প্রবাস ডেস্ক: যা সমাজে আছে, তা সামাজিক নেটওয়ার্কে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। সমাজের মানুষ অন্তর্জালে ধরা পড়েছে। সমাজের মানুষের যে মানসিকতা, সেই একই মানসিকতা আমরা অন্তর্জালের মানুষের মধ্যে দেখি। তবে, একটু বেশিই দেখি। কারণ অনেকে আড়ালে থেকে নিজের মত প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
যে মেয়েটির বা ছেলেটির ইচ্ছে হয় কবিতা লিখতে, আশেপাশের মানুষকে যে কথা সে জানাতে লজ্জা বোধ করে, সে কথা সে একঝাঁক অচেনা মানুষের হাটে হুট করে জানিয়ে দেয়, নিজেকে আড়ালে রেখে জানিয়ে দেয়, যাদের জানায় তারাও আড়ালে, সে জন্য জানাতে সে সংকোচ বোধ করে না। অথবা মানুষ যেন দেখে, যেন শোনে, কোনও একদিন নিজে একটি গান গেয়ে ফেলে।
অনলাইনে প্রতিভার স্ফুরণ দেখি। প্রতিভার ওপর আক্রমণও দেখি। যা সবচেয়ে বেশি দেখি, তা হলো মেয়েদের যেভাবে হেনস্তা করে পুরুষেরা, যেভাবে গালিগালাজ করে, যে নোংরাভাবে প্রকাশ করে তাদের নারীবিদ্বেষ, যে উৎকটভাবে ছুড়ে দেয় ঘৃণা, যে জঘন্যভাবে নারীকে অপমান করে, যে কুৎসিতভাবে নারীকে মানসিক নির্যাতন করে।
পুরুষেরা যে ভাষায় নারীকে অপদস্ত করে, হেনস্তা করে, সেই ভাষার উল্লেখ এখানে করা যাবে না, সেই বাক্যগুলো উদ্ধৃত করাও যাবে না, কারণ সেই ভাষাটি এতই কুৎসিত, সেই বাক্যগুলো এতই অকথ্য এবং অসভ্য এবং অশ্লীল যে এই পত্রিকার সম্পাদক তা ছাপার অযোগ্য বলে বিবেচনা করবেন। পাঠক নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন, নারীকে ছোট করতে, কলুষিত করতে, নিচু করতে, বিপর্যস্ত করতে পুরুষেরা কী ভাষা ব্যবহার করে।
অনলাইনে, বিশেষ করে ফেসবুকে, টুইটারে, আমাকে খুব নোংরা ভাষায় আক্রমণ করা হয়। আশি-নব্বইয়ের দশকে আমার ওপর যে আক্রমণ হতো, তা হতো পত্রিকায়, ম্যাগাজিনে, মেলায়, উৎসবে। অধিকাংশ নিন্দুক, হিংসুক, নারীবিদ্বেষী আমার নাগাল পেতো না। তারা এখন আমার নাগাল পেয়ে যায় সহজেই। আমি এখন তাদের এক ক্লিক দূরত্বে। যত ঘৃণা আছে তাই উগরে দিচ্ছে, যত হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা আছে, উগরে দিচ্ছে। দিয়ে শান্তি পাচ্ছে।
টুইটারে এবং ফেসবুকে এই গালিবাজ নারীবিদ্বেষীদের টাইমলাইনে গিয়ে দেখেছি তারা সবাই ভদ্রলোক হিসেবে সমাজে পরিচিত, স্ত্রী সন্তান পরিবার পরিজন নিয়ে অতি সুন্দর সুষ্ঠু সামাজিক জীবনযাপন করে, ভালো চাকরি বাকরি ব্যবসা বাণিজ্য করে, প্রবলভাবে ধর্ম বিশ্বাসী এবং প্রবলভাবে পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসী। এই লোকগুলো সমাজের রীতিনীতির সঙ্গে চমৎকার খাপ খাইয়ে চলে। আমাকে অন্যায়ভাবে অশ্লীলভাবে গালিগালাজ করার জন্য তাদের কোথাও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় না।
তাদের নারীবিদ্বেষকে অত্যন্ত যৌক্তিক বলে বিবেচনা করা হয়। আমি না হয় আমার তরুণ বয়স থেকেই নারীবিদ্বেষী পুরুষদের অশ্লীলতার আগুনে পুড়ে অঙ্গার না হয়ে ইস্পাত হয়েছি, কিন্তু সব নারীর পক্ষেই তো এমন আঘাত সামলে ওঠা সম্ভব নয়। আমার ফেসবুকের ইনবক্সে ‘শিক্ষিত সচেতন’ ভদ্রলোক বলে পরিচিত, ধার্মিক সজ্জন বলে পরিচিত পুরুষেরা পুরুষাঙ্গের অসংখ্য ছবি, নারী পুরুষের সংগমরত ছবি, নারীর নগ্ন শরীরের ছবি, মূলত পর্নোগ্রাফি পাঠিয়ে পাঠিয়ে আমাকে কী করে তারা ধর্ষণ করবে, তাই লেখে, প্রতিদিন লেখে।
তারা সকলেই আমার অচেনা। তারা পড়েছে অথবা শুনেছে আমি নারীর সমানাধিকার চাই, তাই তাদের রাগ, তারা পড়েছে অথবা শুনেছে আমি মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী, আমি যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক। সে কারণে, শাস্তিস্বরূপ, তারা আমাকে ধর্ষণ করতে চায়, শুধু তাই নয়, কুকুর দিয়ে ধর্ষণ করাতে চায়। আমি ভেবেছিলাম আমার ওপর যেহেতু মৌলবাদী নারীবিদ্বেষীদের রাগ বহু পুরোনো, সে কারণে আমাকে এভাবে হেনস্তা করছে এরা।
কিন্তু অবাক হয়ে যাই যখন শুনি ইনবক্সে পুরুষেরা এভাবে পর্নোগ্রাফি পোস্ট করে ধর্ষণ করার ইচ্ছে প্রকাশ করে সব মেয়েদের, ফেসবুকে নতুন আসা কিশোরীদেরও ছাড় দেয় না। ওই কিশোরীদের কী দোষ? দোষ এই, ওরা হয়তো নিজের কোনও মত প্রকাশ করেছে তা ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী, বা পিতৃতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী সঠিক নয়। অথবা কিশোরীরা শুধু কিশোরী বলেই, নারী বলেই, হেনস্তা করা হয়।
আমি হলফ করে বলতে পারি, সামাজিক নেটওয়ার্কে আসা কোনও মেয়েই, সে শিশু হোক, কিশোরী হোক, তরুণী হোক, যুবতী হোক, বৃদ্ধা হোক- কেউ অশ্লীলতা, অসভ্যতা, নোংরামি, ইতরামি, মানসিক অত্যাচার-নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি। মেয়েদের আঘাত না করে পুরুষের যেন শান্তি নেই। এই অভিযোগ করলে পুরুষেরা সমস্বরে চিৎকার করে, তাদের দাবি, সব পুরুষ নারীকে হেনস্তা, নির্যাতন, ধর্ষণ ইত্যাদি করে না, পুরুষ মাত্রই নারীকে সম্মান করে, যারা অসম্মান করে তারা পুরুষ নয়।
কথাটা কি সত্যি? যারা নারীকে অসম্মান করে, যৌন নির্যাতন করে, তারা পুরুষ নয়? তারা তাহলে কী? সত্যি কথা হলো, তারাও পুরুষ। চেহারা দেখে আমাদের উপায় নেই বোঝার কোন পুরুষ ধর্ষণ করবে, কোন পুরুষ করবে না। কথা শুনে, ব্যবহার দেখে, প্রোফাইল পড়েও আমাদের বোঝার উপায় নেই কে ভালো, কে ভালো নয়। সকলেই মুখোশ পরে থাকে।
কোন পুরুষ খুন করবে, কোন পুরুষ করবে না, তা কেউ হলফ করে বলতে পারে? সুখে ঘর সংসার করা বড় অফিসার-পুরুষদের দেখি স্ত্রীকে কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে রেফ্রিজারেটরে রেখে দিয়েছে। এটা ঠিক, সব পুরুষ বর্বরতা করে না। কিন্তু সব পুরুষই কিন্তু বর্বরতা করার ক্ষমতা রাখে। এই ক্ষমতা পুরুষতন্ত্র তাদের দিয়েছে। পুরুষেরা জানে তারা চাইলে বর্বরতা করতেই পারে, এতে কেউ তাদের একঘরে করবে না। তাদের অনেকে কী কারণে বর্বরতা করছে না, সেটার হয়তো কোনও কারণ আছে, কিন্তু খুব কম কারণই, নারীকে মানুষ হিসেবে গণ্য করার কারণ।
সমাজে একটি মেয়েকে যত হেনস্তা হতে হয়, অনলাইনে তার চেয়ে বেশি হতে হয়। অনলাইনে একটি মেয়ে শত লোক দ্বারা সহস্রবার ধর্ষিত হয়। এই ধর্ষণের কারণে একটি মেয়ে স্বস্তিতে তার কাজ করতে পারে না, লেখাপড়ায় মন বসাতে পারে না, তার গা ঘিন ঘিন করে, তার আত্মবিশ্বাস কমে শূন্যের কোঠায় দাঁড়িয়ে যায়।
কোনও কোনও মেয়ে লজ্জায় অপমানে আত্মহত্যা করে। অনলাইনের জীবনও বাস্তব জীবন। কারণ অনলাইনে যাদের সংগে দেখা হচ্ছে, বা কথা হচ্ছে, তারাও বাস্তবের রক্ত-মাংসের মানুষ। সে কারণে অনলাইনের জীবনকে তুচ্ছ করার কোনও উপায় নেই।
আমি আমার ফেসবুক পোস্টে মন্তব্য করার অধিকার শুধু বন্ধু তালিকায় থাকা মানুষদের দিয়েছি। মাঝে মাঝে যখনই দুয়ার খুলে দিই, মন্তব্য করার অধিকার জনগণকে নির্বিচারে দিয়ে দিই… তখনই পুরুষের অশ্লীলতার বাঁধ ভেঙে যায়। মন্তব্যের পাতা উপচে পড়ে অশ্রাব্য গালিতে। ওইসব গালি পড়ে, এত দীর্ঘকাল পুরুষের অশ্লীলতা দেখে অভ্যস্ত আমিই মুষড়ে পড়ি, তাহলে কিশোরী তরুণী অথবা অনভ্যস্ত নারীদের মানসিক অবস্থার কী হয়, ভেবে শিউরে উঠি।
একটা ভালো কাজ করা যায় না? অনলাইনেই পুরুষদের মানুষ হওয়ার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায় না? কী করে নারীকে মানুষ ভাবতে হয়, তাদের অধিকারকে সম্মান করতে হয়, তা শেখানো যায় না? আলবৎ যায়। সেটিই করতে হবে। নারীকে যৌন হেনস্তা করা যে কতখানি বর্বরতা, নারীকে নির্যাতন করা যে কতখানি নির্বুদ্ধিতা… তা বোঝাতে হবে।
অনেক কিশোরই আজ অনলাইনে। তারা ঘর থেকে, বিদ্যালয় থেকে, রাস্তাঘাট থেকে, টিভি কম্পিউটার থেকে নারীর সমানাধিকারের ব্যাপারে কোনও জ্ঞানার্জন করতে পারছে না। তাদের এবং নারীবিদ্বেষী পুরুষদের সকলকেই শেখানো হোক কী করে নারীকে যৌন বস্তু ভাবা বন্ধ করতে হয়, কী করে নারীকে হেনস্তা করা বন্ধ করতে হয়, কী করে নোংরা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকে বিদেয় করে দিতে হয়।
মানুষ ক্রমশ নির্ভর করছে অনলাইনের ওপর। এখানেই ভবিষ্যৎ। এই জগৎটিতে যদি প্রতিনিয়ত নারীকে নারী হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে অপমান করা হয়, তবে নারীর কোনও সম্মান ভবিষ্যতের জগতেও নেই।
অলৌকিক চরিত্রকে অসম্মান করলে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মানুষকে গ্রেফতার হতে হয়, কিন্তু রক্ত-মাংসের লৌকিক চরিত্র নারীকে চূড়ান্ত অসম্মান করলেও, নিগ্রহ নির্যাতন করলেও কোনও আইনে তার শাস্তি নেই, সম্ভবত লৌকিক চরিত্রটি নারী বলে। নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। পুরুষতন্ত্র নারীর ক্ষতি যতটা করেছে, তার চেয়ে বেশি করেছে পুরুষের ক্ষতি। পুরুষতন্ত্রের কারণে নারী হয়েছে অনুগত, বশ্য। আর পুরুষ হয়েছে হিংস্র, আর স্বার্থপর, নিষ্ঠুর আর বর্বর।
লেখক : তসলিমা নাসরিন, নির্বাসিত লেখিকা
সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন