বুধবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৫, ১২:৫২:৪০

অদৃশ্য সুতো!

অদৃশ্য সুতো!

আবু এন এম ওয়াহিদ: উত্তর আফ্রিকায় অবস্থিত মরক্কোর বন্দর নগরী টেটোয়ান’এ International Foundation for Research and Development (IFRD) আয়োজিত দু’দিনের নবম আন্তর্জাতিক শিক্ষা ও তথ্য ব্যবস্থাপনা সম্মেলন এক দিনেই শেষ হয়ে গেল। সম্মেলনের ডেলিগেটদের বেশিরভাগই ছিলেন মুসলমান এবং এর সবকিছু ঠিকঠাক গেলেও ওই দিন সবার চোখে মুখে উৎকণ্ঠার একটা গভীর ছাপ স্পষ্টত ধরা পড়ল, কারণ ঠিক আগের দিন রাতেই ঘটে যায় প্যারিসের নারকীয় হত্যাকা-! সহি সালামতে সময়মত বাড়ি ফিরে আসতে পারব কিনা এ নিয়ে সারা দিন ধরে অংশগ্রহণকারীদের মনে একটা অজানা ভয় ও অনিশ্চয়তা দানা বাঁধতে থাকে। মনের অবস্থা যাই থাকুক, পেশাগত প্রয়োজনে যার যা করার তা তো করতেই হল। কেউ প্রবন্ধ উপস্থাপন করলেন, কেউ আলোচনা-সমালোচনা করলেন, মন্তব্য প্রতিবেদন রাখলেন, কেউ দিলেন প্লেনারি স্পিচ, কীনোট স্পিচ, কেউ সমাপনী বক্তব্য দিয়ে তাত্ত্বিক উপসংহার টানলেন। এভাবে মুখে বড় বড় বুলি আর বুকে থর থর ভয় নিয়ে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হল। রুমে ফিরে যাওয়ার আগে হোটেল শামস্-এর রেস্তোরাঁয় এক কাপ চা খেতে গিয়ে গল্পের ছলে আটকা পড়ে গেলাম। একই টেবিলে বসা আমরা পাঁচ জন। তার মাঝে আছেন তুরস্ক থেকে আসা জেরিন, রিদওয়ান ও জালাল; স্বাগতিক মরক্কোর বউজিয়ান, এবং বাংলাদেশি-আমেরিকান আমি একাই। চা খেতে খেতে পরিচয়, জানা জানি, এ কথা সে কথা - বলতে বলতে অনেক কথাই বলা হয়ে গেল। কে কী পড়ান, কোথায় পড়ান, কার গবেষণা-আসক্তি কী, কার বিশ্ববিদ্যালয় কেমন, কার প্রতিষ্ঠানে চাকরির ওয়ার্কলোড এবং সুযোগ সুবিধা কতখানি, কার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, এ সব কিছুই এজেন্ডায় উঠে এল, তবু যেন সব কথা বলা হল না। এ না বলা কথাগুলো নিয়েই আপনাদের উদ্দেশ্যে আজকে আমার এ মামুলি নিবেদন। আড্ডা শেষ করে উঠে যাব, এমন সময় জেরিন বলে বসলেন, ‘‘আমাদের কারো হয়ত আর দ্বিতীয়বার টেটোয়ান আসা হবে না, তাই এখানে যদি দেখার কিছু থেকে থাকে, তো দেখে যাই’’। সকলের বডি ল্যাঙ্গুয়েজেই একটা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া বোঝা গেল। সবার দৃষ্টি বউজিয়ানের দিকে, স্থানীয় লোক হিসেবে তিনি কী বলেন, কিন্তু মরক্কান হলেও তিনি এ অঞ্চলের নন। তাঁর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা কাসাব্লাঙ্কার কাছে ছোট্ট এক শহরে। তিনি পড়ানও ওদিককার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বউজিয়ান এ অঞ্চলের তেমন কিছু জানেন না, চিনেনও না। তবু তো তিনি মরক্কান, এ দেশের ভাষা জানেন, সংস্কৃতি জানেন। সবাই