আলম হোসেন, ব্রাসেলস থেকে: ব্রাসেলসের জাভেনতেম বিমানবন্দরে বোমা বিস্ফোরণে ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছে এক বাংলাদেশি পরিবার। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে তারা রক্ষা পান। মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন সে পরিবারের সদস্য ইকবাল হোসেন বাবু। দীর্ঘদিন ধরে ব্রাসেলসের এক্সেল এলাকার বাসিন্দা ইকবাল হোসেন বাবু পেশায় একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। গতকাল টেলিফোন আলাপে তিনি বলেন, আমাদের বেঁচে যাওয়া জাস্ট মিরাকল। কাল আমাদের নামও থাকতে পারতো হতাহতের তালিকায়। আল্লাহই বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
বাবু জানান, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ব্রাসেলসে বসবাস করেন তিনি। ঘটনার দিন সকাল ১০টায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে দেশে যাচ্ছিলেন তার ছোট ভাই, ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ও তাদের এক সন্তান। ছোট ভাইয়ের স্ত্রী দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি পরীক্ষায় অংশ নিতে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দেশে ফিরছিলেন। ছোট ভাইয়ের পরিবারকে বিদায় জানাতে ব্রাসেলসের জাভেনতেম বিমানবন্দরে এসেছিলেন বাবু। সকালে ফ্লাইট থাকায় বাসায় তাদের নাস্তা করা হয়নি। বোর্ডিং পাস সম্পন্ন হওয়ার পর টার্মিনালের ভেতরেই ব্রাসেলস এয়ারলাইন্সের পাশে একটি ক্যাফেতে যান তারা। নাস্তার পর তারা টার্মিনালের ভেতরে দুর্ঘটনাস্থলে একটি এয়ারলাইন্স কাউন্টারের সামনে অপেক্ষা করছিলেন। সময় তখন আটটার কাঁটা ছুঁইছুঁই। বাবু জানান, বিস্ফোরণের দু-তিন মিনিট আগে তার ভাতিজা বাথরুমে যাবার কথা বললে ছোট ভাই ও তার স্ত্রী বাথরুমে যান। দেশে আরেক ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন বাবু। মোবাইলে কথা বলতে বলতে তিনিও এক বোতল পানি কিনতে পাশের ক্যাফের দিকে যান। মিনিটখানেক পরই হঠাৎ বিকট এক বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে বিমানবন্দর। ঘটনার আকস্মিকতায় থমকে দাঁড়ান তিনি। কম্পনের কারণে প্রথমে মনে করেছিলেন হয়তো বড় ধরনের ভূমিকম্প ঘটেছে। পেছনে ফিরে দেখেন আমেরিকান এয়ারলাইন্সের কাউন্টারের পাশে যেখানে তারা অপেক্ষা করছিলেন সেদিকে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। ২০-৩০ সেকেন্ডের মাথায় ফের বিস্ফোরণের বিকট শব্দ। এবার উল্টো দিকে ব্রাসেলস এয়ারলাইন্সের কাউন্টারের পাশে। মুহূর্তেই বুঝতে পারলেন ভূমিকম্প নয় সংঘটিত হয়েছে ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণ। টার্মিনালের ভেতরে আহতদের আত্মচিৎকার, প্রাণভয়ে ছুটোছুটি মিলিয়ে ততক্ষণে বিমানবন্দরে সৃষ্টি হয়েছে এক মর্মন্তুদ পরিবেশ। অটোমেটিক ডোর দিয়ে অন্য অনেকের মতো তিনিও দ্রুত বাইরে বেরিয়ে যান। কিন্তু ভেতরে ছোট ভাইসহ তার পরিবারের পরিণতির কথা চিন্তা করে তিনিও কেঁদে ওঠেন হাউমাউ করে। ফোন দেন ছোট ভাইয়ের নাম্বারে। ভাগ্য ভালো বিস্ফোরণের সময় তারা ছিলেন বাথরুমেই। ফোন ধরে ছোট ভাই জানতে চাইলো এমন বিকট শব্দ কেন? কী হয়েছে? বাবু পাল্টা প্রশ্ন করেন, ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ও তার ছেলে কেমন আছে? ততক্ষণে তারা সবাই একত্রে মিলিত হয়েছেন। স্বজনরা বেঁচে আছেন জানার পর তিনি কাঁদতে কাঁদতে ফোন দেন দেশে এবং ব্রাসেলসে অবস্থানরত স্বজনদের। ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে তিনি ফের অটোমেটিক দরোজার কাছাকাছি অবস্থান নেন। বাবু জানান, ঘটনার পর বিভিন্ন ভাষায় আহত যাত্রী ও তাদের স্বজনদের আত্মচিৎকার আর হাহাকারে ভারি হয়ে ওঠেছিল বিমানবন্দরের পরিবেশ। নানা ভাষায় তখন সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দটি ছিল হেল্প। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। একটু আগেও যারা বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিতে টার্মিনালে অপেক্ষায় ছিলেন মুহূর্তের মধ্যেই কারও হাত নেই, কারও পা নেই। চারদিকে শুরু হয়েছে ছুটোছুটি। কেউ রক্তাক্ত অবস্থায় কাতরাচ্ছেন। রক্তাক্ত অবস্থায় কেউ কেউ বেরিয়ে আসছেন অন্যের সহায়তায়। কারও মাথায় গেঁথে আছে ভেঙে পড়া কাচের টুকরো। কারও সারা শরীর থেকে বেয়ে পড়ছে রক্ত। তখনও জানতে পারিনি ভেতরে কতজন মারা গেছেন। বাবু জানান, সকাল বেলায় ব্রাসেলসে কিছুটা ঠাণ্ডা ছিল। অনেকেই তাদের শরীরের শীতের কাপড় খুলে আহতদের জড়িয়ে দিচ্ছিলেন। দ্রুত বিমানবন্দরে এসে পৌঁছে এম্বুলেন্স আর চিকিৎসক। ভিড় জমে ওঠে পুলিশ, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন সংস্থার লোকজনের। চিকিৎসকরা আহতদের চিকিৎসা দিচ্ছেন আর সুস্থদের নানা প্রশ্ন করছেন পুলিশ ও সাংবাদিকরা। সে এক অন্যরকম পরিবেশ, পরিস্থিতি তখন বিমানবন্দরে। বাবু জানান, ছোট ভাইসহ তার পরিবার বেঁচে আছে জেনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছিলাম। আর ভেতরে যাবার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছিল না। আমি বারবার ফোন দিচ্ছিলাম ছোট ভাইকে। কিন্তু ততক্ষণে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা রক্ষীরা ফের বিস্ফোরণের ভয়ে ভেতরে অপেক্ষমাণ যাত্রী ও তাদের স্বজনদের সরিয়ে নেয় রানওয়ের পাশে খোলা জায়গায়। সেখানেও পৌঁছে গেছেন বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার লোকজন। তারা চিকিৎসা ও খাবার দিচ্ছিলেন। আতঙ্ক কাটাতে মানসিকভাবে উদ্দীপনা দিচ্ছিলেন। ওই অবস্থায় কেটে গেছে প্রায় চার ঘণ্টা। ছোট ভাইয়ের পরিবারকে ছাড়া বাসায় ফিরতে পারেননি তিনি। চারঘণ্টা পর বিমানবন্দরের নিরাপত্তা রক্ষীদের সহায়তায় তারা বেরিয়ে আসার পর সবাই বাসায় ফিরেছেন। উল্লেখ্য, ইকবাল হোসেন বাবুর গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার ইসলামপুর গ্রামে। তার পিতার নাম হাজী মৌলানা বরকত উল্লাহ। ১৯৯২ সাল থেকে তিনি ব্রাসেলসে বসবাস করছেন। ব্রাসেলসে তিনি একজন সুপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশি ব্যবসায়ী। ইকবাল হোসেন বাবু বিএনপি বেলজিয়াম প্রবাসী শাখার সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক।
বোমা বিস্ফোরণের পর ব্রাসেলসের পরিবেশ-পরিস্থিতির ব্যাপারে ইকবাল হোসেন বাবু জানান, বিমানবন্দরে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণের পর তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল করা হয় সকল বিমানের ফ্লাইট। নিরাপত্তাজনিত কারণে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বিমান যোগাযোগসহ বাস, মেট্রোরেল, ট্রামসহ সবধরনের যান চলাচল। গতকাল স্থানীয় সময় দুপুর সাড়ে ১২টায় (বাংলাদেশ সময় বিকাল সাড়ে ৫টা) কথা বলার সময় পর্যন্ত সবধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে ব্রাসেলসে। বিশেষ করে যেসব যানবাহনে বেশি লোকজনের সমাগম হয় তার সবই বন্ধ রাখা হয়েছে। বোমা বিস্ফোরণের পর থেকে ব্রাসেলসের রাস্তাঘাটে লোকজনের আনাগোনা কমে গেছে। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ রাস্তায় বের হচ্ছেন না। যারা রাস্তায় বের হচ্ছেন তাদেরও ব্যবহার করতে হচ্ছে ব্যক্তিগত যানবাহন। পুরো ব্রাসেলস জুড়ে বিরাজ করছে থমথমে পরিস্থিতি। বাবু জানান, রীতিমতো ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছিল মঙ্গলবার রাতের ব্রাসেলস। এছাড়া, বিস্ফোরণের পর ব্রাসেলস থেকে বের হবার প্রতিটি হাইওয়ের মুখে সাময়িক নিরাপত্তা চৌকি বসিয়ে যানবাহনে তল্লাশি চালানো হয়। ছুটি ঘোষণা করা হয় বিমানবন্দরের পাশের স্কুল-কলেজ। বাবু জানান, বিমানবন্দরের সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা করে মঙ্গলবারই হামলাকারীদের শনাক্ত করেছে পুলিশ। ট্যাক্সিতে করেই হামলাকারীরা বিমানবন্দরের টার্মিনালে যায়। অতি দ্রুততার সঙ্গে তারা টার্মিনালের ভেতরে আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। বিস্ফোরণে দুই বোমারু নিহত হয়েছে। পুলিশ তাদের পরিচয় নিশ্চিত করেছে। ব্রাসেলস বিমানবন্দরে আত্মঘাতী এ হামলা চালিয়েছে ইব্রাহিম ও খালিদ নামে দুই ভাই। এছাড়া, আইএস এ ঘটনার দায় স্বীকার করেছে। বিস্ফোরণের পর ব্রাসেলসের কিছু এলাকায় জোর তল্লাশি চালায় পুলিশ। বিশেষ করে ইসকার বেক, আন্ডার লেকসহ যেসব এলাকায় সন্দেহভাজনদের বসবাস রয়েছে। হামলার সঙ্গে জড়িত তৃতীয় এক ব্যক্তিকেও ব্রাসেলসের আন্ডার লেক এলাকা থেকে মঙ্গলবার রাতে তল্লাশি চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাবু জানান, ব্রাসেলসের সব জায়গায় তল্লাশি চালানো হচ্ছে না। তল্লাশির সময় হয়রানির ঘটনাও ঘটেনি। ব্রাসেলসে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা ভালো এবং নিরাপদে আছেন। ব্রাসেলসে বাংলাদেশিদের ব্যাপারে ভালো ধারণা রয়েছে প্রশাসনের। ফলে বাংলাদেশিদের তেমন সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা করছেন না তিনি। তবে এ ঘটনার কারণে বেলজিয়ামে বিদেশিদের যাতায়াতে কড়াকড়ি আরোপের সম্ভাবনা রয়েছে।
২৪ মার্চ, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/প্রতিনিধি/এইচএস/কেএস