বৃহস্পতিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬, ০১:২৯:২২

শৃংখল ভেঙেছি আমি : তসলিমা

শৃংখল ভেঙেছি আমি : তসলিমা

তসলিমা নাসরিন : পায়ে একটা শেকল ছিল আমার। শক্ত শেকল। সেই শেকলটা এই সেদিন আমি ভেঙেছি। ভেঙে, দিল্লি থেকে বেরিয়েছি, ভারতের অন্য শহরে ঢুকেছি। এতকাল দিল্লির বাইরে বের হওয়া মানে ছিল ভারতের বাইরে বের হওয়া।

দিল্লি ছাড়া ভারতের অন্য কোনও রাজ্যে আমি প্রবেশাধিকার পাবো না, পেলেও সে রাজ্যের মুসলমানরা আমার বিরুদ্ধে মিছিল মিটিং করবে।  রাজ্য সরকার আমাকে তড়িঘড়ি বিদেয় করবে। এরকমই জানতাম। কিন্তু সেই জানাটা যে রাজ্য ভুল প্রমাণ করলো, সে কেরালা।

শেকলটা আমাকে পরানো হয়েছিল ২০০৭ সালে। হায়দারাবাদের প্রেসক্লাবে আমার ওপর হামলা হওয়ার পর। আক্রমণকারীদের অবশ্য শাস্তি দেয়নি কেউ। আক্রান্তকেই দিয়েছে। আমাকে আমার কলকাতার বাড়িতে গৃহবন্দি অবস্থায় থাকতে হয়েছিল চার মাস। চাপ দেওয়া হয়েছিল কলকাতা থেকে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য থেকে, অথবা ভারতবর্ষ থেকে যেন দূরে কোথাও চলে যাই আমি। আমি কিন্তু মেরুদণ্ড শক্ত করে ছিলাম। ওদের অনুরোধে, আদেশে, হুমকিতে, চোখ রাঙানিতে এতটুকু কাঁপিনি।

একটা সাজানো দাঙ্গার আয়োজন করে শেষ অবধি আমাকে তাড়িয়ে ছেড়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার।  গিয়ে পড়েছিলাম রাজস্থানে। ওখান থেকেও তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এক রাজ্য তাড়ালে, সব রাজ্যই তাড়ায়। সে রাজ্য যে দলই শাসন করুক না কেন। শেষ অবধি রাজধানীতে সামান্য স্থান জুটলো। কিন্তু ওই রাজধানী থেকেও সাড়ে তিন মাস পর ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করেছে। রাজনীতি তখন অমনই ছিল। বারবার ফিরেছি ভারতবর্ষে। বারবারই আমাকে পত্রপাঠ বিদেয় করা হয়েছে।

তিন বছর পর অবশ্য ভারতবর্ষে বাস করার রাজনৈতিক অনুমতি পেয়েছি। আইনের অনুমতি যদিও সবসময় ছিল। আইন অমান্য রাজনীতিকরা যে কিভাবে করে তা না দেখলে বিশ্বাস হবে না। তখনই আমাকে সরকার পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের সরকার তোমাকে চায় না, ওখানে যাওয়ার চেষ্টা করো না।

কোনও রাজ্যই তো আমাকে চাইবে না। কোনও রাজ্যেই তাহলে আমার যাওয়া চলবে না। সব রাজ্যই ভাববে আমার উপস্থিতিতে মুসলমানরা উত্তেজিত হবে, দাঙ্গা টাঙ্গা বেঁধে যাবে। এই ভেবে আমি চুপ হয়ে ছিলাম। ভেবেছিলাম দিল্লির বাইরে বুঝি কোথাও আর কখনও যাওয়া চলবে না। কত কত আমন্ত্রণ যে ফিরিয়ে দিয়েছি। দিল্লির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বক্তৃতার জন্য ডেকেছে। যাইনি। কিছু দিন আগে দিল্লিতে টাইমস অব ইন্ডিয়ার লিটারেচার ফেস্টিভেল আর দিল্লি লিটারেচার ফেস্টিভেলে যোগ দেওয়ার পর আশংকা কিছুটা কেটেছে।

ওই ফেস্টিভেলগুলোয় শর্ত দিয়েছিলাম, আমার নাম কোথাও যাবে না, কোনও খবরে বা বিজ্ঞাপনে। আমি আচমকা উপস্থিত হবো। আয়োজকরা আমার শর্ত মেনে নিয়েছিলেন।

এই প্রথম দিল্লির বাইরে কোথাও যেতে আমি প্রস্তুত হলাম। কেরালা লিট ফেস্টে যোগ দেওয়ার জন্য প্রখ্যাত মালায়ালি লেখক এবং কবি সচ্চিদানন্দনের আমন্ত্রণে আমার মনে হলো এবার হয়তো বাইরে বের হওয়ার সময় হয়েছে, গায়ে তো অনেক মরচে ধরলো। বলে দিলাম, যাবো। পায়ের শেকল ঝনঝনিয়ে উঠলো। ঘনিষ্ঠ বন্ধু যারা আমার পরিকল্পনা আঁচ করতে পেরেছে, তারাই বলেছে না যেও না, কালিকুটে প্রচুর মুসলমান। ভয় হয় কী জানি কী হয়। লক্ষ্য করলাম আমি কারও বাধা মানছি না।

বাধা মানছি না তারপরও হায়দারাবাদের ঘটনা মনে পড়ে  একটুখানি ভয় ভয় লাগছিল। কিন্তু ফেস্টিভেলের আয়োজকরা, সচ্চিদানন্দনও, আমাকে আশ্বাস দিলেন। বললেন, কালিকুট ভালো জায়গা, এখানের মুসলিমরা অনেক শান্তিপ্রিয়। আমার ওপর কোনও আক্রমণ হবে না। শেষ পর্যন্ত গেলাম। কালিকুটে নেমে দেখি, আমার জন্য অগুনতি পুলিশ এয়ারপোর্টে। আরও অবাক কাণ্ড। শত শত টুপিপরা মুসলমান দাঁড়িয়ে আছে।

ওরা কি আমাকে মারতে এসেছে নাকি কেরালার মাটিতে আমার পা দেওয়ার বিরুদ্ধে মিছিল করতে এসেছে! এয়ারপোর্টের অফিসাররা জানালেন ওরা ওদের কোনও এক ধর্মগুরু আসছে হায়দারাবাদ থেকে, তাকেই দেখতে এসেছে। যত তাড়াতাড়ি পারি এয়ারপোর্ট থেকে আমি বেরোতে চাইছি। আমার গাড়ির সামনে পেছনে পুলিশের প্যাঁ পুঁ গাড়ি। দ্যা রাভিজ নামের এক পাঁচতারা হোটেলে নিয়ে এলো। হোটেলেও আমার দেহরক্ষী-পুলিশে গিজ গিজ করছে।

আয়োজকদের বললাম, পুলিশ কমিয়ে দাও। এত পুলিশ দেখে আমার অস্বস্তি হচ্ছে। আমি ভিআইপি নই। ডেথথ্রেট আছে বলে পুলিশি পাহারা আছে। কিন্তু পুলিশের সংখ্যার তো একটা সীমা আছে। কিন্তু জেড সিকিউরিটিতে সীমা টীমা একটু কমই থাকে। অন্য রাজ্যে দেখিনি, কিন্তু কেরালায় দেখলাম বেশ ক’জন মহিলা পুলিশ আমার বডিগার্ড। মহিলাদের কোমরে পিস্তল। দেখে ভালো লাগলো। কিন্তু হোটেল রুমের দরজায় রাতে পঁচিশজন পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকার কোনও মানে হয় না।

হোটেল আমাকে স্বাগত জানালো। গলায় একটা এলাচ আর লবঙ্গের মালা পরিয়ে দিল। কপালে লাগিয়ে দিল চন্দনের ফোঁটা। এলাচের মালা আমি বোধহয় প্রথম পরেছি। কেরালায় আগেও গিয়েছি আমি, তবে কালিকুটে এই প্রথম। কেরালায় আগে যে জিনিসটা লক্ষ্য করেছি, এবারও করলাম, সবাই হয় মালায়ালাম বলবে নয়তো ইংরেজি বলবে, কিন্তু হিন্দি বলবে না।

অনুষ্ঠান হচ্ছে কালিকুটের সমুদ্র সৈকতে। আইডিয়াটা নিঃসন্দেহে চমৎকার। পরদিন সৈকতের ফেস্টিভেলে ঢোকার পথে সাংবাদিক আর ফটোগ্রাফারদের তুমুল ভিড়। কেন? কী করে ওরা জানলো আমি আসবো? আমার নাম তো কোথাও লেখা হয়নি। না খবরে, না বিজ্ঞাপনে, না ফেস্টিভেলের প্রোগ্রামে!

আয়োজকদের মধ্য থেকে কেউ একজন বললেন, ‘হয়তো গন্ধ পেয়েছে তোমার’। আমার গা থেকে কি গন্ধ বেরোয়! হয়তো পুলিশের আনাগোনা দেখে টের পেয়েছে। আমার অনুষ্ঠান শুরু হলো। জ্যাম প্যাকড প্যাভিলিয়ন। মঞ্চে উৎসবের প্রেসিডেন্ট সচ্চিদানন্দনের সঙ্গে সাহিত্য, নারী, সমাজ, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে দেড় ঘণ্টা কথোপকথন চললো। আমার কিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পড়লাম।

সচ্চিদানন্দনও আমার কবিতা পড়ে শোনালেন। দর্শকের সারিতে অনেক শিক্ষিত মানুষ ছিলেন, মুসলমানও ছিলেন। ভিড় থেকে কেউ চিৎকার করেননি, আমাকে মারতে উঠে আসেননি। সকলের উপস্থিতিতেই নিজের বিশ্বাসের কথা বলে গেছি। কাউকে খুশি করার জন্য, বা কাউকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য আমি কখনও কিছু বলি না।

কালিকুট ছেড়ে আসার আগে ইন্টারভিউ, সেলফি, অটোগ্রাফ, সমুদ্র দেখতে দেখতে চা খাওয়া, এম গ্রিলে সিফুড ডিনার, ভোরের সমুদ্রপাড়ে হাঁটাহাঁটি ইত্যাদি হলো। আরেকটা অদ্ভুত জিনিস ঘটেছে। কালিকুটে মিডিয়া ওয়ান নামের এক টিভি চ্যানেল আমার লম্বা একটা ইন্টারভিউ নিয়েছে। একেবারে হোটেল রুমে এসেছিল ইন্টারভিউ নিতে।

ইন্টারভিউ শেষে সাংবাদিকের নাম জিজ্ঞাসা করলাম, বললো সোহেল। সোহেল মুসলমান। আরও জানলাম ‘মিডিয়া ওয়ান’ জামায়াতে ইসলামীর নিজস্ব চ্যানেল। সাংবাদিক আর ক্যামেরাম্যান চলে গেলে কিছুক্ষণ গলায় হাত বুলোলাম। গলাটা এখনও আছে, এখনও মরিনি।

‘কেরালা লিটারেচার ফেস্টিভেল’-এর সকলেই বললো কালিকুটের মুসলমানরা খুব ভালো। হ্যাঁ মুসলমানরা ভালো, তারা ভায়োলেন্সে বিশ্বাস করে না, কিন্তু ওদের একজনও আমার মুণ্ডু চায় না, এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য কথা নয়। কালিকুটের রাস্তায় টুপি আর বোরখা পরা প্রচুর মুসলমান দেখেছি।

এরা কেউই ইসলামের কঠিন নীতি মানেন না— মানতে মন চাইলো না! কালিকুটের মুসলমানরা মূলত বহরা মুসলমান। এই বহরা মুসলমান অতি রক্ষণশীল। এদের আদিপুরুষ মিশর থেকে এসেছিল। নিয়ে এসেছিল ফিমেল জেনিটাল মিউটেলেশান। নারীর যৌনাঙ্গকর্তনের রীতি। এখনও বাচ্চা মেয়েদের যৌনাঙ্গহানি ঘটায় ওরা। এই তথ্য দেওয়ার পর লক্ষ্য করলাম বহরা মুসলমানদের ইতিহাস সম্পর্কে ফেস্টিভেলের অমুসলমান কর্তারা খুব একটা জানেন না।

কেরালার খাবার আমার খুব একটা কখনও ভালো লাগেনি। তবে শনিবার রাতে এম গ্রিলে বেশ ভালোই লেগেছে ঝাল ঝাল স্কুইড, নারকেল-চিংড়ি, চালের রুটি উপ্পাম, কালিকুট বিরানি। এম গ্রিল থেকে বের হয়ে লক্ষ্য করি কিছু মুসলমান তরুণী রেস্টুরেন্টের বাইরে বসে আছে। সম্ভবত ভেতরে আসন পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। মেয়েগুলোর মাথায় হালকা হিজাব।

শাড়ির আঁচল বা ওড়না আলতো করে মাথায় দিয়ে রাখা। আমি পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করি মেয়েরা দাঁড়ালো, কাছে এগিয়ে এলো। ওদের মুখে স্মিত হাসি। ভেবেছিলাম আমাকে তিরস্কার করবে, গালি দেবে। কিন্তু দিল না, কোনও কথাও বললো না, দুটো শিশুকে বরং আমার দিকে এগিয়ে দিল, শিশুরা আমার অটোগ্রাফের জন্য অনুরোধ করলো, ওদের নাম লিখে অটোগ্রাফ দিলাম।

একজনের নাম আজিম, আরেকজনের নাম সারা। শিশুরাই বললো, ‘আমরা তোমার ফ্যান, তোমার লেখা পছন্দ করি’। আমার না বোঝার কথা নয় যে, ওই শিশুরা আমার ফ্যান নয়, ওই শিশুরা আমার বই পড়েনি।  পড়েছে ওই মেয়েরা, যে কথাটা ওই মেয়েরা কাছে এসে বলতে পারেনি, তা ওই শিশুদের দিয়ে বলিয়েছে।

আশা করছি, শুধু আশাই নয়, স্বপ্নও দেখছি, ওরা একদিন ওদের প্রতিবাদের ভাষা উচ্চারণ করার সাহস অর্জন করবে। ওরা আর ওদের (প্রকাশ অযোগ্য) কেটে ফেলতে কাউকে দেবে না।  নিজের সম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচবে। বিডি প্রতিদিন

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে