসলিম মৌলবাদীদের আবদার মেনে নিয়েছেন, বাংলাদেশে, পশ্চিমবঙ্গে এবং ভারতের আরও আরও রাজ্যে। আর আজ পদ্মাবতী নিয়ে যখন তাণ্ডব তুঙ্গে, রাজনীতিবিদরা মেনে নিচ্ছেন হিন্দু মৌলবাদীদের আবদার। কর্ণী সেনা পদ্মাবতী ছবিকে নিষিদ্ধ করার দাবি করেছে।
সুতরাং বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও দিব্যি বলে দিয়েছেন পদ্মাবতীকে তাদের রাজ্যে দেখানো হবে না। কেউ কেউ দুই কাঠি এগিয়ে বলছেন, ছবিটিকে নিষিদ্ধ করাই ঠিক। আমার হাসিও পায়, আবার কান্নাও পায়, ছবিটি কিন্তু কেউ দেখেনি, না দেখেই সমালোচনা হচ্ছে, না দেখেই ছবি নিষিদ্ধ হচ্ছে। এ রকম অদ্ভুত আচরণ আমার সঙ্গেও কয়েক বছর আগে করা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি টিভির জন্য আমার লেখা একটি মেগা সিরিয়াল পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রচার করতে দেননি। ‘দুঃসহবাস’ নামের সেই মেগা সিরিয়ালটির বিজ্ঞাপন টাঙানো হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের রাস্তাঘাটে। সব বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং উপড়ে ফেলেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। আর পুলিশ পাঠিয়ে সিরিয়ালের প্রযোজক ‘চ্যানেল এইট’-এর লোকদের শাসিয়েছিলেন।
মেগা সিরিয়াল সম্প্রচার করেছ তো মরেছ। দুঃসহবাসের গল্প কী নিয়ে, কেমন সেই গল্প, সেসবের কিছু না জেনে দুঃসহবাস নিষিদ্ধ করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। করেছিলেন রাজ্যের অসহিষ্ণু অশুভ অপশক্তি মুসলিম মৌলবাদীদের খুশি করার জন্য। আজ সেই একই মমতা ব্যানার্জি ঘোষণা করেছেন পদ্মাবতী আর কোনো রাজ্যের সিনেমা হলে মুক্তি না পাক, কলকাতায় পাবে।
যখন মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, বিহারের মন্ত্রীরা উগ্র দক্ষিণপন্থি হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের পাশে দাঁড়িয়ে পদ্মাবতীকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে, তখন মমতা রুখে দাঁড়িয়েছেন, শিল্পীর মতপ্রকাশের পক্ষে একাই আকাশ-সমান উদারতা দেখিয়েছেন। এই হচ্ছে ভারতবর্ষের চিত্র। কেউ মুসলিম মৌলবাদীদের তোষণ করে, কেউ হিন্দু মৌলবাদীদের। তোষণ করার উদ্দেশ্য ভোট পাওয়া, ভোট পাওয়া এবং ভোট পাওয়া। ভোটের চিন্তা ছাড়া আর কোনো চিন্তা বেশির ভাগ রাজনীতিকের নেই।
দেশের এবং দশের মঙ্গল-চিন্তা খুব কম রাজনীতিকের মাথায়। ভারতবর্ষের বাইরে থেকে মুসলিমরা এসেছিলেন, হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুঠ করেছিলেন, হিন্দুদের মন্দির ভেঙেছিলেন, সহায়সম্পদ কেড়ে নিয়েছিলেন, হিন্দু রমণীদের ধরে ধরে হারেমে পুরেছিলেন, পুরুষদের হত্যা করেছিলেন, দখল করেছিলেন নানা রাজ্য। বনেছিলেন ভারতবর্ষের সুলতান এবং সম্রাট। বহিরাগত মুসলমানই শতাব্দীর পর শতাব্দী শাসন করেছেন ভারতবর্ষ, যাদের দেশ তাদের থেকেই নিয়েছেন জিজিয়া কর, অর্থাৎ হিন্দুদের দিতে হয়েছে হিন্দু হওয়ার বা মুসলিম না হওয়ার খেসারত।
সেসব ইতিহাস, সেই সুলতানও নেই, সেই মোগলও নেই এখন। কিন্তু মুসলিম মৌলবাদী যেমন ইসলাম কায়েম করতে চায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশগুলোতে, ভারতবর্ষ ঠিক তেমন সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর দেশ, হিন্দু মৌলবাদীরা চায় হিন্দুত্ব কায়েম করতে। তাদের ভয়, এই ভারতটুকুই হিন্দুদের স্থান, এটুকুই হয়তো কেড়ে নেবে দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকা মুসলিম জনসংখ্যা। মুসলিমবিরোধী কট্টর হিন্দুরা তাই চায় না পদ্মাবতী ছবিতে আলাউদ্দিন খিলজির মতো হিন্দুবিরোধী অত্যাচারী সুলতানের প্রতি হিন্দু রানী পদ্মাবতীর সামান্যও দুর্বলতা।
আগুনে নিজেকে পুড়িয়ে সতী নারী মুসলমান পুরুষের লালসার শিকার হওয়ার চেয়ে মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছেন, এই মৃত্যু তাকে মহিমান্বিত করেছে। এই মৃত্যুকে স্বাগত জানাচ্ছে জাত্যাভিমানী রাজপুত স্ত্রী-পুরুষ। আজ যদি সতীদাহ প্রথা টিকে থাকত, সতীদাহ প্রথার শিকার মেয়েদের নিয়েও কট্টরপন্থিরা হয়তো এমনই গৌরব অনুভব করত। তুমি যখন দেশকে বা রাজ্যকে, যেভাবে শপথ করেছ, সেভাবে চালাতে না পার, যদি সবার জন্য স্বাস্থ্য শিক্ষা অন্ন বস্ত্র জোগাতে না পার, সবাইকে মাথা গোঁজার ঠাঁই দিতে না পার, তখন আশ্রয় নেবে রাজনৈতিক মেরুকরণের।
হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ তৈরি করবে। দুই দলের অন্ধগুলো পরস্পরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, মারামারি করে মরবে। আর এতেই যা ফায়দা লোটার লুটে নেবে মহামান্য সরকার এবং অদূরদর্শী রাজনীতিকরা। ছোটখাটো যে কোনো কিছুতেই তারা মেরুকরণ ঘটাতে চায়। হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা ভারতবর্ষ অনেক দেখেছে, লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু দেখেছে। ভারতভাগের সময় দেখেছে ১০ লাখ হিন্দু-মুসলমান পরস্পরকে কী করে কুপিয়ে মেরেছে।
আজও ওই দিনটি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শোকের দিন। রাজনীতিকরা আগেও হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ তৈরি করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতেন, মেরুকরণের ফল সাতচল্লিশের ভারতভাগ। আজও রাজনৈতিক মেরুকরণ চলছে, রাজনীতিকরা ভারতভাগের রক্তক্ষরণ থেকে শিক্ষা কিছু নেননি, দুঃখ এখানেই। যে জাতির অহিংসা শেখার কথা, সে জাতি আজ হিংসের আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র। আর আমরা ভারতবর্ষের শুভানুধ্যায়ীরা, গণতন্ত্রে এবং বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসীরা হতভম্ব দাঁড়িয়ে আছি।
আজ পদ্মাবতীর মুক্তির পক্ষে মুখ খোলা মানে বিপদ ডেকে আনা। রাজস্থানের কোনো একটা পুরনো ফোর্টে কাউকে মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। সঞ্জয় লীলা আর দীপিকার মাথার মূল্য ধার্য হয়েছে। তারা এখন পুলিশি নিরাপত্তা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ভারতে হিন্দু এবং মুসলিম, দুই ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে খুব কম শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী আছেন, খুব কম রাজনীতিক আছেন, প্রতিবাদ করেন। তারা হয় দক্ষিণপন্থি, নয় বামপন্থি। তারা হয় হিন্দু মৌলবাদীদের সমর্থন করেন, নয়তো মুসলিম মৌলবাদীদের।
যারা হিন্দু মৌলবাদীদের সমর্থন করেন, তারা মুসলিম মৌলবাদী দ্বারা আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান। কিন্তু হিন্দু মৌলবাদী দ্বারা আক্রান্ত মানুষের পক্ষে একটি শব্দও উচ্চারণ করেন না। একই রকম যারা মুসলিম মৌলবাদীদের সমর্থন করেন, তারা হিন্দু মৌলবাদী দ্বারা আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান। কিন্তু মুসলিম মৌলবাদী দ্বারা আক্রান্ত মানুষের পক্ষে একটি শব্দও উচ্চারণ করেন না। এই দ্বিচারিতা, অসততা, অসাধুতা শুধু রাজনীতিকদের মধ্যেই?
তা নয়, শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও কিন্তু এসব প্রচণ্ড। শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরাও আজ অসৎ। তারাও সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশায় কোনো একটি রাজনৈতিক ছাতার তলায় আশ্রয় নেন। আজ টালিউড প্রতিবাদ করছে পদ্মাবতীর মুক্তি যারা নিষিদ্ধ করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে। এই প্রতিবাদ অত্যন্ত জরুরি। আমি অবাক হই, শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা কেন সেদিন নিশ্চুপ ছিলেন যেদিন আরও একটি প্রতিবাদ জরুরি ছিল, যেদিন আমার লেখা দুঃসহবাসের সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার যে হয়, সে সবরকম অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। আর রাজনৈতিক ফায়দা লোটার ইচ্ছা থাকলে প্রতিবাদ করার জন্য অন্যায়কেও বেছে নেয় মানুষ। যে অন্যায়ের নিন্দে করলে কিছু ইনাম পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, শুধু সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে লোকেরা, বাকি অন্যায়ের দিকে অন্ধ চোখ তাদের। আমিই বোকা, আমি সব হারাব জেনেও মুসলমানের দেশে মুসলিম মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করি, হিন্দুর দেশে হিন্দু মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই।
অথবা যেখানেই থাকি, যে দেশেই বাস করি, সব মৌলবাদীকেই সমাজ থেকে দূর করার জন্য কলম ধরি। সহিষ্ণু এবং স্বপ্নবান মানুষে সমাজ ভরে উঠুক চাই। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিক এবং বুদ্ধিজীবীদের বলছি না আমার কাছ থেকে শিক্ষা নাও, বলছি মতপ্রকাশের অধিকার সম্পর্কে শিক্ষা নাও গণতন্ত্রের কাছে, যে গণতন্ত্র নিয়ে হামেশাই তোমাদের গর্ব করতে দেখি। বিডি প্রতিদিন
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।
এমটিনিউজ/এসবি