শুক্রবার, ১১ মার্চ, ২০১৬, ১১:২৯:২৯

তেলের বাজারে তেলেসমাতি

তেলের বাজারে তেলেসমাতি

আবু এন এম ওয়াহিদ: বাজারে জিনিসের দাম যখন বাড়তে থাকে তখন কী হয়, এ কথা কাউকে বলে বোঝাবার দরকার পড়ে না। আমরা সবাই বুঝি, খালি বুঝি না, হাড়ে হাড়ে টেরও পাই, কিন্তু যখন তার ঠিক উল্টোটা হয়, অর্থাৎ জিনিসের দাম কমতে থাকে তখন কী হয়? এ প্রশেড়বর উত্তর জানতে হলে বিষয়টার একটু গভীরে যেতে হয়, কারণ আপতঃ দৃষ্টিতে মনে হয় দাম কমলে তো ভালই। আমরা তো সব কিছুই সুলভে কিনতে চাই। দামাদামি করি, দরাদরি করি সস্তায় কেনার জন্যই তো। দাম কমলে অসুবিধাটা কী? অসুবিধা আছে বৈকি। কীভাবে? সেটা দু’ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। তার আগে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, হঠাৎ কোনো কারণে দ্রব্যমূল্য একদফা পড়ে গিয়ে আবার থিতু হয়ে যাওয়া বিশেষ ক্ষতিকর কিছু নয় এবং এটা এক কথা, আর সময়ের সাথে বাজারদর ক্রমান্বয়ে কমতে থাকা সম্পূর্ণ আলাদা কথা। ইদানীং তেলের বাজারে যা হচ্ছে তা প্রমটা নয়, বরং দ্বিতীয়টা আর তাই সবার জন্যই চিন্তার বিষয়।

১. জিনিসের দাম ক্রমান্বয়ে কমতে থাকলে বিক্রেতা এক সময় গিয়ে দেখবে উৎপাদন খরচ পুষিয়ে তার আর কোনো মুনাফা থাকছে না। অল্প কিছুদিন সে লোকসানেও ব্যবসা করতে পারে, কিন্তু বোধগম্য কারণে তার পক্ষে এ অবস্থা বেশি দিন চালানো সম্ভব হয় না। এক সময় গিয়ে সে ব্যবসা গুটিয়ে নেবে। অন্যকিছু করার না থাকলে নিজে বেকার হবে, তার কর্মচারি-কর্মকর্তাদের অবস্থাও হবে তথৈবচ। একইভাবে সব জিনিসের দাম যদি কমতে থাকে তা হলে সারা দেশে বেকার মানুষের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাবে। বিষয়টা অর্থনীতির গণ্ডি পেরিয়ে অবশেষে দেশে মারাত্মক সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতায়ও রূপ নিতে পারে।

২. দাম কমার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াটা এবার একটু অন্য জায়গা থেকে দেখার চেষ্টা করি। যে জিনিসটার দাম কমছে সেটা যদি নিতান্ত আবশ্যকীয় হয় তাহলে ক্রেতারা সাবধানে কিনবে, অর্থাৎ ঠিক ততটাই কিনবে যতটা দরকার। বস্তুটা যদি নেহায়েত নিত্য প্রয়োজনীয় না হয়, তাহলে ক্রেতারা পড়ন্ত বাজারেও জিনিসটা খরিদ করতে চাইবে না। তারা হাতপা গুটিয়ে বসে থাকবে এই আশায় যে, আয়েন্দা ওই জিনিসের দাম আরো কমবে। ইংরেজিতে এটাকে বলে, Economic Sanction’। এ ভাবে একে একে সব ভোক্তা
যদি আগামীতে দাম কমার আশায় কেনাকাটা বন্ধ করে রাখে তাহলে তাবৎ ব্যবসায়ীদের তেজারত লাটে উঠবে। তারা প্রাথমিকভাবে উৎপাদন কমিয়ে দিবে, আর উৎপাদন কমানো মানে কাঁচামাল কম কেনা, শুধু তাই নয় শ্রমিকও ছাঁটাই করা। অবস্থার উনড়বতি না হলে, উৎপাদন কমাতে কমাতে এক সময় মালিক পক্ষ কল-কারখানা একেবারে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে। বেকারে বেকারে দেশ ভরে যাবে। শুরু হবে, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সঙ্কট। দুই ব্যাখ্যার শুরুটা দু’রকম হলেও শেষফল গিয়ে একই দাঁড়াচ্ছে।

