প্রবাস ডেস্ক : এই অসাধারণ বিতার্কিকের নাম রেবেকা শফি। জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকার ধানমন্ডিতে। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পদার্থবিজ্ঞানের উপর স্নাতক সম্পন্ন করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাস্ট্রো-ফিজিক্স এর উপর করেন পিএইচডি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজন কিশোরীর মিনিট তিনেকের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেছে। ১৯৯৪ সালে বিটিভিতে অনুষ্ঠিত এক প্রীতি বিতর্কে অংশ নিয়ে কিশোরী বলছে তার নিরুদ্দেশ হবার ইচ্ছের গল্প। তার কথায় মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। কখনও মনে হয়েছে মেয়েটি নিশ্চয়ই ভাল আবৃত্তি করে কিংবা ভাল গান করে। গানের মত অদ্ভুত ছন্দময় সে বক্তৃতা আবেদন। তার বিশুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ, সুললিত ভঙ্গী আর গল্প বলার ধরণে চোখ কান আর মন সবই আটকে যায়। ঐ আসরে শ্রেষ্ঠ বিতার্কিকের উপাধি জিতে নিতে তাই কোন বেগ পেতে হয়নি তাকে। এত সুন্দর করে সুললিত বাংলায় কথা বলতে এখন আর কিশোর কিশোরীদের খুব একটা দেখা যায় না।
এই আগ্রহ জাগানীয়া বিতার্কিক এখন কোথায় কেমন আছেন, কি করছেন খুঁজতে গিয়ে আরেকবার চমকিত নেটিজেনরা। এবার আবার ভাইরাল তাঁর প্রোফাইল, তাঁর ওয়েবসাইট, তাঁর ছবি। কারণ ইনি যে আসলেই হিরের টুকরো!
এই অসাধারণ বিতার্কিকের নাম রেবেকা শফি। জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকার ধানমন্ডিতে। বাবা আহমদ শফি ও মা সুলতানা শফি দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক । পুরো পরিবারই যেন পদার্থবিজ্ঞান পরিবার। বড় বোন ফারিয়া শফিও পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ছিলেন।
রেবেকা ঢাকা হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়াশোনা শেষ করে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পদার্থবিজ্ঞানের উপর পড়াশোনা করতে যান। সেখান থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাস্ট্রো-ফিজিক্স এর উপর করেন পিএইচডি। কৃষ্ণ বিবরের ঘূর্ণন পরিমাপ বিষয়ে পিয়ার রিভিউড জার্নালে তাঁর প্রকাশনা আছে!
এই কৃষ্ণ বিবরের গতির উপর পড়াশোনা করতে গিয়েই তিনি জিতে নিয়েছেন ২ লাখ ডলারের মার্কিন বৃত্তি।
এরপর যেন হার্ভার্ডই হয়ে যায় তাঁর ঠিকানা। কিন্তু বিস্মিত হই তখন যখন দেখি তিনি পদার্থবিজ্ঞান ছেড়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয়ে কেরিয়ার গড়েন, যা আমাদের দেশে এরকম একটি পর্যায়ে গিয়ে কল্পনার অতীত।
পড়াশুনার ফিল্ড বদলে পদার্থবিজ্ঞানের পরিবর্তে নিলেন জেনেটিক্স ও নিউরো সাইন্স। এ বিষয়ে পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেন হার্ভার্ডের Howard Hughes Medical Institute এবং Center for Brain Science এ। তিনি পোস্ট ডক্টরাল পর্যায়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবেও যোগ দেন সেখানেই। ২০১৩ থেকে এখন পর্যন্ত তিনি হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল অ্যান্ড বোর্ড ইন্সটিটিউট অফ এম আইটি অ্যান্ড হার্ভার্ডে জেনেটিক্স এ পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে আছেন। এখানে তিনি বিখ্যাত ইউকে বায়োব্যাংকের ৫ লাখ ডাটা নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল বিভিন্ন মানসিক রোগের সাথে সম্পর্কিত জিনগুলো মানব মস্তিষ্কে কিভাবে প্রভাব বিস্তার করে তার উপর।
নিজের লিংকড ইন প্রোফাইলে কেরিয়ার বিষয়ে রেবেকা বলেন, “ আমি ফিজিক্স ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছি। কিন্তু সম্প্রতি প্যাশন আবিষ্কার করেছি বায়োলজিতে। এখন জেনেটিক্স ও নিয়োরোসাইন্সের ইন্টারসেকশন নিয়ে কাজ করছি হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলে”
পড়াশোনায় সাফল্য পাবার পর নিজের প্যাশন আবিষ্কার করে সে অনুযায়ী পড়াশুনা ও কাজ পরিবর্তন করা নিঃসন্দেহে সাহসী সিদ্ধান্ত। জ্ঞানের প্রতি এই অনুরাগ অসাধারণ। আমাদের দেশে এখন বিসিএসসহ সরকারী চাকরি নিয়ে যে গড্ডালিকা প্রবাহ বেড়ে চলেছে তার বিপরীতে দাড়াতে রেবেকা শফি প্রেরণার নাম হতেই পারে। এই ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে মানুষ স্টার হবার জন্য বা নিছক মনোযোগ পাবার জন্য কি না করে!
তবে মনোযোগ পাওয়া যেমন সহজ তেমনি মনোযোগ না পাওয়া আরও সহজ। ফলে অনেক ভাল জিনিসও আমাদের চোখে পড়েনা অনেক সময়। কিন্তু এরকম রত্ন কেন এর আগে আমরা আগে খুঁজে পেলাম না সেটাই বার বার মনে হচ্ছে। আবার এও মনে হয় এরকম রত্ন কেন এখন আর তৈরি হচ্ছেনা? আগের মত বিতর্ক নিয়ে মানুষের আগ্রহ নেই নাকি কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সেরা বিতার্কিকরা?
দেশে এখন অনেক চ্যানেল, কিন্তু নব্বই দশকের বিটিভির বিতর্ক প্রতিযোগিতার মত সাড়া জাগানো শিক্ষণীয় অনুষ্ঠান এখন আর হয় না বললেই চলে কোন চ্যানেলে। দেশে বিতর্ক প্রতিযোগিতা এখনও হয়, কিন্তু সেসব সম্পর্কে সাধারণ মানুষেরা তেমন জানেনা। বাংলাদেশ বিতর্ক ফেডারেশনের নেতারা এ বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, যে পরিমাণ প্রতিযোগিতা হওয়া প্রয়োজন, সে পরিমাণ হচ্ছেনা, তাই ভাল বিতার্কিকও তৈরি হচ্ছেনা।
অথচ, কে না জানে, বিতর্ক প্রতিযোগিতা নেতৃত্ব ও মেধা তৈরিতে কতটা কার্যকর ভূমিকা পালন করে। উন্নত বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্ট্র প্রধান, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বসহ নানা পর্যায়ের মেধাবী ব্যক্তিত্বদের শিক্ষাজীবন ঘাঁটলে দেখা যাবে তাঁরা তাঁদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন তুখোড় বিতার্কিক। তাই আমরা কি আবার নব্বই দশকের মত সারা জাগানো বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন গণমাধ্যম থেকে আশা করতে পারিনা যেখানে তৈরি হবে হাজারো রেবেকা শফিরা?
তথ্যসূত্রঃ http://rebeccashafee.com,
রজত দাসগুপ্তের ফেসবুক ওয়াল