সৈয়দ আলী আকবর, প্যারিস (ফ্রান্স) থেকে: জাতি সত্ত্বার অন্যতম এক উপাদান হলো ভাষা। একটি সমৃদ্ধশালী ভাষা একটি জাতির উন্নতির সোপান।বিশ্ব দরবারে পরিচিত হওয়ার উপাদানগুলোর মধ্যে মাতৃভাষাই হচ্ছে একমাত্র উপাদান যা দ্বারা জাতি তার ধ্যান-ধারণা চিন্তা-ভাবনা সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে পারে। কেননা সুচিন্তার সুস্পষ্ট প্রকাশই জাতির পথপ্রদর্শক ও উন্নতির প্রধান শর্ত।
যেকোন জাতিই তার আশা-আখাংকা, ব্যবসা-বাণিজ্য, জ্ঞানচর্চা ইত্যাদি সকল কাজ মাতৃভাষায় সম্পূর্ণ করে থাকে। মাতৃভাষা সেই ভাষা যা মানুষ জন্মলগ্ন থেকে তার মায়ের মুখ থেকে শুনে শুনে শিখে। আর এভাবে শিখা ভাষাটিই একজন মানুষের কাছে সাবলিল ও সুন্দরতম ভাষা হয়ে উঠে যা তার জাতীয় জীবনে সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
একজন মানুষের অস্তিত্বকে ধ্বংস করতে হলে যেমনি তার প্রাণনাশ প্রয়োজন ঠিক তেমনি একটি জাতির অস্তিত্ব ধ্বংস করে দিতে হলে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে তার ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে যা বিশ্ব দরবারে তার পরিচয় নির্ধারণী হিসেবে কাজ করে।
বাঙ্গালীর অস্তিত্বকে ধ্বংস করে দেয়ার লক্ষ্যে তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রিয় সরকার বাঙ্গালী জাতির শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংসের চেষ্টা চালায়। এই ধ্বংস যজ্ঞের শুরুতেই তারা আঘাত করে বাংলা ভাষার উপর। পাকিস্তান সরকার ঘোষনা করে যে উর্দূই হবে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা। কিন্তু বাঙ্গালীরা প্রতিবাদ করে এবং বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সাল থেকেই আন্দোলন শুরু করে। ১৯৪৮-১৯৫২ সাল পর্যন্ত চলমান এই আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ ছিল ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি যা ইতিহাসে "ভাষা আন্দোলন" নামে খ্যাত। এই আন্দোলনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ হলো ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস ও হরতাল পালন করার। কিন্তু পাকিস্তানি সরকার আন্দোলনের তীব্রতা আচ করতে পেরে এবং জনরোষের ভয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মাসের জন্য ঢাকা জেলার সর্বত্র ১৪৪ ধারা জারির ঘোষনা দেয়। কিন্তু ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির সকালে উত্তাল ছাত্র সমাজ ১৪৪ ভেঙ্গে রাজপথে নামলে পুলিশ নির্মমভাবে গুলিবর্ষন করে যার ফলে প্রাণ হায়ার বাংলার অকুতভয় বীর সেনানীরা। পিচ ঢালা পথে বিছিয়ে দেয়া হয় রক্তের লাল গালিচা যে গালিচায় পা রেখে মাতৃভাষা বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে।
যদিও বাঙ্গালীরা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষনা করে এবং ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে লাভ করে স্বাধীনতা কিন্তু প্রকৃত অর্থে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতেই পরোক্ষভাবে ঘোষিত হয়েছিল স্বাধীনতা।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতেই বাঙ্গালীরা রাজপথে রক্তের লাল গালিচা বিছিয়ে দিয়েছিল স্বাধীনতার জন্য। স্বাধীনতার বীজ রোপন করে দিয়েছিল ঐ দিনই যা অঙ্কোরোদগম হয়ে পূর্ণ বৃক্ষে রূপ লাভ করেছে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর।
তাই বাঙ্গালী জাতিসত্তার ইতিহাসে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাজেই বলা যায়, বাঙ্গালীর স্বাধীনতার ইতিহাস কেবল ৯ মাস যুদ্ধের নয় বরং তা আরো দীর্ঘ সময়ের যার শুরু ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে।
১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস