তসলিমা নাসরিন : দেশের রেডিমেড জামা কাপড়ের দোকানে দেখছি ম্যানেকুইনের শরীরে পোশাক টাঙানো। ছেলের পরনে শার্ট প্যান্ট টাই, অথবা পাজামা পাঞ্জাবি। মেয়ের পরনে বোরখার মতো দেখতে লম্বা পোশাক, হিজাবে মাথা ঢাকা। আধুনিক পুরুষের পোশাকে পরিবর্তন নেই, আধুনিক মেয়েদের পোশাক সম্পূর্ণই পালটে গেছে।
শাড়ির ওপর বা সালোয়ার কামিজের ওপর রং মিলিয়ে হিজাব পরছে মেয়েরা। কেউ কেউ আবার গাউন চাপাচ্ছে সবকিছুর ওপর। বোরখার বিকল্প সেসব গাউন। শাড়ি পরলে ফুল হাতার ব্লাউজ পরছে। বাংলাদেশের মতো গরমের দেশে এই পোশাক মেয়েরা পরছে কী করে? কী তাদের প্রেরণা দিচ্ছে বা কে তাদের বাধ্য করছে এই পোশাক পরতে, এই পোশাক এলোই বা কোত্থেকে—এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা অনেকেই জানি।
পোশাক, খাবার, শিল্প, সংস্কৃতি এসব একেক অঞ্চলে একেক রকম। এককালে ধর্ম প্রচারকরা বাংলার হিন্দু জনগোষ্ঠীর একাংশকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। আমাদের পূর্ব পুরুষ আরব দেশের ধর্ম গ্রহণ করেছিল, সংস্কৃতি গ্রহণ করেনি। হাজার বছর বাংলার মানুষ নিজ ভূমির সংস্কৃতি নিয়েই ছিল সন্তুষ্ট। পোশাকের বিবর্তন ঘটেছে, যেমন ঘটে সব কিছুরই বিবর্তন। একসময় এই অঞ্চলের মেয়েরা শরীরের উপরের অংশে কোনো কাপড় পরত না।
পরে পরতে শুরু করেছে একপ্রস্থ কাপড়, যা শরীরের নিচের এবং উপরের অংশ দুই-ই ঢাকত। ওই কাপড়টিই ধীরে ধীরে শাড়ি নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। তখন মেয়েরা ব্লাউজ পরত না শাড়ির সঙ্গে। ব্লাউজ পেটিকোট এসেছে অনেক পরে। আমাদের আধুনিক শাড়ি পরায় অবদান রবীন্দ্রনাথের বড় বৌদি সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর। ব্লাউজ পেটিকোট দুটোই কিন্তু ইংরেজি শব্দ। তখন ইংরেজ শাসন চলছে ভারতবর্ষে।
রানী ভিক্টোরিয়ার রক্ষণশীলতায় ইংল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডের কলোনিগুলো আক্রান্ত। ইংরেজ মেয়েদের মতো রক্ষণশীল পোশাক পরতে শুরু করে দিল বাংলার মেয়েরা। আমরা জন্মে পেয়েছি ব্লাউজ পেটিকোটসহ শাড়ি। আমাদের পূর্ব-নারীদের ছোট পোশাক সরে গিয়ে ধীরে ধীরে যে রক্ষণশীল পোশাক এসেছে, তা কেন এখন শত বছর পর হঠাৎ করে অশালীন হয়ে উঠল? কেন বাড়তি কাপড়ের প্রয়োজন পড়ছে হঠাৎ?