মিলে ঠিক করলাম, বউজিয়ান আমাদের হয়ে হোটেলের ফ্রন্ট ডেস্কে গিয়ে জিজ্ঞেস করবেন, আশেপাশে দর্শনীয় কিছু আছে কিনা, থাকলে দেখে যাব, এবং আজই। তিনি বয়সে সবার চেয়ে ছোট, কিন্তু বিদ্যা-বুদ্ধিতে কারো চেয়ে কম নন। বউজিয়ান বহু ভাষাবিদ। তিনি একাধারে ইংরেজি, ফরাসী, স্প্যানিশ, আরবী, এবং মরক্কান আরবী ডায়লেক্ট’এ মোটামুটি সমানভাবে পারঙ্গম। আমাদের ট্যুর গাইড হতে স্বেচ্ছায় বউজিয়ানের সম্মতিতে সবাই স্বস্তি পেলাম । আমরা বিদেশিরা খুশিমনে তাঁকে মোয়াল্লেম মানলাম। ফ্রন্ট ডেস্কের ডিউটি ক্লার্ক বললেন, পানি দেখতে চাইলে বাঁদিকে যান ১০/১১ মাইল দূরে সুন্দর সাগর তীর। পাহাড় দেখতে চাইলে ডানদিকে যান ৫/৬ মাইল দূরে পুরনো শহর মদিনা, চাইলে কেনাকাটাও করতে পারবেন। সফরকারীরা এক বাক্যে ডান দিকের পথই বেছে নিলেন। রাস্তায় নেমে বউজিয়ান ট্যাক্সি ডাকলেন, আমি তড়িঘড়ি করে রুমে গেলাম, কাপড় বদলে এলাম। এসে দেখি বিভ্রাট বেধেছে ট্যাক্সি নিয়ে। ট্যাক্সি কোনো অবস্থাতেই তিন জনের বেশি নেবে না, অথচ আমরা মানুষ পাঁচ জন। এটা তাদের রাজার আইন, সবার শিরোধার্য। ডাকা হল আরেকটা ট্যাক্সি। প্রম ট্যাক্সিতে উঠলেন জেরিন এবং বউজিয়ান। তার আগে বউজিয়ান উভয় ট্যাক্সিকে বলে দিলেন সিটি সেন্টারে গিয়ে আমাদের নামিয়ে দিতে। প্র ম ট্যাক্সি ছেড়ে দেবে এমন সময় রিদওয়ান আমার হাত ধরে জেরিন আর বউজিয়ানের ট্যাক্সিতে সামনের সিটে বসিয়ে দিলেন। তিনি এবং জালাল আমাদের পেছনে পেছনে আসতে থাকলেন, দ্বিতীয় ট্যাক্সি করে। ট্যাক্সি ধীর গতিতে চলতে লাগল। সবচেয়ে প্র ম যে বিষয়টা আমার নজর কাড়ল, তা হল বেশিরভাগ গাড়িই ১০ থেকে ১৫ বছরের বা তার চেয়েও বেশি পুরনো, এবং ছোট ছোট। আমি আমেরিকা থেকে গিয়েছি বলেই হয়তো এমনটা আমার মনে হয়েছে। অবশ্য এ ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করিনি। হোটেল শামস্ থেকে মদিনা সিটি সেন্টার পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য আর তেমন কিছু চোখে পড়ল না। মদিনা সিটি সেন্টার দেখে বেশ মুগ্ধ হলাম! পুরনো হলেও এতটা পুরনো লাগল না। রাস্তা ছিমছাম পরিষ্কার, দালান কোঠায় চকচকে সাদা রং, কোথাও শেওলা বা ময়লা নেই, আর জরাজীর্ণ বিল্ডিং বলতে গেলে চোখেই পড়ল না। বিশাল চত্বর ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরের মত। ছ’দিক থেকে ছ’টা রাস্তা এসে মিশেছে এক জায়গায়। শনিবারের রোদ ঝলমল বিকেল, শিরশিরে মিষ্টি হাওয়া। হাজার হাজার মানুষ ছুটছে স্রোতের মত এদিক ওদিক! এর মাঝে আমাদের সাথে এসে যোগ দিলেন রিদওয়ান এবং জালাল। শুরু হল আমাদের লক্ষ্যহীন হাঁটা। ট্রেনের ইঞ্জিনের মত সামনে বউজিয়ান - পেছনে আমরা চারজন। কখনো লাইন ধরে একজনের পেছনে আরেক জন, কখনো বা পাশাপাশি, হাঁটছি, কথা বলছি, আর দেখছি। মিনিট দশেকের মধ্যে অজানা এক গলি পথ ধরে শহরের এক প্রান্তে এসে দাঁড়ালাম। সামনেই পাহাড় - বিখ্যাত রিফ পর্বতমালার একাংশ। সূর্য পশ্চিম আকাশে একদম হেলে আছে, পাহাড়ের গায়ে সাদা সাদা পাথরে ডুবন্ত রবির আলোর রেখা পড়ে এক অপরূপ বর্ণিল রং ধরে আছে। সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত আমরা দাঁড়িয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখলাম, প্রাণভরে উপভোগ করলাম! তারপর জেরিন বললেন আর্গান তেল কিনবেন। খুঁজতে লাগলাম তেলের দোকান। কোথাও না পেয়ে বউজিয়ান দোকানিদের জিজ্ঞেস করে বের করলেন ছোট্ট এক তেলের দোকান। দামদর করে কেনা হল আর্গান তেল। মরক্কোর জঙলি আরগান তেল ত্বকের জন্য খুবই উপকারী, মেয়েরা কসমেটিক হিসেবে ব্যবহার করে। এর সুনাম দুনিয়াজোড়া। এটা খাওয়াও যায়, মরক্কানরা কুসকুস এবং পাস্টেলোর সাথে এটা খেয়ে থাকে। আরগান তেল - জয়তুন এবং কালিজিরার তেলের মত মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারি। কুসকুস সম্পর্কে যাদের ধারণা নেই, তাদের জন্য বলছি। এটা উত্তর আফ্রিকার প্রধান খাবার। বিশেষ এক ধরণের গম থেকে তৈরি করা হয়, আকারে সাগু দানার চেয়ে ছোটছোট। ভাতের মত রানড়বা করা হয়, তবে তফাৎ হল এতে তেল, মসলা, কিসমিস, বাদাম, ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। এটা খুব সুস্বাদু খাবার। ইদানিং এর জনপ্রিয়তা সর্বত্র ছড়িয়ে যাচ্ছে। আজকাল ইউরোপ-আমেরিকার কোনো কোনো ফাইন রেস্তোরাঁর মেন্যুতেও পাওয়া যায়। তারপর আবার আমাদের হাঁটার পালা। এবার হাঁটতে হাঁটতে যে বিষয়টা বিশেষভাবে আমার দৃষ্টি কাড়ল, তা হল মরক্কোয় নারীদের অবাধ বিচরণ! প্রতি তিন কি চার জন নারীতে মাত্র একজন পুরুষ। আরব দেশ এবং মুসলমান দেশ হলে কী হবে, তাদের নারীরা বাংলাদেশের চেয়েও বেশি বহির্মুখী। জেসমিন বিপ্লবের আগে তিউনিসিয়াতেও দেখেছি নারীদের এমন স্বাধীন চলাফেরা। তবে তিউনিসিয়ার মহিলাদের সাথে মরক্কোর মহিলাদের একটা মৌলিক তফাৎ আছে। তফাৎটা হল, পোশাক-পরিচ্ছদে তিউনিশিয়ানরা মরক্কানদের চেয়ে অনেক বেশি ইউরোপীয়। তিউনিশিয়াতে যেখানে পাঁচ থেকে সাত শতাংশ নারী হিজাব পরে, মরক্কোতে এ অনুপাত ঠিক তার উল্টো। অর্থাৎ এখানকার রাস্তায় পাঁচ থেকে সাত ভাগ মেয়েলোক বেহিজাবি, বাকি সবাই হিজাবি। গল্প করতে করতে হাঁটছি, হাঁটতে হাঁটতে আবার চলে এলাম সেই গোল চত্বরে - সিটি সেন্টারে। এবার দেখি মানুষের ভীড় আরো বেড়েছে। আমরা এবার অন্য পথ ধরে চলতে লাগলাম। ফুটপাথ থেকে আমি একটা সুয়েটার এবং চারটা টুপি কিনলাম। ভাবছিলাম মরক্কোর ঐতিহ্যবাহী একটা ফেজ টুপি কিনব, কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না। এক সময় গিয়ে দেখলাম, আমাদের রাস্তা শেষ হয়ে গেছে একটা বড় বিল্ডিংএর সামনে। দেয়ালঘেরা একটা পাকা আঙ্গিনা, তারপর বিশাল বড় দালান। আমরা প্রমে ভেবেছিলাম মসজিদ, পরে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, এটা বাদশার অবকাশকালীন এক প্রাসাদ। প্রাসাদের গা ঘেঁষে আমরা আরো ভেতরে গেলাম, যেতে যেতে গিয়ে ঢুকে গেলাম এক কাঁচা বাজারে, যেখানে মাছ মাংস তরিতরকারি বিঘ্নিত হচ্ছে। গন্ধে টেকা যাচ্ছিল না! ফিরে আসতে গিয়ে বুঝলাম আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি। যাই হোক, আমাদের সুদক্ষ গাইড লোকজনদের জিজ্ঞেস করে সঠিক পথ ধরে আমাদের বের করে নিয়ে এলেন ফের সিটি সেন্টারে। মদিনা দেখা শেষ। এবার বিদায়ের পালা। যার যার হোটেলে সবাই ফিরে আসব, হাজারো মানুষের মাঝে রাস্তায় দাঁড়িয়ে শেষ কথাটুকু বলার চেষ্টা করছি, বলছি, তবু ছোটগল্পের মত শেষ হয়েও যেন হচ্ছে না! একজন আরেকজনের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি। জালাল এবং রিদওয়ানের চোখ ছল ছল করছে! ভাবখানা কত দিনের চেনাজানা কত আপনজন আমরা সবাই! কেউ যেন কাউকে ছেড়ে আসতে চাচ্ছি না! অবশেষে রিদওয়ান তাঁর একখানা বিজনেস কার্ড আমার হাতে তুলে দিয়ে আলিঙ্গন করে নিকটে তাঁর হোটেলের দিকে হাঁটা দিলেন। আর আমরা চারজন দু’জন দু’জন করে আলাদা দুই ট্যাক্সি নিয়ে ফিরে এলাম হোটেল শামস- এ। ফিরে আসার সময় ট্যাক্সিতে বসে বসে আমার একটা নতুন অনুভূতি হল। আমরা পাঁচজন মানুষ তিন জাতের, তিন ভাষার, তিন দেশের। রিদওয়ান, জালাল, জেরিন জাতিতে তুর্কী, তাদের ভাষা তুর্কী, বউজিয়ান জাতিতে ‘বারবার’, ভাষা আরবী-ফরাসী, আমি বাঙালি-আমেরিকান। বুঝতে পারলাম, মদিনা দেখতে যাওয়ার আগে আমাদের মাঝে সম্পর্ক ছিল এক রকম, মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে ফিরে আসার প্রাক্কালে সে সম্পর্ক এক নতুন মাত্রায় উত্তীর্ণ হল! নিজেকেই নিজে প্রশড়ব করলাম, এর কারণটা কী? উত্তর আমি এভাবে খোঁজার চেষ্টা করছি। হতে পারে, পাঁচ জন মানুষ তিন জাতের, তিন ভাষার, তিন দেশের, তিন সংস্কৃতির; তা হলেও আমরা সবাই একই বিশ্বাসের সুতোয় গাাঁ, একই মালার ফুল, যে ফুল বাসি হয় না, শুকোয় না, খুশবু বিলায় চিরদিন! এ সুতো যত পুরনো, তত লম্বা; তার দৈর্ঘ্য বেড়েই চলেছে দিনকে দিন! এ সুতো অদৃশ্য, একে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, তবে অনুভূত হয়, সময় সময়! এ সুতো বড় মজবুত, একে ছিঁড়তে চাইলে ছেঁড়াও যায় না, এ বড় অম্ভুত! লেখক: অধ্যাপক - টেনেসী স্টেইট ইউনিভার্সিটি এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ। Email: [email protected] ২৩ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/প্রতিনিধি/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে