প্রবাস ডেস্ক: কোনো কোনো কর্মী অর্থের বিনিময়ে তার স্পন্সরের সাথে মৌখিক সমঝোতার ভিত্তিতে স্পন্সরের বাইরে অন্যত্র কাজ করে। স্পন্সরের বাইরে এভাবে অন্যত্র ফ্রি/ স্বাধীনভাবে কাজ করাকে তথাকথিত ফ্রি ভিসা বলে।
এভাবে ফ্রি হিসেবে থাকলে কর্মীকে ইকামা ইস্যু, নবায়ন, ছুটির এক্সিট রি-এন্ট্রি ভিসা ইস্যু, ফাইনাল এক্সিট ভিসার ফিসহ যাবতীয় সরকারি ফি বহন করতে হয়।
এমনকি মাসিক ভিত্তিতে কফিলকে (মালিক বা মূল নিয়োগদাতা) নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ দিতে হয়। এভাবে সমঝোতার ভিত্তিতে নিয়োগকর্তার বাইরে অন্যত্র কাজ করা ও ইকামা সংক্রান্ত কোন অর্থ লেনদেন করা, ফায়দা দেয়া/ নেয়া সম্পূর্ণ বেআইনি। এইসব ক্ষেত্রে কফিল কোনো এগ্রিমেন্ট পেপার দেয় না, পাশাপাশি কর্মীর নিকট হতে নানা ধরণের কাগজে সিগ্নেচার/টিপ সই নিয়ে রাখে, সেসব কাগজে কী লেখা থাকে তা কর্মী জানেনা (তাই প্রয়োজন অনুযায়ী পরে কখনো কফিল এইসব কাগজ নিয়ে কোর্টে মামলা করে উল্টো ফাঁসিয়ে দেয় কর্মীদের)। তাই, খুবই স্বাভাবিক কারণেই এই ধরণের ফ্রি ভিসায় থেকে পরবর্তীতে প্রতারিত হলে এর কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না বললেই চলে।
‘ফ্রি ভিসার’ এইসব কর্মীরা উপার্জন করুক আর না করুক- কাবুলিওয়ালারূপী কফিলকে মাসিক ৩০০-৫০০ রিয়াল হারে বছরের শুরুতেই ফায়দা দিতে হয়, এবং ইকামার যাবতীয় ব্যায়ভারও বহন করতে হয় নিজেকেই।
এমনকি সাউদাইজেশনের জন্য যে সৌদি কর্মী নিয়োগ দেখাতে হয় তারও বেতন ভাতার ভার বইতে হয়। এ ধরনের কর্মী কোনো ঝামেলায় পরলে কফিল সোজা বলে দেয় এর কোনো দায়-দায়িত্ব কফিল নিবেনা। আর কথায় কথায় হুরুব (পলাতক হিসেবে থানাকে জানানো) দিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে অর্থ আদায় করে খাটাশ কফিলেরা।
হুরুব দিলেও কর্মীর কিছুই করার থাকেনা। কারণ, কর্মী লেবার কোর্টে গেলে কফিলের নিকট কাজ করে এমন কোনো প্রমান দিতে পারবেনা। ‘ফ্রি ভিসাধারী’ হিসেবে থাকার জন্য এমন কতো ধরণের কাগজে যে সিগ্নেচার/টিপ সই দিয়েছে কর্মী তা নিজেই জানেনা। আর এভাবেই আমরা আমাদের জামা খুলে দেই লবণ লাগিয়ে পিঠে চাবুক মারার জন্য, কফিলও ইচ্ছামত স্বার্থ হাসিলের চাবুক মারতে থাকে।
জীবিত দুধ দেয়া গাভীর (আমেল বা কর্মী কিংবা লেবার) যদি এই অবস্থা হয় তাহলে সে মারা গেলে কী হয়?! তখন কফিল কি আমেলের (শ্রমিক) লাশ দেশে পাঠাবে?
না, নির্মম সত্য হচ্ছে- পারলে সেই শ্রমিকের লাশ বেইচা দিয়া টাকা পকেটে পুরবে।
মর্গ চার্জ ও সার্ভিস বেনিফিটসহ পাওনা-দেওনা তো দূরের কথা; বরং কর্মীর ফ্যামিলির কাছে লাশ পাঠানোর খরচ চায় আর না হয় এই কফিলের অধীনে থাকা বাকি আমেলদের চাপ দেয় লাশ পাঠানোর খরচ বহন করতে। অন্যথায় তাদের কে হুরুব দিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। তখন বাংলাদেশিরা লাশ পাঠানোর জন্য এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করে।
কিন্তু নিয়ম কি বলে? নিয়ম বলে, মৃত্যুর পূর্বে যদি এই ফ্রি ভিসার কফিল তাকে হুরুব না দিয়ে থাকে (মানে পলাতক বলে জিডি না করে থাকে) তাহলে তার লাশ পাঠানোর যাবতীয় খরচ বহণ করতে বাধ্য থাকবে সে। তবে এক্ষেত্রে কফিল গরিমসি করে বলে লাশ পাঠাতে বিলম্ব হয়। তাই মৃতের পরিবারকে একটু ধৈর্য ধারণ করতে হয়।
কফিল গরিমসি করলে দূতাবাস স্থানীয় থানায় পত্র প্রেরণ করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য চাপ দিতে পারে, এবং মর্গ কর্তৃপক্ষও পুলিশকে স্পন্সর কর্তৃক দ্রুত লাশ প্রেরণের জন্য চাপ প্রয়োগ করে।
এবার আসা যাক বাংলাদেশ সরকার কেন লাশ প্রেরণ করতে খরচ বহন করেনা- এই প্রশ্নে? সৌদি সরকার বাংলাদেশ সরকারের সাথে এই মর্মে চুক্তিবদ্ধ যে, কোনো কর্মীকে সৌদি আরবে কাজের জন্য নিয়ে আসতে হলে তাকে যাবতীয় স্বাস্থ্য ইন্সুরেন্সসহ সকল খরচ বহন করে নিয়ে আসতে হবে। যদি কেউ মারা যায় তাহলে মৃত্যুর পর বকেয়া পাওনাসহ সার্ভিস বেনিফিট প্রদানপূর্বক স্পন্সরের খরচে লাশ দেশে প্রেরণ করবে, এটা সৌদি আরবের শ্রম আইনেও আছে। সৌদি সরকারের এই আইন আছে জানার পরও এবং চুক্তির পরও কোন দেশের সরকার লাশ পাঠানর খরচ বহন করবে? তাই আইনি জটিলতায় পরতে হয়।
উল্লেখ্য, মৃতদেহ দেশে পৌঁছানোর সাথে সাথে বিমানবন্দরেই মৃতের পরিবার লাশ দাফন বাবদ ৩৫ হাজার টাকা পায় সরকারের পক্ষ হতে, এবং পরবর্তীতে স্থানীয় জনশক্তি অফিসে আবেদনের ভিত্তিতে তিন লাখ টাকা পায় সরকারের তরফ হতে।
যেহেতু হুরুব থাকা কর্মীর লাশ কফিল দেশে প্রেরণ করবে না আইন অনুযায়ী তাই এই ধরনের লাশ দেশে প্রেরণ করতে মৃতের পরিবার স্থানীয় জনশক্তি অফিস কিংবা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করলে সরকারি খরচে লাশ দেশে প্রেরণ করা হয়। সেক্ষেত্রে মৃতদেহ দেশে যাওয়ার পর মৃতের পরিবার তিন লাখ টাকার আর্থিক সহায়তা আর পাবেনা।
প্রশ্ন হল ফ্রি ভিসায় কর্মী আসার অনুমতি কে দেয়? উত্তর হল ভাই, কোনো ব্যাক্তিই ফ্রি ভিসায় সৌদি আরবে আসেনা। সরকারকে সে বলে যে আমি কাজের ভিসায় যাচ্ছি এবং একথা স্ট্যাম্পে লিখিত দিয়েই আসে। বেশি টাকা কামাইয়ের মিথ্যা লোভে এবং পূর্বের ফ্রি ভিসার রমরমার কথা মনে করে যেভাবেই হউক তাদের সৌদি আসা চাই-ই চাই। এই চাহিদা যত দিন না কমবে ততদিন লোকেরা ধোঁকা খেতে থাকবে।
আজকের সৌদি আরব ৫ বছর আগের সৌদি আরবের চেয়ে অনেক ভিন্ন। সৌদি আরবের এখন টার্গেট হল- অভিবাসী কমিয়ে নিজ নাগরিকদের কর্মসংস্থান করা। পাশাপাশি ফ্রি ভিসা নামক এইসব নৈরাজ্য বন্ধ করা।
তাই যারা ফ্রি ভিসায় আছে তাদের প্রতি অনুরোধ- দ্রুত এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে পড়ুন। আর নিকটজনকে এর কুফল বুঝিয়ে এই ভিসায় কাউকে সৌদি আরব আসতে নিষেধ করুন। আমাদের প্রচারণাই পারবে এর ভয়াবহতা থেকে সহজ-সরল মানুষজনকে বাঁচাতে।
মামুনুর রশিদ, লিগাল অ্যাসিস্ট্যান্ট, বাংলাদেশ দূতাবাস, রিয়াদ