প্রবাস ডেস্ক : বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম নিউইয়র্কে সার্বজনীন সংবর্ধনা সমাবেশে বলেছেন, নানাবিধ কারণে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ। চারদিকে গুজব-গুঞ্জন যে, আবারো ১/১১-এর মত শাসন আসছে। এটি কারোরই কাম্য হতে পারে না। এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির শঙ্কা কেটে উঠতে গণতান্ত্রিক চেতনার জাগরণ ঘটাতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বসাধারণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
২০ সেপ্টেম্বর রোববার রাতে (বাংলাদেশ সময় সোমবার সকাল) ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা-সংগঠকদের আয়োজনে ‘প্রগতিশীল প্রবাসী বাঙালি সমাজ’র ব্যানারে নিউইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটসে পাবলিক স্কুল-৬৯ এর মিলনায়তনে সিপিবি নেতা মোজাহিদুল ইসলাম সেলিমের এ সংবর্ধনা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা গিয়াসউদ্দিন বাবুল। সেলিমের জীবনী উপস্থাপন করেন গোলাম মর্তুজা। স্বাগত বক্তব্য দেন চারণকবি ও লেখক বেলাল বেগ।
অনুষ্ঠানে পরিচালনা করেন যৌথভাবে জাকির হোসেন বাচ্চু এবং আলিমউদ্দিন।
সেলিম তার বক্তব্যে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ অত্যন্ত যত্ন সহকারে প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু সেই মর্মার্থ অনুধাবন করে সেসব অনুসরণ করা হচ্ছে না। যদি সকলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ অনুসরণ করেন, তাহলে বাংলাদেশের অবস্থা অনেক ভালো থাকতো। কিন্তু সেটি না ঘটে লাখ লাখ টাকা খরচ করে যারা হাজারো মানুষের মিছিল নিয়ে শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছতে পারেন এবং স্লোগান দিচ্ছেন ‘অমুক ভাইয়ের চরিত্র ফুলের মত পবিত্র’, তারাই নমিনেশন পাচ্ছেন। এভাবেই ওয়ার্ড কমিশনার থেকে পৌর মেয়র হয়ে অন্যসব নির্বাচনে নমিনেশনের বাণিজ্য চলছে। এটি এখন সর্বজনবিদিত।
বাংলাদেশের চলমান খুন-জখম আর হানাহানি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সিপিবি নেতা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক বিবাদে যত লোক খুন হয়েছে, তার চেয়ে ৬ গুণ বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে নিজ দলের ভেতরে বহুমুখী স্বার্থের কোন্দলে। যুবলীগের নেতারা যুবলীগকে মারছে, ছাত্রলীগের নেতারা ছাত্রলীগকে মারছে, আবার কখনো কখনো যুবলীগ কর্তৃক ছাত্রলীগ এবং ছাত্রলীগ কর্তৃক যুবলীগের নেতা খুনের ঘটনাও ঘটছে। টেন্ডার বাক্স দখলের লড়াইয়েও নিজ দলীয় নেতা-কর্মীরা খুনের শিকার হচ্ছে।
সেলিম বলেন, সন্ত্রাস আগেও হয়েছে। তবে বর্তমানের মত কখনো দেখিনি। রাজনৈতিক সন্ত্রাসের ভয়াবহ চিত্র দেখেছি ১৯৭৩ সালে। মহসিন হলের ৯ ছাত্রলীগ কর্মীকে হত্যার ঘটনায়ও ছাত্রলীগের নেতা শফিউল আলম প্রধান দণ্ডিত হয়েছিলেন। এরপর জিয়াউর রহমান তার দণ্ড মওকুফ করে দিয়েছেন। এভাবেই খুনিরা রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছে এরশাদের আমল হয়ে খালেদা জিয়ার আমল পর্যন্ত।
তিনি বলেন, বর্তমানের মন্দের চেয়েও একটু ভালো হিসেবে কি আমরা খালেদা জিয়াকে চাইবো? এটি হতে পারে না। আমরা জীবনে হয়তো সুস্থ রাজনীতির ধারায় ফিরতে সক্ষম হবো না। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যতো একটি নতুন রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টি করে যেতে পারি?
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, হোয়াট ইজ বিকল্প? বিকল্পধারা একটি আছে বি. চৌধুরীর নেতৃত্বে। সেটি মোটেই বিকল্প ধারা নয়। জিয়াউর রহমানের স্ত্রীর আনুগত্য পাবার জন্য জিয়ার প্রশংসা করছেন বি. চৌধুরী। একইভাবে শেখ হাসিনার প্রশংসাতেও তার আপত্তি নেই, যদি তার পুত্রের নমিনেশনের গ্যারান্টি পেয়ে যান। এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না।
সেলিম বলেন, গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়নকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের তাঁবেদার বুদ্ধিজীবীরা গলা ফাটাচ্ছেন। তাঁবেদার বুদ্ধিজীবী দিয়ে বলানো হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রয়োজন আগে নয়। উন্নয়ন আগে এবং গণতন্ত্র পরে। মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটলে গণতান্ত্রিক চেতনাও ধারালো হবে। এমন যুক্তি করা হয়েছে এরশাদ ও খালেদার আমলেও। শেখ হাসিনার আমলেও সেটি অব্যাহত রয়েছে।
তিনি বলেন, ভুলে গেলে চলবে না যে, শেখ হাসিনার অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী/উপদেষ্টা ছিলেন। সুতরাং মুহিত’স ইকনোমির যাঁতাকলে বাংলাদেশিরা পিষ্ট হচ্ছেন, গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে।
সেলিম অভিযোগ করেন, রাজনৈতিক আদর্শ আজ অর্থনৈতিক স্বার্থে সমঝোতা হচ্ছে। এটি কোনোভাবেই ভালো লক্ষণ নয়।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের লোকজন আরো জোরালোভাবে উল্লেখ করছেন যে, নির্বাচন হবে, এতে কোন আপত্তি নেই। তবে সে নির্বাচনে এই সরকারকেই ক্ষমতায় রাখতে হবে উন্নয়নের গতি অব্যাহত রাখতে। উদাহরণ হিসেবে মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদের নামোল্লেখ করা হচ্ছে।
সেলিম বলেন, দেশের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। একটি পরিবর্তন চাচ্ছেন সবাই। কিন্তু বিকল্প শক্তির সন্ধান পাচ্ছেন না। ভরসা করার মত কাউকে সামনে তারা দেখছেনও না।
সেলিম বলেন, ‘চারদিকে অনেক গুজব, ১/১১ এর মত সরকার এই আসলো বলে। আবার কেউ বলছেন, এইভাবে, ওইভাবে ম্যানেজ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনার বিকল্প খালেদা জিয়া হতে পারেন না। কিংবা বিএনপিও আওয়ামী লীগের বিকল্প হতে পারে না। কারণ, খালেদা যদি জামায়াত ত্যাগ না করেন তাহলে বিএনপি-জামায়াত জোট পুনরায় ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের অবস্থা আরো ভয়ঙ্কর হতে বাধ্য। আরো সর্বনাশের পথে ধাবিত হবে বাংলাদেশ। তেমন অবস্থা আমরা কেউই দেখতে চাই না।
কম্যুনিস্ট পার্টির এই নেতা আরো বলেন, দেশব্যাপী জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে জামায়াতের বিরুদ্ধে। জনমত সৃষ্টি করতে হবে খালেদা জিয়াকে জামায়াত ত্যাগে বাধ্য করার জন্য। আমরা সবচেয়ে বেশি খুশি হবো, যখন দেখবো যে, বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করেছে। কারণ, এমন একটি অবস্থা ঘটলে দেশও বহুবিধ নাজুক পরিস্থিতির শঙ্কা মুক্ত হবে। উন্নয়নের গতি আরো ত্বরান্বিত হবে।
সেলিম বলেন, জনগণের রায়ে সরকার গঠনের প্রক্রিয়ায় যেতে হবে শেখ হাসিনাকে। উন্নয়ন আগে, গণতন্ত্র পরে-এ ধারা পরিহার করতে হবে। নির্বাচনের নামে প্রহসনের খেলা শুরু করেছেন সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান। এরপর এরশাদের আমলেও তা ঘটতে দেখেছি। এখনও কেন সে ধরনের তামাশা অবলোকন করতে হবে? প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছাড়াই সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে নির্বাচিত হবার মধ্যে গণতন্ত্রের নাম-নিশানা থাকতে পারে না।’
‘মানুষ যদি তার অধিকার সম্পর্কে একটি উন্নত বাস্তবতায় যেতে না পারে, রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিতে সর্বসাধারণের মতামতের প্রতিফলন না ঘটে, তাহলে সেখানে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। পাকিস্তান আমলে যে বক্তৃতা দিয়েছি, এখনও সেই বক্তৃতাই করতে হচ্ছে, এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কী হতে পারে’-মন্তব্য সেলিমের।
সেলিম সরকারের দ্বৈতনীতির কঠোর সমালোচনা করে বলেন, নির্বাচনের বাস্তবতা অস্বীকার করতে না পেরে ক্ষমতাসীনরা আন্তর্জাতিক মহল এবং দেশের সহজ-সরল মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছে এই বলে যে, উন্নয়নের যে ধারা সূচিত হয়েছে, তা অব্যাহত রাখার জন্যই বর্তমান সরকারকে আরো বহুদিন ক্ষমতায় রাখতে হবে।
‘আর এ জন্যই নির্বাচনের নামে প্রহসনের নাটক মঞ্চস্থ করার বিকল্প থাকবে না’- বলেন সেলিম।
সেলিম উল্লেখ করেন, ক্ষমতায় থাকার অভিপ্রায়ে যে খেলা চলছে, তা থেকে আওয়ামী লীগ সুদূরপ্রসারী কোন লাভ পাবে বলে মনে করি না।
সেলিম বলেন, রাজনীতিকে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে যখন ষড়যন্ত্রের খেলায় পরিণত করবেন, তখনই কিন্তু সমস্যার উদ্ভব হয়। ১/১১ এর মত শাসনের আবির্ভাব ঘটে। এহেন শঙ্কা থেকে বেরিয়ে আসার প্রথম শর্তই হবে, জামাত-শিবিরের সংশ্রব পরিহার করা। জামাত-শিবিরের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড এবং ধর্মের দোহাই দিয়ে অপকর্মের উৎসগুলো সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। সামাজিক জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে।
সেলিম বলেন, সামাজিক বিপ্লব বা জাগরণ ব্যতিত জামাত-শিবিরকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হবে না।
চলমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে সিপিবি নেতা বলেন, ‘প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের কমকাণ্ডে ব্যাপক জনগোষ্ঠির মধ্যে সৃষ্ট হতাশা এবং বিকল্প গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা উত্থানের ব্যাপারে সর্বসাধারণের মধ্যে যে দ্বিধা রয়েছে, তা দূর করা সম্ভব হবে যদি বাম রাজনীতিক-কর্মীদের কাছে সত্যিকারের আশার বার্তা পৌঁছানো সম্ভব হয়। তাহলেই হতাশা কেটে যাবে এবং বামপন্থিরাই বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারবে। -আমাদের সময়
২১ সেপ্টেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম