রোকনুজ্জামান পিয়াস: শারীরিক, মানসিক নির্যাতন, লালসার শিকার, কাজ করিয়ে ঠিকমতো বেতন না দেয়া, এমন নানা ধরনের অভিযোগ সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে যাওয়া বাংলাদেশি নারীদের। মাঝে মাঝে তারা নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে যায়। পরে তাদের ধরে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রাখা হয়, সৌদি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ শুউনুল খাদিমাত বা ফিমেল ডিপোর্টেশন সেন্টারে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে তাদের বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। আবার অনেক সময় নির্যাতিত নারীরা আশ্রয় নেন বাংলাদেশ দূতাবাসের সেইফ হোমে।
কোনো নারী কাজ করতে না চাইলে একই প্রক্রিয়ায় তাদেরকেও দেশে ফেরত পাঠানো হয়।
সম্প্রতি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে সেইফ হোমে আশ্রিত এসব বাংলাদেশি নারীকর্মীদের সংখ্যা। ফলে ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে সেইফ হোমগুলো। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে দলে দলে দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে নারীকর্মীদের। অনেক সময় আইনি প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সৌদি আরব থেকে দলে দলে ফিরছেন বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীরা। গত চারদিনে প্রায় ৩০০ নারী দেশে ফিরেছেন। পর্যায়ক্রমে আরো প্রায় শতাধিক নারীকর্মী ফেরত আসবে। ফেরত আসা এই নারীকর্মীরা নানা কারণে গত সেপ্টেম্বর থেকে সে দেশে কাজ পরিত্যাগ করেছেন।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, নারীকর্মী ফেরত আসার এই ঢল শুরু হয়েছে গত ৮ই জানুয়ারি থেকে। এর আগের দিন ৭ই জানুয়ারি নারীকর্মীদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে
জানায়, সৌদি আরবে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের রিয়াদ শ্রম উইং। দূতাবাসের কাউন্সিলর (শ্রম) সারোয়ার আলম স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি সৌদি আরবের শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন শুউনুল খাদিমাত বা ফিমেল ডিপোর্টেশন সেন্টার তাদের অফিস স্থানান্তর করেছে। নতুন এই অফিসে তাদের পূর্ণ প্রস্তুতি না থাকায় গত ২০শে সেপ্টেম্বর থেকে কাজ পরিত্যাগকারী গৃহকর্মীদের আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। ফলে দূতাবাসের সেইফ হাউজে আশ্রয় নেয়া নারী গৃহকর্মীর সংখ্যা ৩৬৯ জনে দাঁড়িয়েছে। এতে সেইফ হাউজের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে। অসহনীয় এই সেইফ হাউজের বিষয়টি নিয়ে রিয়াদের কাউন্সিলর (শ্রম) সারোয়ার আলম সৌদি আরবের শ্রম মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি মিনিস্টারের সঙ্গে গত ৪ঠা জানুয়ারি বৈঠক করেন।
এ সময় তিনি দূতাবাসের সেইফ হাউজে আশ্রিত গৃহকর্মীদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানান। এর প্রেক্ষিতে সৌদি ডেপুটি মিনিস্টার তার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গৃহকর্মীদের বাংলাদেশে প্রত্যাবাসনের সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার নির্দেশ দেন। এরপর থেকে দূতাবাসের শ্রম উইংয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সৌদি শ্রম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একযোগে কাজ শুরু করেন। গত ৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত তারা ৩৩১ জন নারীকর্মীর এক্সিট ভিসা সংগ্রহের কাজ সম্পন্ন করে। পরদিন ৮ই জানুয়ারি থেকে ওইসব গৃহকর্মী ফ্লাইট শিডিউল অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশে ফেরত আসা শুরু করেন। দূতাবাসের ওই চিঠিতি ফেরত আসা কর্মীদের বিমানবন্দরে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেয়ার কথাও বলা হয়।
সূত্র মতে, গতকাল পর্যন্ত সর্বমোট ২৯০ জন নারীকর্মী সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন। গত ৮ই জানুয়ারি সেদেশের স্থানীয় সময় দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে এসভি ৮০৪ নম্বর ফ্লাইটে করে বাংলাদেশি নারীকর্মীদের ৩৫ জনের একটি দল রিয়াদ বিমানবন্দর ত্যাগ করে। একইদিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে তারা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। এরপর থেকে প্রতিদিনই আসছেন নারীকর্মীরা। গত ৯ই জানুয়ারি ফেরত পাঠানো হয় ৩০ নারীকর্মী। পরদিন ১০ই জানুয়ারি ৯৯ জনের একটি নারী কর্মীর দল দেশে পৌঁছায়। গতকাল রাত সাড়ে ৯টার দিকে ফেরত আসেন আরো ১২৭ জন।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, নারীকর্মীদের এই ফেরত আসার এই ধারা চলমান থাকবে। ১০ই জানুয়ারি রাতে ফেরত আসা এক নারীকর্মী জানান, দেশটিতে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে যাওয়ার পর থেকে তার ওপর যৌন নির্যাতন চালানো হয়েছে। তাকে ঠিকমতো খেতে দেয়া হয়নি। এমনকি সৌদি যাওয়ার পর থেকে গত চার মাস ধরে তাকে কোনো বেতনও দেয়া হয়নি। তিনি জানান, তার এই দুর্দশা জানার পর তার স্বামী বিএমইটিতে ফেরত আনার আবেদন করে সংশ্লিষ্ট এজেন্সির বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দিয়েছিলেন।
ওই নারীর স্বামী জানান, তিনি বিএমইটিতে অভিযোগ দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ধরনা দিচ্ছিলেন। তারা আশ্বাস দিলেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছিলেন না। সংশ্লিষ্ট এজেন্সিও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছিলো না। এই অবস্থায় গত ৪ঠা জানুয়ারি মানবজমিন পত্রিকায় আমার স্ত্রীকে নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। এরপরই টনক নড়ে। এর প্রেক্ষিতেই তাকে দ্রুত আনার ব্যবস্থা করে। গত বুধবার রাতে ৯৯ জনের সঙ্গে তাকেও ফেরত আনা হয়েছে।-এমজমিন
এমটি নিউজ/এপি/ডিসি