প্রবাস ডেস্ক : দু'তিনদিন আগেও অনেকের মাঝে যেমন আতঙ্ক ছিল, তা এখন কিছুটা কমেছে বলে জানিয়েছেন মালদ্বীপের রাজধানী মালেতে বসবাসরত বাংলাদেশীরা৷
মালেতে সাত বছর ধরে আছেন মোহাম্মদ উজ্জ্বল ভূঁইয়া৷ তিনি সেখানে একটি হোটেলের ম্যানেজার৷ টেলিফোনে কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে৷ বলছিলেন মালের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে৷
‘‘দেখুন মালের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তার সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতি মেলালে হবে না৷ এখানে খুব একটা মারামারি কাটাকাটি হয় না৷ তাই সেসব নিয়ে ভয় বা আতঙ্কিত হবার কিছু নেই৷''
তবে জানালেন, মালদ্বীপের রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হয়েছে৷
গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে আদালত-সরকার দ্বন্দ্বে ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রটির রাজনীতিতে যে সঙ্কট দেখা দিয়েছে, তা নিয়ে এরই মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা হয়েছে৷
একই দিন ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের একটি প্রতিনিধি দল মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ ইয়ামিনের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও অনুমতি মেলেনি৷
সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে কারাদণ্ড পাওয়া সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহামেদ নাশিদ এবং তার দল মালদিভিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের ১২ এমপিকে গত ১ ফেব্রুয়ারি মুক্তির নির্দেশ দেয় দেশটির সুপ্রিম কোর্ট৷
সুপ্রিম কোর্ট তাদের আটকাদেশকে ‘অসাংবিধানিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত' বলে বর্ণনা করে৷
কিন্তু বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন তাদের মুক্তি দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় দেশটিতে রাজনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত হয়৷
ওই রায়ের পালটা ব্যবস্থা হিসেবে প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন প্রথমে পার্লামেন্ট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেন এবং চার দিন পর দেশে ১৫ দিনের জরুরি অবস্থা জারি করেন৷
জরুরি অবস্থা জারির কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ দুই বিচারক এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আব্দুল গাইয়ুমকে গ্রেফতার করা হয়৷
দুই বিচারক গ্রেফতারের পর সুপ্রিম কোর্টের বাকি তিন বিচারক বিরোধী এমপিদের মুক্তির রায় প্রত্যাহার করে নেন৷
জাতিসংঘ, ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারত দুই বিচারক ও সাবেক প্রেসিডেন্ট গাইয়ুমকে মুক্তি দেয়া এবং জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে৷
কিন্তু ইয়ামিন তাতে কর্ণপাত করেননি৷ এদিকে তার সৎভাই গাইয়ুমকে বৃহস্পতিবার রাতে মাফুশি কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যম৷
বাংলাদেশীদের অবস্থা
উজ্জ্বল ভূঁইয়া জানান, বিরোধী নেতাদের মুক্তির সিদ্ধান্ত হবার পর পরিস্থিতি কিছুটা উদ্বেগজনক হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷
‘‘বিরোধীদের বিক্ষোভ বা সমাবেশ যেসব জায়গায় হচ্ছিল, সেসব জায়গায় যারা কাজ করেন তারা বেশ শঙ্কায় পড়েছিলেন৷''
তিনি জানান, তার মতো অন্যরা যারা এসব জায়গা ছাড়া অন্যান্য জায়গায় কাজ করেন, তাঁরা এ সময়টায় সেসব রাস্তা ব্যবহার করছেন না৷
এ বিষয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকেও সতর্কতা জারি করা হয়েছে৷ নির্দেশ অনুযায়ী, একসঙ্গে কয়েকজন মিলে আড্ডা দেয়া বা মিলিত হওয়া থেকেও বিরত থাকছেন তারা৷
প্রায় ৭০ হাজার বাংলাদেশী মালদ্বীপে থাকেন৷ তাদের অধিকাংশই হোটেল, নির্মাণকাজ, নৌকায় মাছ ধরাসহ বিভিন্ন পেশায় জড়িত৷ ব্যবসাও করছেন কেউ কেউ৷
বাংলাদেশ দূতাবাস বাংলাদেশীদের জন্য গত সপ্তাহে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে৷ সেখানে বাংলাদেশীদের প্রতি নিজেদের কাজকর্ম ছাড়া অপ্রয়োজনে বাইরে ঘোরাফেরা না করার আহ্বান জানানো হয়েছে৷ এছাড়া মিটিং, মিছিলে অংশ নিতেও বারণ করা হয়েছে৷
দূতাবাসের বার্তাবাহক আবু রায়হান জানিয়েছেন, অনেক বাংলাদেশীই টাকার বিনিময়ে মিছিল সমাবেশে অংশ নেন৷
ডয়চে ভেলেকে টেলিফোনে তিনি বলেন, ‘‘তাদের (বাংলাদেশীদের) এ ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷''
এদিকে, ভারতসহ অনেক দেশই তাদের নাগরিকদের মালদ্বীপ থেকে ফিরে আসা ও নতুন করে কেউ যেন দেশটিতে ভ্রমণ বা অন্য কাজে আপাতত না যান, সে বিষয়ে নির্দেশনা জারি করেছে৷ তবে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে সে ধরনের কোনো নির্দেশনা জারি করা হয়নি৷
আবু রায়হান বলেন, ‘‘দেশটিতে সামনে নির্বাচন আসছে৷ তো এ ধরনের পরিস্থিতি সামনেও তৈরি হতে পারে৷ তাই বাংলাদেশিদের সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷''
তিনি জানান, অনেক বাংলাদেশিই প্রতিদিন দূতাবাসে আসেন এমআরপি বা মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট করানোর জন্য৷ তাদের তখন এসব বিষয়ে সতর্ক করা হয়৷
এদিকে, জাতিসঙ্ঘ বলছে যে, মালদ্বীপের পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে৷
গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে আদালত-সরকার দ্বন্দ্বে ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্রটির রাজনীতিতে যে সঙ্কট দেখা দিয়েছে, তা নিয়ে গত বৃহস্পতিবার নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা হয়েছে৷
সেখানে সংস্থাটির সহকারি মহাসচিব মিরোস্লাভ ইয়েঙ্কা বলেন, ‘‘যদিও সহিংস সংঘর্ষের কোনো আলামত এখনো পাওয়া যায়নি, তবে মালদ্বীপের পরিস্থিতি সঙ্কটপূর্ণ এবং এর আরো অবনতি হতে পারে৷ ''
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উদ্বেগ
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মালদ্বীপের পরস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন৷
বৃহস্পতিবার দুই নেতা টেলিফোনে কথা বলার সময় মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানের প্রসঙ্গ চলে আসে৷ তখন তারা দু'জনই বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন৷
হোয়াইট হাউসের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘উভয় নেতাই মালদ্বীপের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন৷ তারা দেশটির গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমুন্নত রাখা এবং আইনের শাসন জারি রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন৷''
মালদ্বীপে ভারতের রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের বলেন যে, দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি ও সাম্প্রতিক গ্রেফতারগুলো নিয়ে ভারত বিব্রত৷
দক্ষিণ এশিয়ার প্রভাবশালী দেশ ভারত মালদ্বীপের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনের সঙ্গে চীনের সখ্যতা ভালো চোখে দেখছে না৷-ডয়চে ভেলে
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস