মিজানুর রহমান: মধ্যপ্রাচ্যেসহ গোটা দুনিয়ার শ্রমবাজার থেকে যখন একের পর এক দুঃসংবাদ আসছে, ঠিক সেই সময়ে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে একটি সুসংবাদ এসেছে। রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম ঢাকায় জরুরি চিঠি পাঠিয়ে খবরটি জানান। লিখেন- কোরিয়ায় করোনা সং'ক্রমণ শুরু হলে কিছু বাংলাদেশি ইপিএস কর্মী ছুটিতে গিয়েছিলেন। তাদের ছুটির মেয়াদও শেষ, দক্ষিণ কোরিয়াও করোনা বা কোভিড-১৯ সং'ক্রমণ থেকে প্রায় মুক্ত। সঙ্গত কারণেই সিউল চাইছে কমিটেড বাংলাদেশি ইপিএস কর্মীরা দ্রুত ফিরে যাক এবং তারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব বুঝে নিক।
শিল্পোন্নত কোরিয়ার প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারে বাংলাদেশি কর্মীদের সমস্যা এবং সম্ভাবনার বিস্তারিত তুলে ধরে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে রাষ্ট্রদূত কোরিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশি কর্মীদের সুনাম ধরে রাখা এবং রেমিটেন্স প্রবাহ অব্যাহত রাখতে জরুরি ভিত্তিতে স্পেশাল ফ্লাইটে ঢাকায় থাকা কর্মীদের সিউলে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানান।
রাষ্ট্রদূত ঢাকায় চিঠি পাঠানোর বিষয়টি স্বীকার করে মানবজমিনকে বলেন, করোনার এই ক'ঠিন সময়ে দুনিয়ার অন্যত্র যখন বাংলাদেশের শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়ার আশ'ঙ্কা দেখা দিয়েছে, সেই সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় বাংলাদেশি কর্মীদের কাজের সূযোগ বাড়ছে। যদিও দেশটির শ্রমবাজারে ভাষাসহ নানা রকম চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধ'কতার মুখোমুখি হতে হয় বাংলাদেশিদের।
ঢাকায় ছুটিতে ঢাকায় থাকা বাংলাদেশি ইপিএস কর্মীদের বিষয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, অনেকেই একটি কোম্পানীতে একটানা ৪ বছর ১০ মাস কাজ করেছে। ফলে এখন তারা ফিরলে আরও বেশি বেতনে কাজ পাবে। তাছাড়া বেশ কিছু ইপিএস কর্মী ছুটিতে যাওয়ার আগে কর্মস্থল পরিবর্তন করেছে। হয়তো নতুন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে না হয় কথাবার্তা বলে (কর্মস্থল পরিবর্তনে মধ্যবর্তী সময়ে) ছুটিতে গেছে। ৩ মাসের ছুটির নির্ধারিত সময় শেষে তাদের কর্মস্থলে যোগদান বা নতুন চাকরি খুঁজে নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বাংলাদেশি কর্মীদের কোরিয়ায় সুনাম রয়েছে জানিয়ে রাষ্ট্রদূত মিজ ইসলাম বলেন, খুশির খবর হচ্ছে কোরিয়ায় কোনো বাংলাদেশি করোনায় আক্রা'ন্ত হয়েছেন- এমন কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
করোনা নিয়ন্ত্রণের সুফল পেয়েছে মুন জা ইন ও তার দল:
২০ শে জানুয়ারি কোরিয়ায় প্রথম করোনা রোগী শনা'ক্ত হয়। এরপর এক মাস বেশ নিয়ন্ত্রণেই ছিল। কিন্তু আচ'মকা ফেব্রুয়ারির শেষ দশ দিনে এটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। ২৯ শে ফেব্রুয়ারি সর্বোচ্চ আক্রা'ন্ত বা শনাক্ত হয়, ৯০৯ জন। দক্ষিণ কোরিয়ার করোনাকালে এ দিনটি স্মরণীয়। স্থানীয় সূত্র এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেন রিপোর্ট মতে, কোরিয়ান সরকারের তড়িৎ পদক্ষেপে এটি এখন প্রায় নিয়ন্ত্রণে। মুক্তই বলা যায়, যদিও সাম্প্রতিক সময়ে করোনা জয় করা রোগীরা ফের আক্রা'ন্ত হওয়ার খবর আসছে সিউল থেকে। আল জাজিরার সর্বেশেষ রিপোর্ট মতে, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা ২২২ জন ফের করোনায় আক্রা'ন্ত বা শনা'ক্ত হয়েছে, যা উ'দ্বেগজনক।
দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, মেসিভ টেস্ট, ট্রেস এবং কন্টেইন- এই ৩ সূত্রই কোরিয়ায় করোনাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সফলতা দিয়েছে। আর এ সাফল্যের কারিগর হচ্ছেন প্রেসিডেন্ট মুন এবং তার দল। অবশ্য এর পুরস্কার তারা পেয়েছে ১৫ই এপ্রিল অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক নির্বাচনে। করোনায় দুনিয়া যখন স্ত'ব্দ, কোরিয়ায় তখন বেশ ঘটা করে জাতীয় নির্বাচন হয়।
