বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৯, ০৭:২৪:২৭

৬ ডিসেম্বর, সৃজিত-মিথিলার মিলনের দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ: তসলিমা

৬ ডিসেম্বর, সৃজিত-মিথিলার মিলনের দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ: তসলিমা

তসলিমা নারসিন : দু'জন অত্যন্ত প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন একটি বিশেষ দিনে। দিনটি ৬ ডিসেম্বর। ২৭ বছর আগে এই দিনটিতে ভারতের বাবরি মসজিদ ভে'ঙ্গে গুঁ'ড়ো করে দিয়েছিল হিন্দু মৌ'লবা'দীরা। 

প্র'তিক্রি'য়ায় মুসলিম মৌ'লবা'দীরা বাংলাদেশে হিন্দুদের ঘরবাড়ি দোকানপাট মন্দিরে হা'ম'লা করে। শত শত হিন্দু পরিবার আ'শ'ঙ্কায় আ'র্তনা'দ করেছে, মাতৃভূমি ত্যা'গ করার সিদ্ধান্ত নিতে বা'ধ্য হয়েছে। এই দিনটিতে সৃজিত মুখোপাধ্যায় এবং রাফিয়াত রশিদ মিথিলার মিলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থবহ।

ভারত এবং বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমানের একাংশের মধ্যে যে ঘৃ'ণা, যে সাম্প্রদায়িক বি'দ্বে'ষ- সেটির বি'রু'দ্ধে দুটি দেশের হিন্দু এবং মুসলমান দুই নর-নারীর পরস্পরকে ভালোবাসায় এবং নিবিড় বন্ধনে জড়ানোটিই তী'ব্র প্র'তিবা'দ।

বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে ভারতে চলে আসা নি'র্যা'তি'ত সংখ্যালঘুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য আইন সং'শো'ধন করতে একটি বিল ভারতের পার্লামেন্টের লোকসভায় পাস হয়েছে। ভারত সরকার জানিয়ে দিয়েছে, মুসলিমপ্রধান দেশে যে সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীরা ধর্মীয় কারণে হিং'সের শি'কা'র হন, তাদের নাগরিকত্বদান করার উদ্দেশ্যেই এই সংশোধনী। 

খোলাসা করে বলতে গেলে, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান থেকে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি, এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী অ'বৈ'ধ অভিবাসীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্যই এই বিল। আরও একটু খোলাসা করে বলতে গেলে, মুসলমান ছাড়া বাকি সব অভিবাসীর জন্য ভারতের দুয়ার খোলা। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই বিলের বিরুদ্ধে বি'ক্ষো'ভ চলছে। 

আ'প'ত্তির কারণ, সংবিধানের ৪ নম্বর অনুচ্ছেদে ভারতের সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে যে সমতার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, এই বিল তার প'রিপ'ন্থী। ধ'র্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়েছে সাতচল্লিশে। সেটি ছিল উপমহাদেশটির জন্য এক চরম দুঃ'সময়। ১০ লক্ষ হিন্দু মুসলমান পরস্পরকে খু'ন করেছে। সা'ম্প্রদা'য়িক ঘৃ'ণা আর হিং'সে ব'ন্ধ করার জন্যই নাকি ছিল দেশ ভাগ। দুঃ'সময় এখনও কাটেনি।

সারা ভারতবর্ষে জানি না ক'কোটি মুসলমান অ'ভিবা'সী অ'বৈধ'ভাবে বাস করছে। তাদের সবাইকে ধরে ধরে দেশ থেকে তা'ড়ালে জানি না তারা কোথায় ফিরবে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে অ'বৈ'ধভাবে ঢুকে যে গরিব মুসলমানেরা যুগের পর যুগ বাস করছে, উপার্জন করছে, ভিটেমাটি কিনেছে, ঘরবাড়ি গড়েছে, পরিবার বাড়িয়েছে- সব ফেলে তাদের চলে যেতে হবে কারণ তারা মুসলমান।

দরিদ্র বলে ভাগ্য ফেরাতে নিজের দেশ তারা ত্যা'গ করতে বা'ধ্য হয়েছিল। মানুষ চিরকালই এক স্থান ত্যা'গ করে আরেক স্থানে পাড়ি দেয়, উন্নত জীবনের আশায়। ভারতীয়রাও উন্নত জীবনের আশায় পাড়ি দেয় এশিয়ার ধনী দেশগুলোয়, ধনী মধ্যপ্রাচ্যে, ইউরোপ আমেরিকায়। সেসব দেশে স্থায়ীভাবে বাস করে।

ইউরোপ আমেরিকায় বিভিন্ন দেশ থেকে এমনকি ভারত থেকে আসা অ'বৈ'ধ অভিবাসীদের মানবিক কারণে নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া হয়। দরিদ্র লোক যখন অর্থনৈতিক কারণে নিজের দেশ ত্যা'গ করে, তারা কোন দেশে যাচ্ছে, সে কোন ধর্মাবলম্বীদের দেশ, তা দেখে না। বাংলাদেশের দরিদ্র মুসলমান দেখে না তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর দেশে বাকিটা জীবনযাপন করতে যাচ্ছে, তারা দেখে কোথায় গেলে অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা জুটবে। 

ভারতীয় হিন্দু যখন দেশ ত্যা'গ করে মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দেয়, তারা দেখে না এ ভূমি মুসলমানের ভূমি, বা যখন ইউরোপ আমেরিকায় পাড়ি দেয়, তারা দেখে না এ ভূমির সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক খ্রিস্টান। অর্থনৈতিক সচ্ছলতার কাছে ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তা কিছুই বড় নয়। মুসলমানেরা উন্নত জীবনের আশায় হিন্দুর দেশে, খ্রিস্টানদের দেশে, বৌদ্ধদের দেশেই প্রতিদিন পাড়ি দিচ্ছে। 

হিন্দুও তাই করছে। ধর্ম নিয়ে যতই গৌরব করুক মানুষ, স্বাধীনতা এবং সচ্ছলতার সামনে ধর্মের ভূমিকা নিতান্তই গৌ'ণ। দিন-রাত আমেরিকাকে গা'লি দেওয়া ক'ট্ট'র মুসলমানকে দেখেছি আমেরিকায় যাওয়ার সুযোগ পেলে আনন্দে আত্মহারা। কোথায় যায় তখন তার ধর্মের অহংকার? বি'ধ'র্মীর দেশের সুযোগ সুবিধে, নিশ্চিতি আর নি'রাপ'ত্তা উপভোগের জন্য তখন সে এক পায়ে দাঁড়িয়ে যায়।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সীমান্তে দেয়াল তুলতে চাইছেন। ইউরোপও ব্যস্ত কাকে থাকতে দেবে, কাকে দেবে না- এ নিয়ে। ভারতে নাগরিকপঞ্জি তৈরি হচ্ছে, নাগরিক বিল পাস হচ্ছে। যেন এর চেয়ে বড় এবং জরুরি কাজ এই মুহূর্তে কিছু নেই ভারত সরকারের। যেন দেশের সব নাগরিকের পেটে ভাত জুটছে, যেন সবারই মাথার ওপর ছাদ আছে, গায়ে কাপড় আছে, যেন সবারই শিক্ষা স্বাস্থ্য সব জুটছে, যেন দেশে কোনও বেকার নেই। 

নারী-পুরুষে বৈ'ষ'ম্য নেই, বর্ণ বি'দ্বে'ষ বলতে কিছু নেই। যেন সব স'ম'স্যার সমাধান হয়ে গেছে। শুধু অ'বৈ'ধ মুসলমান অধিবাসীরাই দেশের জন্য বিরাট এক সমস্যা। এদের তা'ড়ালেই আর কোনও স'ম'স্যা থাকবে না। ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়েছিল একবার, ধর্মের ভিত্তিতে আর কতকাল মানুষ ভাগ হবে, তা কেউ জানে না।

এই সময়ে সৃজিত আর মিথিলার মিলন, ভারত আর বাংলাদেশের মিলন, হিন্দু আর মুসলমানের মিলন। এই মিলনে সা'ম্প্র'দা'য়িকতার পিঠে চা'বু'ক পড়বে, এই মিলনে ঘু'চবে সং'স্কার, ছিঁ'ড়বে কাঁ'টাতা'র, ম'রবে বি'দ্বে'ষ। আসলে হয়তো কিছুই ঘু'চবে না, ছিঁ'ড়বে না, ম'রবে না,- কিন্তু ঘৃ'ণার বি'রুদ্ধে ছোট হলেও একটি প্র'তিবা'দ রচিত হলো। ঘৃ'ণা আর বি'দ্বে'ষকে দূর করতে হয় ভালোবাসা দিয়ে। কুসং'স্কারকে দূর করতে হয় মু'ক্তচিন্তা দিয়ে। ধর্মের ক'ট্ট'রপ'ন্থাকে দূর করতে হয় যু'ক্তিবাদ দিয়ে।

ভারতে যারা হিন্দু রাষ্ট্র চাইছে, তাদের যুক্তি হলো, মুসলমানদের বাস করার জন্য প্রচুর দেশ আছে পৃথিবীতে, হিন্দুর জন্য কেবল একটিই দেশ। বহিরাগত মুসলমানেরা প্রায় ৭০০ বছর রাজত্ব করেছে। হাজারও হিন্দু-মন্দির ভে'ঙ্গে'ছে, হিন্দুদের অ'ত্যা'চার করেছে, হিন্দুর দেশে বসে হিন্দুর কাছ থেকে কর নিয়েছে। মুসলমানেরা যদিও ভারতে বাস করে ভারতীয় বনে গিয়েছিল, ইংরেজরা তা করেনি। লু'টপা'ট করেছে, নি'র্যা'তন করেছে, গ'ণহ'ত্যা করেছে। তারপরও প্রচুর ভারতীয় মুসলমান শাসকদের ওপর যত রা'গ, তত রা'গ ইংরেজ শাসকদের ওপর নেই।

পাকিস্তান আলাদা হয়ে গেছে মুসলমানদের নিয়ে। স্বাধীন ভারত সব ধর্মাবলম্বীকে নিয়ে ঐক্যের ডাক দিয়েছে। দ্বি'জা'তিতত্ত্বের কোনও স্থান ভারতবর্ষে নেই। কিন্তু ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান অনুযায়ী শুধু অমুসলমানরা নি'র্যা'তিত হলেই নয়, মুসলমানরা নি'র্যা'তিত হলেও ভারতের তাকে আশ্রয় দেওয়ার কথা। মুসলমানরা তো সবাই মৌ'লবা'দী বা ক'ট্ট'রপ'ন্থি নয়। 

মুসলিমপ্রধান দেশগুলোয় উদারনৈতিক, মু'ক্তম'না, সমাজ- সংস্কারক মুসলিমরা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে মুসলিম মৌ'লবা'দী দ্বা'রা। সবাই তো আর ইউরোপ আমেরিকার ভিসা পায় না। অন্য মুসলিম দেশগুলো তাদের জন্য মোটেও নি'রাপ'দ নয়। বাঁচার জন্য প্রতিবেশী ধ'র্মনি'রপেক্ষ দেশই তাদের জন্য ভরসা। তারা যাবে কোথায়, হয় মুখে কুলুপ আঁ'টতে হবে, নয় মরতে হবে।

সৃজিত আর মিথিলার অর্থবহ বিবাহবন্ধন অসহিষ্ণু হিন্দু এবং মুসলমানকে বলছে, ঘৃ'ণা নয়, ভালোবাসাই সমাধান। নিজ নিজ ধর্ম বা বিশ্বাস ত্যা'গ না করেও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর সঙ্গে একত্র বাস সম্ভব। যার যার ধর্ম বিশ্বাস তার তার। এ কারণে কোনও সম্পর্কে চির ধরার কথা নয়। ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বৈষয়িক, ব্যবহারিক, সাং'গি'তিক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক বিশ্বাস নিয়ে মানুষ একত্র বাস করছে না? তবে ধর্ম বিশ্বাস ভিন্ন হলে এত কেন অ'নী'হা, এত কেন খু'নো'খু'নি?

শিক্ষিত সংস্কৃতিমনা মুক্তমনা প্রতিভাবান দুই ব্যক্তিত্ব সৃজিত আর মিথিলা এই সা'ম্প্রদা'য়িক টা'নাপড়ে'নের সময় নিশ্চিন্তের নির্ভাবনার নিঃশ্বাস নিতে দিচ্ছেন আমাদের। এইরকম হিন্দু মুসলমানের বিয়ে আরও হোক, দুই দেশের, দুই সংস্কৃতির মানুষের মিলন আরও হোক। এই মিলনই বি'রো'ধ আর বি'চ্ছে'দ ঘুচিয়ে শান্তির সহাবস্থান আনবে। আজ না হোক, কাল। যত ক্ষুদ্র আকারেই হোক, আমরা ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে চলেছি। আজ না হয় হিন্দু মুসলমানের মিলন নিয়ে অ'সন্তো'ষীরা ক'টা'ক্ষ করছে, ভবিষ্যতে এই মিলনই হবে মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন। মানবতার জয় একদিন না একদিন হবেই। লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে