সোমবার, ১৮ মার্চ, ২০১৯, ০৪:৪০:১২

ক্রাইস্টচার্চ হামলা: মেয়ের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়লেন সিলেটের ফরিদ

ক্রাইস্টচার্চ হামলা: মেয়ের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়লেন সিলেটের ফরিদ

প্রবাস ডেস্ক : পনের বছর বয়সী মেয়ে শিফার সামনে কান্নায় ভেঙে পড়লেন ফরিদ আহমেদ। তিনি নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত সিলেটের হুসনা আরা ফরিদের স্বামী। তার চোখে সেদিনের ভয়াবহতার দৃশ্য। 

বাসায় ফিরে তিনি যখন মেয়ে শিফার মুখোমুখি হন তার কাছে লুকাতে পারেন নি কিছুই। তাকে বলতে হয়েছে সব। তখনই শিফা তার কাছে প্রশ্ন ছুড়েছে তুমি কি বলতে চাইছো আমার মা নেই আর? তার এ প্রশ্ন শুনে অঝোরে কাঁদে ফরিদ আহমেদ। মেয়ের প্রশ্নের উত্তরে বলেন না নেই। কিন্তু এখন থেকে আমিই তোমার মাম।

আমরা একসঙ্গে সব প্রতিকূলতার মুখে দাঁড়াবো। এরপর থেকে নিজের বুকে শোক চাপা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের শান্তনা দিচ্ছেন ফরিদ আহমেদ। তিনি বলেন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি শক্তিশালী থাকার। কারণ, আমি যদি ভেঙে পড়ি তাহলে অন্যদেরও একই দশা হবে। 

তার ভাষায়- আমি সবাইকে বলেছি, প্রয়োজন হলে কাঁদো। কিন্তু এই কান্নাকে বা আবেগকে তোমার মন ভেঙে দিতে দিও না। সেই থেকে আমি সবার সঙ্গে শুধু কথা বলছি আর বলছি। তাদেরকে বুঝাচ্ছি, যুক্তি দেখাচ্ছি কেন ইতিবাচক থাকা উচিত। তাদেরকে বলেছি, হোসনে আরা লাখ লাখ মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। মেয়েকে বলেছি, এটাই স্মরণে, স্মৃতিতে রাখতে হবে। এটা স্মরণ করে কান্নার চেয়ে ভাল থাকার চেষ্টা করতে হবে।

হামলাকারীর প্রতি তার কোনো ক্ষোভ নেই। বলেছেন, ক্ষোভ ও যুদ্ধ কোনো সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। তাই তিনি হামলাকারীকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। বরং তিনি হামলাকারীর প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, সেই একজন মানুষ। আমার একজন ভাই। তাই তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। 

 স্ত্রী হুসনা ও মেয়ের ছবি হাতে নিয়ে হুইল চেয়ারে দিন কাটাচ্ছেন তিনি। হুসনাকে নিয়ে তিনি গর্ব করেন। তিনি বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের জন্য একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন। মসজিদে বাচ্চাদের পড়াতেন।

ফরিদ আহমেদ বলেন, তিনি অন্য মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য কাজ করে গেছেন। শেষ কাজটিও তাই করে গেলেন। হামলার সময় তিনি মসজিদের ভিতরের অনেক মানুষকে রক্ষা করেছেন। তারপর আমার কাছে আসছিলেন। ওই সময়ই তাকে গুলি করা হয় পিছন থেকে। 

ফরিদ আহমেদ নিউজিল্যান্ডে গিয়েছেন ১৯৮৮ সালে। ৬ বছর আগে মদ্যপ এক গাড়িচালক তাকে আঘাত করায় তিনি এখন প্যারালাইজড। চলাফেরা করেন হুইলচেয়ারে। আর হুসনা নিউজিল্যান্ডে গিয়েছেন ১৯৯৪ সালে। যেদিন নিউজিল্যান্ডে পৌঁছেন হুসনা সেদিনই তারা অকল্যান্ডে বিয়ে করেন। এ

রপর চলে যান নেলসনে। শুধু বাংলাদেশী এই দম্পতির ওপর নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে ফরিদ আহমেদ হামলার সময়কার সব ঘটনা খুলে বলেছেন।

তিনি বলেন, অকস্মাৎ আল নূর মসজিদের ভিতরে ঝড়ের গতিতে প্রবেশ করলো একজন অস্ত্রধারী। এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করলো। এ সময় হুসনা নারী ও শিশুদের নিরাপদ করার চেষ্টা করতে লাগরেন। তিনি আর্তনাদ করে বলতে লাগলেন আপনাদের বাচ্চাদের ধরে এই পথে বেরিয়ে যান। 

তাদেরকে নিরাপদ করে মসজিদের ভিতরে হুইলচেয়ারে বসা ফরিদ আহমেদকে রক্ষা করতে ফিরছিলেন হুসনা। ঠিক তখনই তার পিছন থেকে গুলি করা হয়। এ সম্পর্কে ফরিদ আহমেদ বলেন, সে এক ভয়াবহ দৃশ্য। আমি শুধু রক্ত দেখতে পাচ্ছিলাম চারদিকে। আহত মানুষ আর্তনাদ করছেন। দেখি শুধু মৃত দেহ। 

অন্যরা বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন মসজিদ থেকে। ফলে পিছনদিকের বের হওয়ার গেঠে ছিল ভীষণ ভিড়। একবার আমি সিদ্ধান্ত নিই সেখানে গিয়ে চেষ্টা করে দেখি। বাইরে চলে যাই। আমি সুযোগটা নিইও। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে ধীরে। জানি যেকোনো সময় পিছন থেকে মাথায় গুলি করে আমাকে মেরে ফেলতে পারে। 

ফরিদ আহমেদ তখন অন্য একটি রুমে। তিনি সেখান থেকে দেখতে পাচ্ছিলেন নারী ও শিশুরা বেরিয়ে যাচ্ছে। মসজিদের অন্যপাশে তখন তার স্ত্রী মরে পড়ে আছেন এ সম্পর্কে তার কোন ধারণাই ছিল না। ফরিদ আহমেদ বলেন, অস্ত্রধারীকে দেখতে পাই নি। তবে তার কথা বা শব্দ শুনতে পেয়েছি। শুনতে পেলাম কয়েক সেকেন্ডের জন্য গুলি থেমে গেল।আবার শুরু হলো। সম্ভবত এ সময়ে সে তার বন্দুকে ম্যাগাজিন প্রবেশ করিয়েছে। 

ফরিদ আহমেদের ওপর দিয়ে অনেকে দৌড়ে লাফিয়ে বেরিয়ে যেতে থাকেন। তারা মসজিদের দরজায় আঘাত করতে লাগলেন। সাহায্য চেয়ে চিৎকার করতে লাগলেন। ফরিদ আহমেদ বলেন, আমার এক বন্ধু আমাকে ফোন করলেন। তিনি কাঁদছিলেন তখন। বললেন, আমি তোমাকে ফেলে এসেছি।

তাকে বললাম, যেটা করেছো বুদ্ধিমানের কাজ করেছো। আমি তো হুইলচেয়ারে। তোমাদের মতো দেয়াল টপকে যেতে পারতাম না। ১০ মিনিটের মতো কেটে গেল। বন্ধ হলো গুলি। মনে হলো হামলাকারীর কাজ শেষ। এ সময় আমি এবং অন্যরা ভিতরের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। 

প্রথমেই নারীদের চেক করা শুরু করি। চারদিকে দেখি মৃতদেহ। সাবইকে পিছনে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রতিটি মৃতদেহ উপুর হয়ে পড়ে আছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিউ মূল রুমটিতে যাওয়ার। সেখানে সব জায়গা পড়ে আছে বুলেটের শেল। 

ওই মসজিদটির সিনিয়র একজন সদস্য ফরিদ আহমেদ। প্রায় তিন বছর তিনি এখানে বয়ান দিয়েছেন। ফলে মসজিদে যারা যান তাদের প্রায় সবাইকে তিনি চেনেন। ফরিদ আহমেদ বলেন, আমি একজন পুরুষকে আর্তনাদ করতে দেখলাম। তিনি সাহায্য চাইছেন। দেখলাম তার শরীরের ওপর পড়ে আছে দুটি মৃতদেহ। তিনি আমাকে অনুরোধ করছেন তা সরিয়ে তাকে নিশ্বাস নিতে সাহায্য করতে। 

সেখানেই তাকে থেমে যেতে হয়। কারণ, ওই রুমটি ভরা মৃতদেহে। তার ভিতর দিয়ে তিনি হুইল চেয়ার চালিয়ে অগ্রসর হতে পারছিলেন না। বলেন, ইথিওপিয়ার একজন মানুষ আমাকে ডাকলেন। সাহায্য চাইলেন। বললেন, নিশ্বাস নিতে পারছেন না। একজনকে দেখলাম এমনভাবে নিশ্বাস নিচ্ছেন, তা দেখে মনে হলো শিগগিরই তিনি মারা যাবেন।

দু’জন মানুষকে জীবিত পড়ে থাকতে দেখি। এর মধ্যে একজন বাংলাদেশী। তাকে আমি চিনি। এদিনই দু’সন্তান ও অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে সন্ধ্যায় বাংলাদেশে আসার কথা ছিল। তিনি আমাকে দেখলেন এবং বললেন, আমি শেষ হয়ে গিয়েছি। ফিলিস্তিনি একজনকে দেখলাম রক্ত ঝরছে তার শরীর থেকে। সবাই সাহায্য চাইছেন। 

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে