আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : রাজা ইডিপাসের গল্প জানেন না এমন লোক আমার পাঠকদের মধ্যে আছেন তা ধা'রণা করি না। পৌরাণিক যুগের এই রাজা ছিলেন দয়ালু এবং প্রজাবৎসল। তার রাজ্যের মানুষ সুখী ছিল এবং রাজা ইডিপাসের নামে জয়ধ্বনি দিত।
এই ইডিপাসের রাজ্যে একবার ভ'য়াব'হ দু'র্ভি'ক্ষ শুরু হল। মানুষ দলে দলে অ'নাহা'রে ম'রতে লাগল। ইডিপাস বি'স্মি'ত হলেন। তিনি কোনোদিন কোনো অ'না'চা'র করেননি, প্রজাদের ওপর অ'ত্যা'চার করা দূরের কথা। তাহলে প্রকৃতি তার ওপর রু'ষ্ট হল কেন? তিনি তো সজ্ঞানে কোনো পা'প করেননি।
তিনি রাজদরবারে পণ্ডিতদের ডাকলেন এর কারণ জানার জন্য। তারা পাঁজিপুঁথি ঘেঁটে রাজাকে জানালেন, প্রকৃতি কেন তার ওপরে রু'ষ্ট হয়েছে, তার কারণ তারা জানতে পেরেছেন। কিন্তু রাজাকে সত্য জানাতে ভ'য় পাচ্ছেন। রাজা তাদের অ'ভ'য় দিলে পণ্ডিতেরা জানালেন, রাজার পা'পেই প্রজাদের এই দু'র্ভো'গ। রাজার পা'পটা কী? তার মায়ের সঙ্গে ব্য'ভিচার করেছেন।
এমন মহাপা'পের কথা রাজা ইডিপাস দুঃ'স্ব'প্নেও ভাবেননি। খোঁ'জ নিয়ে জানলেন, তিনি যে রাজ্য দ'খল করে রাজা হয়েছেন, সে রাজ্যের রানী ছিলেন তার মা। তিনি রাজ্যটি দ'খল করার পর না জেনে নিজের মাকে বিয়ে করেছেন। রাজা ইডিপাসের গল্প এ পর্যন্তই থাক। আমরা শুধু আমাদের আলোচনার উদাহরণ হিসেবে রাজা ইডিপাসের গল্পের এটুকু ব্যবহার করেছি।
পাঠকদের বলতে চেয়েছি, রাজা বা শা'সকদের পা'প ও অ'পকর্মের ফলেই আধুনিক যুগেও শা'সিত সমাজ বন্যা, দু'র্ভি'ক্ষ, ভূ'মিক'ম্প, মহামা'রী ইত্যাদি দ্বারা শা'স্তি পেয়ে থাকে। এখন যেমন বিশ্বত্রা'স করোনা মহামা'রী বা কোভিড-১৯ দ্বা'রা সারা বিশ্ব আক্রা'ন্ত। সারা বিশ্ব এখন আর পৌরাণিক যুগের বিশাল ও অজানা মহাবিশ্ব নেই।
বিজ্ঞানের দৌলতে বিশ্ব আজ গ্লো'বাল ভিলেজ বা বিশ্বগ্রাম। বিশ্বায়ন ঘটেছে সারা পৃথিবীর রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে এবং একইসঙ্গে মহামা'রীতেও। কোথায় কোন সুদূর চীনের এক অখ্যাত প্রদেশে করোনা ভাইরাসের জন্ম, মাত্র ডিসেম্বর মাসে তার জন্মের খবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে জানানো হয়েছিল, আর মার্চ মাসের মধ্যে তা সারা দুনিয়াকে গ্রা'স করেছে।
হিটলারের ঝটিকা বাহিনীও যা করতে পারেনি, এমনকি আমেরিকার দূরপাল্লার মিসাইলের এতটা দ্রুতগতিতে বিশ্ব পরিক্রমার ক্ষ'মতা নেই। দ্বিতীয় মহাযু'দ্ধেও রোজ একসঙ্গে এত সৈন্য ও মানুষের মৃ'ত্যু সংবাদ পাওয়া যায়নি। প্রকৃতির এই ভ'য়াব'হ মৃত্যু ছো'বলকে কী করে ঠে'কানো যাবে, বিজ্ঞানীরাও তা এখন পর্যন্ত নির্ধারণ করতে পারেননি। মানবতাবাদীরা বলছেন, এটা আমাদের শা'সকদের অ'না'চার ও পা'পের ফল।
বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে মানবতাবিরো'ধী নেতাদের আবি'র্ভাব এবং মা'রণা'স্ত্র নিয়ে তাদের প্রতিযোগিতামূলক অনাচার থেকেই এই স'র্বনা'শা ভাইরাসের জন্ম ও বিশ্ব মহামা'রীর আকার ধা'রণ। এই সত্যটা বিশ্ববাসীর চোখে ঢাকা দেয়ার জন্যই এই ভাইরাসের উৎস নিয়ে নানারকম গালগল্প ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
যে গল্পটি বাজারে বেশি চালু, তা হল এশিয়ার বহু দেশে, বিশেষ করে চীনে বাদুড় এবং প্যাঙ্গোলিন নামক প্রাণীর মাংস বাজারে বি'ক্রয় ও খাওয়া থেকে এই ভাইরাসের আবির্ভাব। তাই যদি হবে, তাহলে ডিসেম্বর মাসের শেষে যখন চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেইজিং-শাখাকে একটি নতুন ভাইরাস দেখা দেয়ার কথা জানিয়ে দিয়েছিল, তখন সামরিক শ'ক্তি ও বিজ্ঞানের শক্তিতে শক্তিমান আমেরিকা সেই খবরকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেনি কেন?
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কী করে বলেছিলেন, ''এটা সামান্য ফ্লু, দু'দিনেই চলে যাবে।'' সুইডেনের এক বিজ্ঞানী বলেছেন, বাদুড় বা অনুরূপ প্রাণীদেহের ভেতর থেকে ভাইরাস জন্ম নিতে পারে, কিন্তু তাকে ঘা'তক ভাইরাসে পরিণত করে বিশ্বকে ক্রমাগত দূ'ষি'ত করা! এটা বিস্ময়কর যে, এই ভাইরাস আরও আগে বিশ্বে হা'মলা চালায়নি।
কী প্রমাণ আছে আমেরিকা, চীন প্রভৃতি দেশের ক্রমাগত নিউ'ক্লিয়ার অ'স্ত্র ও জীবা'ণু যু'দ্ধের অ'স্ত্র বানানোর প্রতিযোগিতা থেকে পরিবেশ ভ'য়ান'কভাবে দূ'ষণের ফলে এই ভাইরাসের জন্ম হয়নি? সুইডেনের বিজ্ঞানীর এই প্রশ্নের জবাব এখন পর্যন্ত কেউ দেননি। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে রোজ রো'গাক্রা'ন্তদের সংখ্যা ও তাদের মধ্যে মৃ'ত্যুর হার অবি'শ্বাস্যভাবে বাড়ছে।
এই মহামা'রী সম্পর্কে সব দেশের সব খবর এখনও সঠিকভাবে প্রকাশ পাচ্ছে না। যেদিন প্রকাশ পাবে সেদিন মানুষ বি'স্মি'ত হয়ে দেখবে তারা কী ভয়াবহ মৃ'ত্যুর সমুদ্র পার হয়ে এসেছেন। এরই মধ্যে একটি আশার কথা, বিশ্বময় বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসের প্রতিষে'ধক তৈরির কাজে দিনরাত্রি চেষ্টা চালাচ্ছেন।
চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়া দাবি জানিয়েছে, তারা এই ভাইরাসের কোনো প্রতিষে'ধক নয়, তাকে ঠে'কিয়ে রাখার পন্থা আবিষ্কার করেছে। জাপান দাবি করেছে তারা এই ভাইরাস রোগের চিকিৎসার একটা প্রাথমিক ওষুধ আবিষ্কার করেছে। পরীক্ষাগারের কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেলে তারা তা বাজারে ছাড়বে।
সবচেয়ে অবিশ্বাস্য সুসংবাদ, বাংলাদেশের একটি আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত ওষুধ প্রতিষ্ঠানও দাবি করেছে, তারা এই রোগের একটা ওষুধ আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছে। এই ওষুধ কোম্পানির নাম বীকন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি। ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশ কতটা এগিয়েছে, তার প্রমাণ ক্যান্সারের ওষুধ তৈরিতে বীকনের সাফল্য এবং সারা বিশ্বে তার বাজার সম্প্রসারণ।
বীকনের মালিক এবাদুর রহমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের একজন জনপ্রিয় এমপি। এই বীকন করোনা ভাইরাসের এক ধ'রনের প্রতিষে'ধক তৈরিতে সক্ষম হয়েছে বলে জানা গেছে। ওষুধটি পরীক্ষাগারে আছে এবং স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাভের জন্য তাদের হাতে তুলে দেয়া হবে।
কেউ বলতে পারেন, 'হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।' আমি বলব, যখন জগৎজোড়া একটা সং'কট চলছে, তখন এই সং'কট মো'কাবেলায় যে কোনো দেশের যে কোনো ছোট প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দিতে হবে। কেউ জানে না, কখন কীভাবে কোভিড-১৯-এর প্রতিষে'ধক বেরিয়ে আসবে। তা যে বেরোবে তা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। কোভিড-১৯ আমাদের সমাজ-সভ্যতা সব কিছু পাল্টাবে।
শুধু পাল্টাতে পারবে না মানবতা ও মনুষ্যত্বকে। আমার কৈশোর কেটেছে দ্বিতীয় মহাযু'দ্ধকালে। তখন আমরা ব্রিটিশ শা'সনাধীন। হঠাৎ মহামা'রী আকারে বাংলাদেশে দেখা দেয় ম্যালেরিয়া। দোকানে কিংবা গ্রামের সরকারি ডাক্তারের কাছে প্যারাসিটামল এবং কুইনাইন ট্যাবলেট পাওয়া যেত না।
সরকার যু'দ্ধরত সেনাবাহিনীর জন্য দুটি ওষুধই বাজার থেকে তুলে নিয়েছিল। তখন এন্টিবায়োটিক ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। সবই ছিল সালসা জাতীয় ওষুধ। এই সময় আমাদের এলাকার কবিরাজেরা দল বেঁধে এগিয়ে এসেছিল ম্যালেরিয়ার পা'চন তৈরিতে। আমি তিন মাস রোগ শয্যায় শা'য়িত থেকে কবিরাজের দেয়া পা'চন খেয়ে ম্যালেরিয়ামুক্ত হয়েছিলাম।
নিরা'শা ও হতা'শায় ভে'ঙে না পড়ে বাংলাদেশের মানুষ যদি হেকিমি, কবিরাজি ইত্যাদি দেশীয় ওষুধের সন্ধান করেন এবং আমাদের হেকিম ও কবিরাজ সাহেবরাও ঘরে বসে এই প্রতিবে'ষক তৈরির কথা ভাবেন এবং কোনো সামান্য প্রতিষে'ধকও তৈরি করতে পারেন, তা মানুষকে রো'গমুক্ত করতে না পারলেও নিরা'শামুক্ত করতে পারবে। আমি আরেকটি উদাহরণ দেই।
ত্রিশের দশকে সারা বাংলাদেশে ভ'য়াব'হ কা'লা'জ্বর (Black Fever) দেখা দেয়। অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারেরা এর কোনো প্রতিষে'ধক দিতে পারেননি। এই সময় ব্রহ্মচারী নামের এক বাঙালি ডাক্তার একটি ওষুধ আবিষ্কার করেন। তা ব্রহ্মচারীর ইনজেকশন নামে পরিচিত হয়। ব্যা'পকভাবে সরকারি উদ্যোগে এই ব্রহ্মচারী ইনজেকশন দিয়ে বহু কা'লা'জ্বর রোগীকে নি'শ্চিত মৃ'ত্যুর হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছিল।
অবশ্য বিশ্বব্যাপী বর্তমান করোনা দা'নবের সঙ্গে অতীতের ম্যালেরিয়া বা কালাজ্বর মহামা'রীর তুলনা করা চলে না। এটা ভ'য়ং'কর ম'হাদা'নব। তবু এই দানব দ'মনের যু'দ্ধে ক্ষু'দ্র প্রচেষ্টাকেও স্বাগত জানাতে হবে। শুধু লক্ষ রাখতে হবে দেশের কোয়াক ও হাতুড়ে ডাক্তারেরা যেন এর সুযোগ গ্রহণ করতে না পারে।
কোনো কোনো প্রকৃতি বিজ্ঞানীও আশার ক্ষী'ণ আলো দেখাচ্ছেন। বলেছেন, ইউরোপে উইন্টার শেষ হয়েছে। ব্রিটেনে এবং বহু দেশে গরম আবহাওয়া দেখা দিয়েছে। আশা করা যায়, এবার ইস্টার হলিডের পর করোনার করুণা হবে। তারা পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে আপাতত বিদায় নেবেন। যে প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা আমাদের এই আশার বাণী শোনাচ্ছেন, তাদের মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। সূত্র : যুগান্তর