ওই নির্বাচনে দেশটির জনগণ প্রেসিডেন্ট মুন জা ইনের দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে জাতীয় পরিষদের ৩০০ টি আসনের মধ্যে ১৮০টি উপহার দেয়। এটি রে'কর্ড, আগের নির্বাচনে ৬০টি আসন কম ছিল তাদের। বিশ্লেষকরা মুনের এ জয়কে স্ট্রেইট করোনা নিয়ন্ত্রণের ট্রফি বা পুরস্কার বলছেন। কারণ ১৯৮৭ সালে কোরিয়ার বর্তমান গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটি কোন দলের সবচেয়ে বড় জয়।
উল্লেখ্য, কোরিয়ার এবারের নির্বাচনের বিশেষ দিক ছিল তরুণ ভোটারদের প্রথমবারের মত ভোটাধিকার প্রদানের সূযোগ। ২০১৯ এর শেষের দিকে দেশটির জাতীয় পরিষদে সংস্কার বিল পাস হয়, যাতে ভোটাধিকার প্রদানের নূন্যতম বয়স ১৯ থেকে কমিয়ে ১৮ বছর করা হয়। এতে অনেক শিক্ষার্থী ভোট প্রদানের সূযোগ পায়। এতেও মুন জা ইনের ভোট বেড়েছে।
করোনা নিয়ন্ত্রণে কোরীয় মডেল, প্রশংসিত গোটা দুনিয়ায়
অত্যন্ত অল্প সময়ে কোরিয়ায় নিয়ন্ত্রণে আসে বৈশ্বিক মহামা'রি করোনা বা কোভিড-১৯। বলা যায় স্বতন্ত্র এক পদ্ধতি প্রয়োগ করে সিউল এটি নিয়ন্ত্রণে আনে, যাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমর্থন ছিল। স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বলছে, রেপিড অ্যান্ড এক্সটেনসিভ টেস্টই কোরিয়াকে দ্রুত সফলতা এনে দিয়েছে। কোরিয়া পশ্চিমা দুনিয়ার লকডাউন মডেল ফলো করেনি বরং নিজস্ব মডেলেই তারা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়া রো'ধে সক্ষম হয়।
এক হিসাবে দেখা গেছে, পাঁচ কোটি জনসংখ্যার দেশ কোরিয়ায় ২০ শে ফেব্রুয়ারি থেকে ১৭ মার্চের মধ্যে ২ লাখ ৭০ হাজার মানুষকে ল্যাবরেটরি টেস্টের আওতায় আনা হয়। তাছাড়া কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনের নিয়ম ভ'ঙ্গকারীদের জন্য দুই হাজার ৫০০ ডলার পর্যন্ত জ'রিমানার কঠোর ঘোষণাও কার্যকর ফল দেয়।
২৯ ফেব্রুয়ারি যে কোরীয়াতে করোনা শ'নাক্ত হওয়ার সংখ্যা ছিল ৯০৯, আজ সেখানে আক্রা'ন্তের সংখ্যা নেমে এসেছে ১৪ জনে। করোনা নিয়ন্ত্রণে কোরিয় মডেল আজ গোটা দুনিয়ায় প্রশংসিত হচ্ছে। সিউল আজ তার মডেল রপ্তানী করছে বন্ধু দেশগুলোতে। সঙ্গে তাদের রেপিড কিটও। সর্বেশেষ যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৩ লাখ ৭০ হাজার কিট নিয়েছে কোরিয়া থেকে। ওয়াশিংটনের এই দুর্দিনে পাশে দাঁড়ানোর জন্য চিঠি পাঠিয়ে সিউলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও। শুধু তা-ই নয়, কোরিয়ার কাছে আজ করোনা নিয়ন্ত্রণের দাওয়াই চাইছে বিশ্ব।
সিউলের একটি পরীক্ষার ফল এবং বাংলাদেশিদের অবস্থান
এদিকে সিউলে অল্প কদিন আগে ২০২০ সালের ২য় পর্বের পয়েন্ট বেইজ সিস্টেমে E-7-4 ভিসা প্রাপ্তদের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। সর্বমোট ভিসা পেয়েছেন ২৩১ জন।
নির্বাচিত মার্ক ছিল ৫৭
এই পর্বে ভিসা পেয়েছেন ৪৭ জন বাংলাদেশী। কোরিয়াতে বাংলাদেশি কর্মীদের পারফরমেন্স বা অবস্থান বিবেচনায় ওই পরীক্ষার ফলই যথেষ্ট- বলছে ইপিএস বাংলা কমিউনিটি ইন কোরিয়া। তাদের পক্ষ থেকে ভিসা প্রাপ্তদের অভিনন্দন জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশি ইপিএস কর্মীরা ফিরছেন ১ লা মে:
ওদিকে রাতে এ রিপোর্ট লেখার মুহুর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা মানবজমিনকে জানান, ঢাকায় ছুটিতে এসে আটকে পড়া বাংলাদেশি কর্মী ও শিক্ষার্থীদের দ্রুত ফেরাতে বোয়েসেল কাজ করছে। তারা বিমানের সঙ্গে কথাও বলেছিল। কিন্তু বিমানের ফ্লাইট ক্লিয়ারেন্স পাওয়া নিয়ে জ'টিলতা তৈরি হওয়ায় বিকল্প ভাবতে হচ্ছে। তবে এটুকু মোটামুটি নিশ্চিত যে, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে সব মিলে ৩ শতাধিক বাংলাদেশি (কর্মী ও শিক্ষার্থী) সিউলে ফিরছেন।-মানবজমিন