তসলিমা নাসরিন: বাংলাদেশে মাঝে মাঝেই অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটে। পার্ক থেকে, হোটেল থেকে তরুণ তরুণীকে ধরে থানায় নিয়ে আসা হয়, জঘন্য অপমান করা হয়, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়, জরিমানা করা হয়, মারধরও করা হয়, মামলায় ফাঁসানো হয়। কাল খবরে দেখলাম, গাজীপুরের আবাসিক হোটেল থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছে বেশকিছু তরুণ তরুণীকে। তারা নাকি অসামাজিক কাজে লিপ্ত ছিল। অসামাজিক কাজ বলতে বোঝানো হয়েছে প্রেম এবং সেক্স। আমার প্রশ্ন, তারা তো প্রেম বা সেক্স করতে কারও ওপর জোর খাটাচ্ছে না, তারা ধর্ষণ করছে না, তাহলে তাদের কেন অপরাধী হিসেবে বিচার করা হচ্ছে? খুনি বা ধর্ষক বা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যে ব্যবহার করা হয়, প্রেমিকদের সঙ্গে সেরকমই ব্যবহার করা হয়।
প্রেমিকাদের সঙ্গেও এমন ব্যবহার করা হয়, যেন এরা ‘নষ্ট’ মেয়ে। কারণ তাদের ধারণায় নষ্ট মেয়ে ছাড়া লুকিয়ে কেউ প্রেমিকের সঙ্গে প্রেম করতে বা হোটেলে গিয়ে সেক্স করতে যায় না। মেয়েরাও বোরখা পরা, হিজাব পরা, কেউ লজ্জায় মুখ তুলতে পারে না। এদের শুধু নষ্ট নয়, পতিতা বলেও ধিক্কার দেওয়া হয়। ওদের মধ্যে কেউ যদি পতিতা হয়েও থাকে, তাহলেই বা তা অন্যায় হবে কেন। পতিতার ওপর জোর তো করছে না কেউ, পতিতাকে চুক্তির টাকা পয়সা না দিয়ে ঠকাচ্ছে না তো কেউ। কোনও মেয়েই এরকম কোনও অভিযোগ করেনি। প্রত্যেককে দেখে এ-ই মনে হয়েছে, যদি তাদের শারীরিক সম্পর্ক হয়েই থাকে, হয়েছে তাদের ইচ্ছেয়।
কোনও পুরুষ এই বলেও অভিযোগ করেনি যে তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। তাদের তবে ধরে নিয়ে আসা হলো কেন? তারা কি চুরি ডাকাতি করে পার্কে বা হোটেলে লুকিয়ে ছিল? তারা কি খুন করে এসে গা ঢাকা দিয়েছিল? না, কেউ ওসবের কিছুই করেনি। তবে কেন তারা আজ জেলে? কী অপরাধ তারা করেছে? উত্তর খুব সহজ, প্রেম করেছে, সম্ভবত সেক্সও করেছে। প্রেম এবং সেক্স একটি জাতির চোখে অপরাধ, অসামাজিক কর্ম। কিন্তু সত্য হলো, প্রেম এবং সেক্স মানুষের এবং সকল প্রাণীর জীবনে অত্যন্ত স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিক কাজকে অস্বাভাবিক এবং অসামাজিক হিসেবে দেখাই অপরাধ। পুলিশের লোকেরা অত্যন্ত অন্যায় করেন এভাবে মানুষকে হেনস্থা করে। যদি তরুণ তরুণীরা প্রেম-ভালোবাসা থেকে পুলিশের ভয়ে বিরত থাকে, তাহলে কি যে সমাজ গড়ে উঠবে সেই সমাজকে সুস্থ বলা যাবে? শুনেছি পুলিশকে ঘুষ দিয়ে তবেই অনেক সময় প্রেমিক প্রেমিকাকে পার্কে বসতে হয়।
‘স্বাভাবিক’-এর নাম যে সমাজে ‘অসামাজিক’, তবে সেই সমাজ নিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ আর আশঙ্কা হয়। যে সমাজে খুন ধর্ষণ নিত্যদিনের ব্যাপার, যে সমাজে বধূ হত্যা প্রতিদিন ঘটছে, যে সমাজে নারীরা গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হচ্ছে, যে সমাজে লজ্জায় অপমানে মেয়েরা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে, সেই সমাজে আমি তো দেখি না পুলিশ দুটো মেয়েকে স্বামীর নির্যাতন থেকে উদ্ধার করেছে, কোনও মেয়েকে ধর্ষণ থেকে উদ্ধার করেছে! একটি প্রচ- নারীবিদ্বেষী সমাজে পুরুষেরা নারীকে ভালোবাসছে, তাদের সঙ্গে গাছের তলায়, পার্কের বেঞ্চে, হোটেলের ঘরে নিভৃতে প্রেম করছে... এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কী হতে পারে? যদি প্রশ্ন করা হয় তারা বিয়ে করেনি, তারা একসঙ্গে চলাফেরা করবে কেন? বিয়ে না করে মেলামেশা করা কি আইনের চোখে অপরাধ? যদি এমন আইন থাকেও, সেই আইন বিলুপ্ত হওয়া উচিত। নারী পুরুষের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ, অথবা নারীর নারীর প্রতি, পুরুষের পুরুষের প্রতি আকর্ষণ অতি স্বাভাবিক, অতি প্রাকৃতিক। এগুলোকে তুচ্ছ করে, পরিবার যাকে পছন্দ করে রেখেছে, নিজের পছন্দ বিসর্জন দিয়ে যদি তার সঙ্গেই গাঁটছড়া বাঁধতে হয়, তাহলে সেটিই বরং অস্বাভাবিক।
মানি বা না মানি, সত্য এই, নারী বা পুরুষ অন্যের পছন্দ করা পাত্র বা পাত্রীকে সারা জীবনের সঙ্গী করতে বাধ্য হয়। অনেকে সারা জীবন অশান্তি আর অতৃপ্তিতে ভোগে। অবশ্য পরিবার থেকে পছন্দ করা সঙ্গী নিয়ে শুধু নয়, নিজে পছন্দ করা সঙ্গী নিয়েও সমস্যা হতে পারে। তালাকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। একথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, শিক্ষিত-সচেতন নারীর সংখ্যা যত বাড়বে, তালাকের সংখ্যা তত বাড়বে। এও খুব স্বাভাবিক। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বড় হওয়া পুরুষেরা নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাস করে না। তাই তারা সহযাত্রী চায় না, দাসী চায়। একটি আত্মবিশ্বাসী মেয়ে, যে নিজেকে সম্মান করতে শিখেছে, কখনও পুরুষের দাসী হতে চাইবে না।
বিশ্বে এখন সেক্স রোবট আসছে। সেক্স রোবটগুলো পুরুষের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। সচেতন নারী যারা দাসী হতে চায় না, তাদের প্রতি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পুরুষ আগ্রহ হারাচ্ছে। তারা বরং রক্ত মাংসের নারী নয়, তারা সেক্স রোবট চায়। পৃথিবীর অনেক দেশেই সেক্স রোবটের কারখানা চালু হয়ে গেছে। সেক্স রোবটগুলো শুধু পুতুল নয়, ওদের অতি রূপসী রমণীর মতো দেখতে, নারীর ত্বকের মতোই তাদের কোমল ত্বক, কথাও বলে চমৎকার। পুরুষ কথা বলা সেক্স রোবট দাবি করেছে, কথা বলা সেক্স রোবট বানানো হয়েছে। পুরুষেরা রোবটের চোখে মুখে ইমোশন দেখতে চেয়েছে, সেও বানানো হয়েছে। এখন পুরুষেরা চায় বুদ্ধিমতী সেক্স রোবট, যেন তারা তাদের সংগে আলাপ আলোচনা করতে পারে। সেক্স রোবটের ভিতর আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজ চলছে।
কারখানাগুলোতে এরকম শত শত রোবট বানানো হচ্ছে। সমাজবিদরা বলছেন, ভবিষ্যতে রক্ত মাংসের নারীর পরিবর্তে সেক্স রোবট নিয়েই সুখী জীবনযাপন করবে পুরুষেরা, বিশেষ করে যে পুরুষেরা নারীকে কন্ট্রোল করতে চায়, যে পুরুষেরা সাবমিসিভ নারী চায়। কেউ কেউ বলছেন, সেক্স রোবট নারীর বিকল্প, নারীকে রিপেস্ন্লস করা নয়। পুরুষের জন্য সেক্স রোবট হচ্ছে, নারীর জন্য কি সেই পরিমাণে সেক্স রোবট তৈরি হচ্ছে? খুব স্বাভাবিক উত্তর, না। নারী তার পুরুষ সংগীকে যৌন-দাস হিসেবে দেখতে চায় না, সম্ভবত সে কারণেই।
বেশ কয়েক মাস আগে দেখেছি এক ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল কোর্ট বসিয়ে পার্কের প্রেমিক প্রেমিকাদের শায়েস্তা করছেন। প্রেম করা অন্যায়। ছেলে মেয়েদের কাছ থেকে পাঁচশ টাকা করে জরিমানা নিয়েছেন। তাদের অভিভাবককে ফোন করে অভিযোগ করেছেন। যতভাবে প্রেমিক প্রেমিকাকে মানসিক নির্যাতন করা সম্ভব, করেছেন। দেখে শিউরে উঠেছি। কতটুকু অশিক্ষিত হলে মানুষ এমন নিকৃষ্ট হতে পারে। এসব পুলিশ আর ম্যাজিস্ট্রেটের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে সরকারকে সরব হতে হবে। তাদের কোনও অধিকার নেই নিরপরাধ মানুষকে নির্যাতন করার। তারা জানে না একটি সু সমাজে কোন কর্মটি অন্যায়, কোন কর্মটি নয়। আমাদের সমাজ অস্বাভাবিকতা আর অনৈতিকতার অন্ধকারে ডুবে আছে, একে বাঁচানোর দায়িত্ব সুস্থ শিক্ষিত সচেতন মানুষদের।
নীতির যে সংজ্ঞা প্রচলিত, সেটি বদলানো অত্যন্ত জরুরি। বিবাহবহির্ভূত প্রেম বা সেক্স অনৈতিক নয়। অনৈতিক হলো, মেয়েদের দাসী হিসেবে দেখা, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে দেখা, যৌন সামগ্রী হিসেবে দেখা; অনৈতিক হলো, মেয়েদের যৌন হেনস্থা করা, মেয়ে বলে মেয়েদের অবজ্ঞা করা, অপমান করা, তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ভাবা, তাদের একটু কম-মানুষ ভাবা। সমাজের এইসব প্রচলিত রীতি আর নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার দায়িত্ব নারী পুরুষ উভয়ের।
সময় বদলাচ্ছে। একসময় হয়তো বিয়ে বলতে কিছু থাকবে না। যার যাকে পছন্দ, তাকে নিয়েই একত্র বাস করবে। ভালোবাসা একটি সংসারের মূল জীবনীশক্তি। বিয়ের ডকুমেন্ট নয়। বিয়েকে যতই লোকে পবিত্র ভাবুক, স্বর্গে বসে ঈশ্বর জুটি বানিয়ে রেখেছেন বলুক, বিয়ে কিন্তু ভাঙছে। ভালোবাসা না থাকলেই ভাঙছে। সুতরাং সংসারে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসের প্রয়োজন, তার নাম প্রেম, ভালোবাসা। কত যুগ ধরে বলছি, প্রভু দাসীতে প্রেম হয় না, প্রেম হতে হলে এমন কাউকে চাই, যে বিদ্যায় বুদ্ধিতে, বিশ্বাসে বৈচিত্র্যে, সচেতনতায়, স্বনির্ভরতায় সমান অথবা কাছাকাছি।
যে ছেলেরা পার্কে বা হোটেলে প্রেম করছিল তাদের ধরে বেঁধে চোর ডাকাতের সংগে যে ব্যবহার করা সেই ব্যবহার করা যেন আজ থেকে বন্ধ হয়। আমরা খুনি পুরুষ চাই না, ধর্ষক পুরুষ চাই না, আমরা চাই প্রেমিক পুরুষ। পুলিশ এবং ম্যাজিস্ট্রেটের অভিযোগ করেছেন, পার্কের বা হোটেলের ছেলেগুলো তাদের প্রেমিকাদের শেষ অবধি বিয়ে করবে না। তাহলে কি আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, পরিণতি বিয়ে হলেই সে প্রেম মানবো, তা না হলে মানবো না? প্রেম করতে বা সেক্স করতে যদি তরুণ তরুণী রাজি হয়, এবং তারা যদি শিশু না হয়, ১৮ বছর বয়স যদি তাদের হয়, তবে কারও অধিকার নেই তাদের অভিভাবক সাজার।
এমনকী তাদের বাবা মারও তাদের ওপর ছড়ি ঘোরাবার অধিকার নেই। তারা প্রাপ্তবয়স্ক, তাদের জীবনের সিদ্ধান্ত তারাই নেবে। তারা যদি কারও অসুবিধে না করে, কারও ক্ষতি না করে, যা করার পরস্পরের সম্মতিতে করে, তাহলে তাদের বাধা দেওয়ার অধিকার কারোর নেই। কোনও পুলিশ, কোনও ম্যাজিস্ট্রেট, কোনও সরকারের নেই। আবারও বলছি, এই সমাজে আমরা সেই পুরুষ চাই, যে পুরুষ ভালোবাসে। এই নিষ্ঠুর, নির্মম, দুর্নীতিগ্রস্ত বর্বর মানুষের ভিড়ে ঘৃণা নয়, বিদ্বেষ নয়, যা প্রয়োজন, তার নাম ভালোবাসা।বিডি প্রতিদিন
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।