সাদ্দিফ অভি: নারী শ্রমিকদের মতো সৌদি আরব থেকে এবার গণহারে দেশে ফিরছে পুরুষ শ্রমিকরা। ফিরে আসা এই শ্রমিকদের প্রায় সবারই অভিযোগ, কাজের বৈধ অনুমতিপত্র (আকামা) থাকা সত্ত্বেও সৌদি সরকার ধরে ধরে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে তাদের। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সৌদি আরবের ১২টি সেক্টরকে সৌদিকরণ প্রক্রিয়া শুরু করায় কর্মসংস্থান হারিয়ে দেশে ফিরে আসছেন শ্রমিকরা।
এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশন সূত্র জানায়, বুধবার (৩ অক্টোবর) দুপুরে সৌদি এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে দেশে ফিরে এসেছেন ১৪৪ জন শ্রমিক। তারা সবাই সৌদি আরবের দাম্মাম থেকে ফিরেছেন। তবে একই দিনে সৌদির বিভিন্ন ফ্লাইটে আরও ১৫০ থেকে ২০০ জন শ্রমিক ফিরেছেন। তবে শুধু বুধবার নয়, এর আগেও আরও শ্রমিক দেশে ফিরেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
দেশে ফিরে আসা শ্রমিকদের একজন পিরোজপুরের শামীম। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ করে যায়, ৯ বছর আগে লেবার ভিসা নিয়ে সৌদি আরব গিয়েছিলেন তিনি। এরপর আবার আকামা করতে খরচ হয়েছে ৮ হাজার রিয়াল। কিন্তু সম্প্রতি দেশটির কর্মক্ষেত্রে সংস্কারের ঘোষণার পর ধরপাকড়ের কবলে পড়েছেন তিনি। আকামার মেয়াদ থাকা সত্ত্বেও পুলিশ ধরে ডিপোর্টেশন সেন্টারে পাঠিয়ে দিয়েছে।
একই ভাবে দেশে ফিরে এসেছেন চট্টগ্রামের মফিজুল ইসলাম বাবলু। তারও একই অভিযোগ। আকামার মেয়াদ থাকা সত্ত্বেও ধরে দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে সৌদি আরবের সরকার।
কুষ্টিয়ার মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান অভিযোগ করে বলেন, ‘দেশে ফেরার জন্য এখনও ৫০০ থেকে ৭০০ জন অপেক্ষমান আছেন। এদের সবাইকে রাস্তা থেকে কিংবা দোকান থেকে ধরে নিয়ে গেছে সৌদি আরবের পুলিশ।’
জিয়াউরের দাবি, তিনি সিগারেট কেনার উদ্দেশ্যে দোকানে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। তখন পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। মসজিদ কিংবা সুপার শপ থেকেও শ্রমিকদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে জানা তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সৌদি আরবের নাগরিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে দেশটির সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েছে সেদেশে অবস্থানরত বিদেশি শ্রমিকরা। সৌদি সরকার ১২টি সেক্টরকে সৌদিকরণ করার ঘোষণায় গত ১৫ মাসে ৭ লাখ ২০০ জন প্রবাসী শ্রমিক সেদেশ ছেড়ে চলে গেছেন।
সৌদি আরব সরকারের পরিসংখ্যান দফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০১৭ সালেই সৌদি আরব ছেড়ে গিয়েছেন ৪ লাখ ৬৬ হাজার। এছাড়া বিগত তিন মাসে ২ লাখ ৩৪ হাজার ২০০ জন শ্রমিক শ্রমবাজার ত্যাগ করেছেন। তবে এর মধ্যে কী পরিমাণ বাংলাদেশি আছেন তা জানা সম্ভব হয়নি।
এ ব্যাপারে সৌদি আরবের রিয়াদে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর (যুগ্ম সচিব) সারওয়ার আলম বলেন, ‘সৌদি আরবের বাংলাদেশিরা অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতির শিকার হবেন। তাদের আকামা পরিবর্তনের সুযোগ আছে। কিন্তু আমাদের লোকরা তো থাকবেন না, কারণ এখানে যারা কাভার-আপ বিজনেস করছেন, এটা তো এদেশের আইনে অবৈধ। তারা চিন্তা করছেন যে, এইভাবে আর কতো! তাই তারা ফিরে যাচ্ছেন দেশে। যারা প্রফেশনাল জায়গায় কাজ করছেন, তারা হয়তো পরিবার দেশে পাঠিয়ে আকামা পরিবর্তন করে থাকবেন, যদি তার স্কিল থাকে।’
সৌদি সরকারের এই সিদ্ধান্তের পর সৌদি আরবে অবস্থিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসি বলেছেন, আমাদের লোকজন কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তবে নতুন নতুন সেক্টরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা যাতে করা যায়, আমরা সেই চেষ্টা করছি। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।
এ প্রসঙ্গে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান জানান, মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে এসে নতুন বাজার খোঁজার প্রতি মনোযোগী হওয়া দরকার। সৌদি সরকারের বিভিন্ন সেক্টর জাতীয়করণের সিদ্ধান্তের জন্যই সংকট তৈরি হচ্ছে। শরিফুল হাসান আরও বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে শ্রম বাজারে সংকট কারণ হলো, কনস্ট্রাকশন সেক্টরে কাজ কমে যাচ্ছে। সৌদি আরবে যেটা শুরু হয়েছে, তারা এখন তাদের নিজেদের লোককে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে চায়। এসব কারণে কিন্তু সেদেশের বাজারে সংকট শুরু হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের অল্টারনেটিভ মার্কেট খোঁজ করা ছাড়া কোনও উপায় নেই।’
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘গণহারে বিদেশে জনশক্তি না পাঠিয়ে সংখ্যার চেয়ে গুণগত দিকটা দেখা প্রয়োজন। শুধু লেবার হিসেবে না গিয়ে আমাদের দক্ষ শ্রমিক তৈরি করার প্রতি জোর দিতে হবে। সংখ্যার চেয়ে গুণগত পরিবর্তন যেটা হওয়া দরকার, তার জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।’ -বাংলা ট্রিবিউন