স্বতঃস্ফূর্তভাবেই পোশাকের পরিবর্তন ঘটে। আজকাল অনেক কর্মজীবী মেয়ে শাড়ি পরে বাসে ট্রেনে চাপতে, দৌড়ে এদিক-ওদিক যেতে অসুবিধা বোধ করে বলে জিন্স শার্ট পরছে, অথবা সালোয়ার কামিজ পরছে। শাড়ি কমে যাচ্ছে। শহরে শাড়ি পরতে দেখি গ্রাম থেকে আসা গরিব মহিলাদের, বৃদ্ধাদের, অথবা বিয়ে বা কোনো জমকালো অনুষ্ঠানে সব-বয়সী রমণীদের। শাড়িও, আমার ভয় হয়, বিলুপ্ত হবে একদিন। কিছু মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছি, কেন শাড়ি পরো না।
ওদের উত্তর, একেবারেই প্র্যাক্টিক্যাল নয়, কোথায় একটু টান লাগলে শাড়ি খুলে পড়ে, দৌড়ে বাস ধরা যায় না, শাড়ি পরতেও সময়ের দরকার, তাড়া থাকলে ঝটপট সালোয়ার বা জিন্স পরে নেওয়া যায়। যত মেয়েরা ঘরের বার হচ্ছে, চাকরি বাকরি ব্যবসা বাণিজ্যে যোগ দিচ্ছে, তত পোশাক পাল্টাচ্ছে। চলাফেরার সুবিধের জন্য এই পরিবর্তন। কিন্তু হিজাব বা বোরখা কি কোনোরকম সুবিধে দেয় মেয়েদের?
আরব দেশের মানুষ বালির ঝড় আর লু হাওয়া থেকে বাঁচতে একধরনের কাপড় পরে, সেটি আমাদের দেশের মানুষের পরার কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু তারপরও মানুষ অনুকরণ করছে আরব দেশের মানুষদের। আরবের লোকেরা কি সবাই খুব নীতিবান, খুব চরিত্রবান, খুব আদর্শবান, সবাই খুব জ্ঞানের ভাণ্ডার যে, তাদের ভালোবেসে তাদের পোশাক পরছে বাঙালিরা? এই প্রশ্নের উত্তর হলো, যেহেতু ওই দেশে ইসলামের জন্ম হয়েছে, তাই ওই দেশ পবিত্র, ওই দেশের মানুষের পোশাকও পবিত্র, তাই পবিত্র পোশাক গায়ে চাপালে পুণ্য হবে।
তা ছাড়া কোরান হাদিসেও মেয়েদের শরীর ঢেকে রাখার জন্য উপদেশ দেওয়া হয়েছে। আসলে ধর্মগ্রন্থে যা বলা হয়েছে, তা হলো মেয়েদের সৌন্দর্য যেন প্রকাশ না করে মেয়েরা। সৌন্দর্য প্রকাশ কেন করবে না সেটি বড় প্রশ্ন। নারী ও পুরুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি এই, তারা পরস্পরকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে, এবং আকৃষ্ট হলে নারী পুরুষের মিলন হয়, শিশুর জন্ম হয়, যার ফলস্বরূপ টিকে থাকে মানব প্রজাতি। স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে দাবিয়ে রাখা মুশকিল। সে কারণেই হিজাবে এবং বোরখায় সেক্স অ্যাপিল আনার চেষ্টা চলছে।
বোরখার মতো কোনো একটা পোশাককে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেন গায়ের সঙ্গে লেগে থাকে। যেন শরীরের মাপগুলো সহজে অনুমান করা যায়। হিজাবেও বৈচিত্র্য আনা হয়েছে। সবই কিন্তু অন্যকে আকৃষ্ট করার জন্য। সুতরাং ধর্মের যে উপদেশ, তোমাকে দেখে পুরুষেরা যেন আকৃষ্ট না হয়, সেটি সম্পূর্ণ বিফলে যাচ্ছে। দেখা যায়, জিন্স টপ পরা মেয়েরা যত না মুখ সাজায়, তার চেয়ে বেশি সাজায় হিজাবি বা বোরখা পরা তরুণীরা।
যত না অলংকার পরে জিন্স পরা মেয়েরা, তার চেয়ে বেশি পরে হিজাবি মেয়েরা। সৌন্দর্য প্রকাশ করতে হিজাবি মেয়েদের জুড়ি নেই। ধর্মের উপদেশ তারা মানছে বলে অনেকে মনে করছে, কিন্তু আসলে তারা তা মানছে না। হিজাবি মেয়েদের দেখে ঠিকই আকৃষ্ট হচ্ছে পুরুষেরা। তাহলে হিজাব পরার মূল যে উদ্দেশ্য, সেটিই বিফলে গেল। হিজাবি মেয়েরাও যে ধর্ষিতা হয়, তা তো আমরা দেখছিই।
সমাজ পাল্টেছে। শরীরের সৌন্দর্যই মেয়েদের একমাত্র সৌন্দর্য বলে পুরুষেরা বিবেচনা করে না। মেয়েদের বুদ্ধিমত্তা দেখে, দক্ষতা দেখে, আচার ব্যবহার দেখে পুরুষেরা আকৃষ্ট হয়। তাহলে কি মেয়েদের বুদ্ধিমত্তা, দক্ষতা ইত্যাদিকেও লুকিয়ে রাখতে হবে? পুরুষেরা যদি মেয়েদের যৌন নির্যাতন করে, সে পুরুষের দোষ, সে দোষের জন্য আরব দেশে এককালে শাস্তির ব্যবস্থা না থাকলেও আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এখন শাস্তির ব্যবস্থা বেশ ভালোই আছে। ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড শুধু নয়, ফাঁসি পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে।
পুরুষ অপরাধ করবে, সে কারণে অন্য সংস্কৃতির, অন্য দেশের পোশাক মেয়েদের গায়ে চাপানোর কোনো যুক্তি নেই। পুরুষের অপরাধের শাস্তি পুরুষ পাবে। পুরুষকে সংযত হতে হবে, পুরুষের অন্যায় আচরণ পুরুষকেই সংবরণ করতে হবে। পুরুষকে ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা না দিয়ে মেয়েরা শরীর ঢেকে ফেলছে বাড়তি কাপড়ে, চুল ঢেকে ফেলছে, যেন চুলই অঘটন ঘটার জন্য দায়ী, যেন চুলেই আছে সর্বাধিক যৌন আবেদন। যেন চুল দেখেই পুরুষেরা উত্তেজিত হয়।
মেয়েরা যখন হিজাব বা বোরখা পরে পর-পুরুষের যৌন হেনস্থা থেকে নিজেকে বাঁচাতে, তখন মনে হয় সমাজের পুরুষেরা সবাই বোধহয় যৌন নির্যাতক, সবাই বোধ হয় ধর্ষক। কিন্তু তা তো নয়। মেয়েদের হিজাব আর বোরখা কতটা মেয়েদের সম্মানিত করে জানি না, তবে পুরুষদের বড় অসম্মানিত করে। আসলে, পুরুষেরা শিক্ষিত না হলে, নারীর অধিকারকে সম্মান না করলে মেয়েরা হিজাব পরুক বা না পরুক যৌন হেনস্থা করবেই।
আর পুরুষেরা যখন নারীকে সমমানুষ হিসেবে দেখতে শেখে, সহযাত্রী হিসেবে দেখে, কেবলই যৌনবস্তু হিসেবে না দেখে—নারীরা উলঙ্গ ঘোরাঘুরি করলেও কেউ তাদের এতটুকু অসম্মান করে না, তাদের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায় না, তাদের স্পর্শ করার চেষ্টা করে না। হিজাব আর বোরখায় মেয়েদের যেন ঢেকে ফেলা না হয়। অঞ্চলের আবহাওয়া আর সংস্কৃতির জন্য স্বাভাবিক পোশাকই নারী পুরুষ সবার পরা উচিত।
আসল কথা হলো, ধর্ম হিজাবে বা বোরখায় থাকে না। থাকে অন্তরে। ধর্ম যদি ভালো, তাহলে তোমার অন্তর কর ভালো। কাপড়ের টুকরো দিয়ে সর্বশক্তিমানকে খুশি করা সম্ভব হলে সব অত্যাচারী, নির্যাতনকারী, নির্মম, নিষ্ঠুর মানুষও শুধু কাপড়ের টুকরো পরে তাকে খুশি করে ফেলতে পারত। কিন্তু তাঁকে তো ধোঁকা দেওয়া সম্ভব নয়। - বিডি প্রতিদিন
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।
এমটিনিউজ/এসবি