এই ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে এবার দেখা যাক সম্প্রতি বিশ্ব বাজারে কেন এ-ভাবে তেলের দাম পড়ছে। দু’হাজার সাত সালে যে তেল কেনাবেচা হচ্ছিল ব্যারেল প্রতি প্রায় ১৪০ ডলারে সেটা এখন মাত্র ৩০ ডলারের কাছাকাছি উঠানামা করছে। ক’বছর আগেও যে-সব তেল কোম্পানি আকাশ ছোঁয়া মুনাফা করেছে তারা ইদানীং লোকসান গুনতে গুনতে দুই তৃতীয়ংশ উৎপাদন-রিগ বন্ধ করে
দিয়েছে। অনেক কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক ইন্টারনেটসূত্রে পাওয়া এক হিসেবে দেখা যায় দুনিয়াব্যাপী অয়েল সেক্টরে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার লোক চাকরি হারিয়ে বেকার বনে গেছে।
অতি সম্প্রতি ওপেক সদস্যরাষ্ট্র সৌদি আরব, ভেনিজুয়েলা, কাতার, এবং রাশিয়া উৎপাদন না বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। যে জায়গায় এখন দাম আছে এতে করে সৌদি এবং অন্যান্য গাল্ফ দেশগুলোর তেল থেকে রাজস্ব আয় শুধু এ-বছরই কমবে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। কেউ কেউ মনে করেন, এ-ভাবে যদি তেলের দাম আরো পড়তে থাকে তাহলে সৌদি বাদশাহ
সালমানের রাজত্ব নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে, তবে কথাটা কতখানি যথার্থ তা আমরা একটু পরেই আরেকটু তলিয়ে দেখব। এ দিকে ইরান আমেরিকার সঙ্গে পারমানবিক সমঝোতা চুক্তি করেছে এই আশায় যে, তাদের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঊপড়হড়সরপ ঝধহপঃরড়হং উঠে গেলে তারা তাদের আটকে পড়া নগদ ১৫০ বিলিয়ন ডলারের মতো অর্থ ফেরত পাবে এবং তার চেয়ে বড় কথা তারা বছরে শুধু তেল রপ্তানি থেকে আয় করবে আরো ২৫০ বিলিয়ন ডলারের মত। এখন তেলের দাম যেভাবে পড়েছে, এতে করে তাদের সব হিসেব-নিকেশ ওলটপালট হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান বাজার দরে তারা তেল থেকে কোনোভাবেই ৩০/৩৫ বিলিয়নের বেশি রাজস্ব যোগাড় করতে পারবে না।
এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেও কেউ কেউ ওই কঠিন প্রশড়ব - অর্থাৎ তেলের দাম এ-ভাবে কমছে কেন? এর উত্তর খুব সহজ ভাষায় দিচ্ছেন। তারা বলছেন, চাহিদা-সরবরাহের মধ্যেই এর পুরো উত্তর নিহীত আছে। গত কয়েক বছরে আমেরিকা তার দেশজ তেল উৎপাদন দ্বিগুণ করেছে। যার ফলে সৌদি আরব, নাইজেরিয়া, আলজেরিয়া, যারা এতদিন তেল বেচতো আমেরিকার কাছে তারা
এখন পরষ্পরের সাথে প্রতিযোগিতা করছে এশীয় বাজারে গিয়ে। এই নতুন প্রতিযোগিতার ফলে উৎপাদনকারী দেশগুলো তাদের তেলের দাম কমাতে বাধ্য হচ্ছে। শুধু তাই নয়, কানাডা এবং ইরাকও তাদের উৎপাদন বড়িয়েছে গেল ক’বছরে। রাশিয়ানরাও অনবরত কূপ থেকে তেল তুলতেই আছে। ফলে আন্তর্জাতিক তেলের বাজার তেলে তেলে সয়লাব হয়ে আছে। এবার চাহিদার দিকে তাকালে দেখা যায়, ইউরোপ, চীন ও ভারতসহ উনড়বয়নশীল দেশ সমুহের অর্থনীতি দুর্বল - অর্থাৎ আগের মত রমরমা নয় এবং উনড়বত বিশ্বে যেখানে ঘরে ঘরে এক বা একাধিক মটরগাড়ি আছে সেখানে মানুষজন অধিক হারে পুরনো গাড়ি পাল্টে হাইব্রিড ফুয়েল এফিশিয়েন্ট নতুন মটরযান কিনছে। ফলে উভয় অব্জল থকে তেলের চাহিদা কমছে। তাই তেলের দামের ওপর নিন্মগামী বাড়তি চাপ পড়ছে। এ ছাড়া ইরাকে আইসিস দেদারসে তেল পাম্প করছে

৩. এবং সস্তা দামে কালো বাজারে বিক্রি করছে। শোনা যায় বড় বড় ক্রেতারাও কেউ কেউ কাঁচা টাকা দিয়ে সে তেল কিনছে সস্তায়, একেবারে ছ’কড়া ন’কড়া দামে। এ সবকিছুর যোগফলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের চাহিদা আরো কমে গেছে। সরবরাহের প্রাচুর্য এবং চাহিদার স্বল্পতার জন্য তেলের দাম কমছে। এবং এই পড়ন্ত বাজারে ক্যাসকেড ইফেক্ট-এরও জন্ম হচ্ছে, অর্থাৎ তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো দেখছে আগে যে পরিমাণ তেল রপ্তানি করে তারা যে অঙ্কের রাজস্ব আয় করত এখন তা আসছে না। এই রাজস্ব-ঘাটতি মেটাতে তাদের কেউ কেউ তেলের উৎপাদন এবং রপ্তানি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে বাজারে তেলের দাম আরো দ্রুত পড়ে যাচ্ছে। অর্থশাস্ত্রের সাধারণ যুক্তি বলে, যেভাইে হোক, তেলের দাম কমলে শুধু তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আর বাকি সর্বত্র অর্থনীতি শনৈ শনৈ উনড়বতি হওয়ার কথা। কারণ তেল হচ্ছে জ্বালানীর উৎস, যাবতীয় দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদনের একটা মৌলিক উপাদান, শুধু তাই নয়, এই তেল ব্যবহার করেই উৎপাদিত পণ্য ক্রেতা-ভোক্তাদের দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে দেওয়া হয়। তাই তেলের দাম কমলে সব জিনিসের উৎপাদন ও বিপণন খরচ কমার কথা, একই দামে কিংবা কিছু কম দামে বেচলেও ব্যবসায়ীদের মুনাফার পরিমাণ বাড়বে, তারা বিনিয়োগ বাড়াবে, মানুষ নতুন নতুন চাকরি পাবে, উৎপাদন বাড়বে, আয় উপার্জন বৃদ্ধি পাবে, দেশে দেশে অর্থনীতি চাঙ্গা হবে, কিন্তু এবার তা হচ্ছে না, বরং দেখা যায়, যেদিন তেলের দাম কমে সেদিন দুনিয়াব্যাপী স্টকমার্কেট পড়ে যায়। অর্থনীতিতে এ বৈপরীত্যেরও ব্যাখ্যা আছে। আর ব্যাখ্যাটা হল, দুনিয়াজোড়া তেলের যে
মূল্যহ্রাস হচ্ছে তার কারণ কিন্তু নিছক সরবরাহ আর চাহিদাই নয়, অন্যকিছু। তেলের এই দাম পড়া রোগ নয়, বরং এটা রোগের লক্ষণ, শুধু ‘রোগের লক্ষণ’ বললে কম বলা হয়, আসলে এটা বড় রোগের লক্ষণ। আর ‘বড় রোগ’টা হল সার্বিক মন্দা ইংরেজিতে যাকে বলে জবপবংংরড়হ-এর আলামত।
এগুলো হচ্ছে কেতাবি বা শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা, তবে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকে শুধুমাত্র এ বিশ্লেষণে সন্তুষ্ট নন। তাদের মতে, এ সবই শাস্ত্রের কথা, সত্য কথা, বাস্তবতা। আর এ-সব বাস্তবতার আড়ালে লুকিয়ে আছে আরো বড় এক বাস্তবতা। আর এ লুকানো বাস্তবতাকে বুঝতে হলে জানতে হবে সাম্প্রতিক বিশ্ব রাজনীতি, তার সমরনীতি, কূট-কৌশল ও কূটনীতি। এবার দেখা যাক সেগুলো কী? আড়ালের এ সব বাস্তবতার সামনে আছে তিনটা দেশ - সৌদি আরব, ইরান এবং রাশিয়া। পর্দার আড়ালে আছে আমেরিকা এবং ইউরোপ। সাম্প্রতিক কালে রাশিয়ার  এবং ইউক্রেনে ইউরোপের সাথে পরোক্ষভাবে কূটনৈতিক এবং সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়াকে
পশ্চিমা বিশ্ব ফের ঠা-া লড়াইয়ের একটা অশুভ সূচনা হিসেবে দেখছে। ইউরোপ-আমেরিকার পক্ষে রাশিয়ার সাথে সম্মুখ সমরে নামার প্রশড়বই ওঠে না, তাই বলে তারা চুপ করেও বসে থাকতে পারে না। তারা অন্যভাবে রাশিয়াকে শায়েস্তা করতে চায় এবং করছে। তাদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমাতে পারলে রাশিয়া সহজেই কাবু হয়ে যাবে।

