তসলিমা নাসরিন : আমি শুনেছি, কেউ বলেছেন যে গত রোববার শ্রীলঙ্কায় একটি রক্তের নদী বয়ে গেছে। কিন্তু কেন এই হত্যাকান্ড? এত ঘৃণা কেন? মধ্যযুগে ক্রুসেডের মতো ধর্মীয় যুদ্ধ ছিল। যেখানে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষকে হত্যা করেছে।
আমরা বিশ্বাস করি যে, আমরা এখন আরো সভ্য হয়ে উঠেছি এবং আমাদের সভ্য সমাজগুলোতে সব বিশ্বাস ও গোত্রের মানুষেরা চমৎকার সহাবস্থান গড়ে তুলেছে। কিন্তু আমাদের এই সত্য অস্বীকার করা হবে যদি আমরা এই সত্য অস্বীকার করি যে ধর্মীয় যুদ্ধ এখনো আমাদের চারদিকে চলছে।
মুসলমানরা খ্রিষ্টানদের হত্যা করছে, খ্রিষ্টানরা মুসলমান ও ইহুদিদের হত্যা করছে, বৌদ্ধরা মুসলিমদের হত্যা করছে, মুসলমানরা হিন্দুদের হত্যা করছে, হিন্দুরা এর বিপরীতে মুসলমানদের হত্যা করছে। যাইহোক, আমরা বিশ্বাস করতে চাই যে আমরা ধর্মের উপরে উঠেছি, সবকিছু ছাপিয়ে মানুষের পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বাস্তবতাটি ভিন্ন।
একজনের ধর্মীয় পরিচয় এখনো অগ্রগণ্য। এমনকি এখন অন্য সবকিছুর উপর জাতিগত, বর্ণ ও লিঙ্গের পরিচিতি অগ্রাধিকার লাভ করে। নিউজিল্যান্ডে, শ্বেতাঙ্গ পরাক্রমশালী খ্রিষ্টান সন্ত্রাসী সম্পূর্ণরূপে সচেতন ছিলেন যে তিনি মুসলমানদের হত্যা করছেন। এর পরিবর্তে, মুসলিম সন্ত্রাসীরা শ্রীলঙ্কায় ইচ্ছাকৃতভাবে চার্চ এবং হোটেল বোমা হামলা করে, যখন সেখানে ইস্টার উদ্যাপন চলছিল।
এখন, আইএসআইএস শ্রীলঙ্কায় হামলার দায় স্বীকার করেছে। একটি ছোট দেশের ছোট সংখ্যালঘু সংগঠনের পক্ষে মানুষ হত্যা করার জন্য বেশ কিছু লোককে আত্মঘাতী বোমা হামলার প্রশিক্ষণ দেয়া এবং সমন্বিতভাবে ধারাবাহিক বোমা হামলা করে শত শত মানুষ হত্যা করা সহজ নয়। যদিও পূর্ববর্তী ঘটনাগুলোতে আইএস মিথ্যা দাবি করেছে, কিন্তু এই সময় এমনটি নাও হতে পারে ।
গীর্জার উপর আক্রমণাত্মক হামলার বিষয়ে সতর্ক করে শ্রীলঙ্কার কাছে ভারত সরকার তিনটি সতর্কবার্তা পাঠিয়েছিল। কিন্তু সতর্কবার্তা সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কা সরকার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তারা যদি মনোযোগ দিতো তবে সম্ভবত তারা কোনো গীর্জায় ইস্টারের উদ্যাপন হতে দিতো না এবং এমনকি হোটেলগুলোকেও কঠোর নজরদারির অধীনে রাখা হতো।
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনা বলেন, তিনি গোয়েন্দা তথ্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না এবং তিনি যদি জানতেন তবে তিনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন। সম্ভবত ভারতের উচিত ছিল এই বিষয়টি আরো গুরুত্ব সহকারে শ্রীলঙ্কার কাছে ব্যাখ্যা করা এবং এটা নিশ্চিত করা যে তারা তাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা রক্ষায় যথাযথ ও জরুরি সতর্কতা অবলম্বন করবে।
নিউজিল্যান্ড মসজিদে হামলার প্রতিবাদে শ্রীলঙ্কায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হলে অন্য কোথাও হয়তো খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীরা আরো মুসলমান হত্যা করে শ্রীলঙ্কার প্রতিশোধ নেবে। সহিংসতা ও হত্যার এই চক্রের কোনো শেষ নেই, এটি অনন্তকাল চলতে পারে।
বাংলাদেশের রেডিক্যালাইজেশন
কিন্তু আমি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বেশি ভয় করি। গত কয়েক দশক ধরে মানুষকে সেখানে যেভাবে ব্রেইনওয়াশ করা হয়েছে, তা অবিশ্বাস্য। একদা দেশে ভিন্নমত প্রকাশের জায়গা ছিল। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই এবং কোনো ভয় ছাড়াই, সম্ভবত গর্বের সঙ্গেও দাবি করত যে, রিলিজিয়নে তারা ‘বিলিভ’ করে না। আজ যদি কেউ বলে যে তারা ‘অ্যাথেয়িস্ট’, তবে তাদেরকে ক্ষমা চাইতে হবে কিংবা নিহত হওয়ার ঝুঁকি থাকবে।
ধর্মনিরপেক্ষতার অঙ্গীকারের ভিত্তিতে দেশটি নির্মিত। এখন অতীব নিবিষ্টচিত্তে এবং ভয়ানকভাবে তারা রিলিজিয়ন গ্রহণ করেছে। রিলিজিয়ন ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ে। বক্তৃতা ও পাঠদান প্রত্যেকটি এলাকায় শোনা যাবে। একশ্রেণির লোক ধর্মের নামে যুবকদের মগজ ধোলাই এবং অযৌক্তিকভাবে নারী ও অমুসলিমদের ঘৃণা করার প্রশিক্ষণ দেয়।
যারা রিলিজিয়নে বিশ্বাস রাখে না, তারা সরকার ও চরমপন্থিদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে যায়, যারা ধর্মের নামে ঘৃণা, ঈর্ষা, কুসংস্কার ও সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেয় তারাই হয়ে যায় শ্রদ্ধার পাত্র। তাদের স্পর্শ করা যাবে না, তাদের কাজের সমালোচনা করা যাবে না। কিছু নেতার ওয়াজ-নসিহত নিয়ন্ত্রণে কিছুদিন আগে আলোচনা হয়েছিল, কিন্তু এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার চূড়ান্ত ও দৃঢ়সংকল্প কার আছে?
তাদের নীরব উৎসাহে, সরকার ও সাধারণ মানুষ উভয়ে ধর্মান্ধ থেকে গ্রাম্য ধর্মীয় শিক্ষকদের এতটাই শক্তিশালী করেছে যে, তারা এখন যা চায় তাই তারা দায়মুক্তির সঙ্গে করতে পারেন। তারা পুরোপুরি জানেন যে, সরকার আগে যেমন করেছে, তেমনি এখনো সরকার তাদের কাছেই মাথা নত করবে। তাদের কর্মকান্ডই ভবিষ্যতের একজন নিবরাস ইসলাম, রোহান ইমতিয়াজ বা মীর সামি মুবাশির (ঢাকা ক্যাফে সন্ত্রাসী) তৈরি হচ্ছে। কোনো দিন হয়তো তা বিস্ফোরিত হয়ে বাংলাদেশ কাঁপাবে।
কারখানায় উৎপাদিত সন্ত্রাসীরা হামলার জন্য রাতের অন্ধকারে গা ঢাকার জন্য অপেক্ষা করবে না। তার নিজকে কাভারের প্রয়োজন নেই। প্রকাশ্য দিবালোকে ধর্মান্ধ মানুষ যাদের হৃদয় ঘৃণায় পূর্ণ তারা অমুসলিম নিধনে নামবে, কারণ তাদের অন্ধ বিশ্বাস, এটা করলে তাদের ভালো হবে, স্বর্গ মিলবে।
শ্রীলঙ্কার সন্ত্রাসীদের মতো কোনো ধর্মান্ধ গোষ্ঠী যদি একদিন গীর্জা, মন্দির বা শিয়া, বাহাই ও আহমদিয়াদের উপাসনা স্থানে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়? তারা যদি ২০১৬ সালের ঢাকায় হোলি আর্টিসান ক্যাফের মতো আরেকটি হিংসাত্মক ঘটনা ঘটায়? তারা যদি হোটেলে বোমা ফাটায়?
আমি নিশ্চিত তারা এটা করবে, কারণ যেহারে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে যদি তারা এটা না ঘটায় তাহলেই বিস্ময়কর হবে। অনেক আইএস এজেন্ট নিহত হয়েছে, কিন্তু তাদের মতাদর্শ চলছে। এবং এটি সারা বিশ্বকে ঘিরে রয়েছে।
কোনো দেশ কেবল মন্দির ও মসজিদ নির্মাণের মাধ্যমে বা ধর্মীয় কুসংস্কারে নিমজ্জিত হয়ে অগ্রগতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে? একটিও একক উদাহরণ নেই। বরং, আমরা যেকোনো সভ্য ও উন্নত আদর্শের দেশ চিনতে পারি, সেখানে সব ধর্মের লোকেরা রাষ্ট্র, শিক্ষা ও সমাজ থেকে ধর্মকে আলাদা করতে পেরেছে এবং সম্ভবত প্রায় তাদের জীবন থেকেও।
ধর্মের দ্বারা তারা অন্ধ হয়ে না গেলেও, তারা কি করে মানুষের প্রতি সদয় এবং উদার হতে পেরেছে? ভালোবাসা ও সম্মান তো নয়ই, সত্যের স্থান রিলিজিয়নে খুবই সামান্য। যদি কিছু থাকেই কারো সঙ্গে তার সম্বন্ধ, সেটা রাজনীতির সঙ্গে।
‘আমি এই প্রক্রিয়াতে মরে গেলেও আমি তোমায় মেরে ফেলব’ অনেক মুসলমান আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী হতে এমন মন্ত্রই বেছে নেন। বাংলাদেশে এ ধরনের মুসলমানের অভাব নেই। বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি আইএসে যোগ দিতে সিরিয়া ও ইরাকে গেছে।
তারা জানত যে সম্ভবত তারা শত্রুদের দ্বারা নিহত হবে। মৃত্যুকে মহিমান্বিত বিবেচনা করা এবং এই বিশ্বাস তাদের মধ্যে কীভাবে ঘটেছে, আমি সন্দেহ করি যে, কেউ এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার ব্যাপারে নিজেদের উদ্বিগ্ন করেছে।
বাংলাদেশ সরকার কি এই সমস্যা সমাধানে কিছু করছে? তথাকথিত এনকাউন্টারে সন্ত্রাসীদের হত্যা করেই কোনো কিছু সমাধান মিলবে না। সম্ভাব্য হুমকিগুলোকে নজরদারির অধীনে রাখা সরকারের দায়িত্ব। এটাও হয়তো এক ধরনের সতর্কবার্তা।
শ্রীলঙ্কা যেভাবে সতর্কবার্তা পেয়ে উপেক্ষা করেছিল, বাংলাদেশ যদি একই ভুল করে তাহলে তাকেও একই দুঃখজনক অভিজ্ঞতা পেতে হবে। সেটা শুধু একবার নয়, বারংবার ঘটতে পারে। সূত্র : দি প্রিন্টডটইনের