৪. এবং ইউরোপ অন্যতম তেল উৎপাদন ও রপ্তারিকারক দেশ সৌদি আরবকে দিয়েই এ কাজটা কৌশলে করাতে চাচ্ছে এবং করাচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন। এখন প্রশড়ব হল সৌদি আরব এ কাজ করবে কেন। করলে তার লাভ কী আর ক্ষতিই বা কী? এ
কাজে সৌদিদের লাভও আছে, ক্ষতিও আছে। ক্ষতি হল রাশিয়ার মত তাদেরও তেল রপ্তানি থেকে রাজস্ব আয় কমে গেছে মারাত্মকভাবে। তবে রাশিয়ার বা অন্য যে কোনো ওপেক দেশের তুলনায় তাদের অর্থনৈতিক অবস্থান অনেক মজবুত, কারণ তাদের রয়েছে বিশাল পরিমাণ সোনা ও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ। সুতরাং এভাবে তেলের দাম আরো দু’-চার বছর পড়ে থাকলেও সৌদিদের তেমন কোনো অসুবিধা হবে না। তারা তাদের নগদ টাকা ভাঙ্গিয়ে ভাঙ্গিয়ে চলতে পারবে অনেক দিন, এবং এতে তাদের একটা লাভও আছে। লাভের অঙ্ক, নগদ টাকা ভাঙ্গিয়ে খাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি। আর তা হল সুনড়বী-সৌদিদের চিরশত্রু শিয়া-ইরান পাশ্চাত্যের সাথে পারমানিবিক চুক্তি করে যে স্বপড়ব দেখছিলো সেটাকে ধুলায় মিশিয়ে দিতে পারবে। কীভাবে সেকথা একটু আগেই বলেছি - শিগগির ইরান আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে ঢুকবে, কিন্তু হলে কী হবে, আগের হিসেব অনুযায়ী ২৫০ বিলিয়নের বদলে মাত্র ৩০ বিলিয়ন নিয়েই ইরানকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। দেশের অর্তনীতি যেভাবে এগোবার কথা ছিল, তা আর হবে না। এ বয়ান যদি সত্যি হয় তা হলে সৌদি আরব যে খেলায় মেতেছে তা ‘‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ’’ ছাড়া আর কিছু নয়।
লেখক: অধ্যাপক - টেনেসী স্টেইট ইউনিভার্সিটি;
এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ
১১ মার্চ ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে