প্রবাস ডেস্ক : একটু সচ্ছলতার আশায় আত্মীয়-পরিজন ছেড়ে গৃহকর্মী হিসেবে বাংলাদেশের অনেক নারী পাড়ি জমিয়েছিলেন সৌদি আরবে। কিন্তু কপালে দুঃখ থাকলে তা কি আর খণ্ডানো যায়? সেখানে অকথ্য নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়ে এখন তারা আশ্রয় নিচ্ছেন সৌদি আরবস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস ও হাউস মেড সেন্টারে।
অনেক আগে থেকেই এ বিষয়ে গুঞ্জন চলে আসছিল। সম্প্রতি বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম উইংয়ের এক জরুরি ‘গোপন’ বার্তায় বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে। ফলে এতদিন এ বিষয়ে ভাবান্তর না থাকলেও দূতাবাসের গোপন বার্তায় (বিইআর/এরডব্লিউআর-৪৪৩/২০১৫/৬৩০) তোলপাড় শুরু হয়েছে সরকারের শীর্ষমহলে। পররাষ্ট্র ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি ‘অতি স্পর্শকাতর’ আখ্যা দিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক আগামীতে সৌদি আরবে নারীকর্মী পাঠানোর আগে অন্তত ৬ বিষয়ে নিশ্চয়তা নিয়ে কর্মী পাঠানোর কথা ভাবছেন বলে জানা গেছে।
রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর মো. সারোয়ার আলম বাংলাদেশি নারীকর্মীদের লাঞ্ছনার বিষয়টি স্বীকার করে জানান, ২০১৫ সালের প্রথম ৬ মাসে ৬৯০ নারী কাজ নিয়ে দেশটিতে এসেছেন। কিন্তু এসব গৃহকর্মীর স্পন্সর এবং রিক্রুটিং এজেন্সি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দূতাবাসকে জানানো হয়নি। ফলে তাদের সার্বিক অবস্থা মনিটরিং করা দুরূহ হয়ে পড়ছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) জানায়, বাংলাদেশি নারীকর্মী পাঠানোয় সৌদি আরবের অবস্থান দ্বিতীয়। প্রথম অবস্থানে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। সৌদি আরবে বর্তমানে ৩৬ হাজার ৬৫৮ নারী কর্মরত।
নারী নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র
গত ১ জুলাই সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে যান বিলকিস (২৬)। তার পাসপোর্ট নম্বর-০৬৭২৩৫৬। মদিনা শহরের একটি বাসায় তিনি নিযুক্ত হন। বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি ব্যবসায়ী নাদের আল মুতাহিরির মাধ্যমে সৌদি যান বিলকিস। সৌদিতে আসার ১৭ দিনের মাথায় গত ১৭ জুলাই ৫০০ কিলোমিটার দূরে নিজ বাগানবাড়ির ছাদে নাদেরের ভাই বিলকিসকে নির্যাতন করে। ২০ জুলাই বিলকিস পালিয়ে দূতাবাসে আশ্রয় নেন। সৌদি আরবের মেসার্স ইউসুফ মো. আল হাবিবের মাধ্যমে সৌদি গিয়ে ঝরনা (২৫), পাসপোর্ট নম্বর- বিসি-০১৩৬০৩৭, একই ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়ে দূতাবাসের সেফ হাউসে আশ্রয় নিয়েছেন। ৮০ হাজার টাকা খরচ করে সৌদি আরব গিয়ে নার্গিস (২৭), পাসপোর্ট নম্বর-বিসি-০৯৩৮৬০৯ গত ২১ জুলাই দূতাবাসে আশ্রয় নেন।
নির্যাতনের পর অসুস্থ হয়ে পড়া রেহেনা বেগমকে তার নিয়োগকর্তা সৌদি সরকারের কাছে হস্তান্তর করেছেন। কিন্তু বিচার হয়নি নির্যাতনের। আরেক কর্মী রহিমা নির্যাতনের ধকল সইতে না পেরে কারাজীবন বেছে নিয়েছেন সৌদি আরবে।
৫ লাখ গৃহকর্মী নেবে সৌদি
চলতি বছর ১০ ফেব্রুয়ারি সম্পাদিত এক চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে ৫ লাখ গৃহকর্মী নেবে সৌদি আরব। জানা গেছে, মাসে ৮০০ রিয়াল (১৬ হাজার ৮০০ টাকা) বেতনে গৃহ খাতে কর্মী নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরব চুক্তি করে। গৃহকর্মী সংকটের কারণে সৌদি আরবই বাংলাদেশের সঙ্গে এ চুক্তি চূড়ান্ত করে।
জনশক্তি, কর্মস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক বেগম শামসুন নাহার এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা গৃহকর্মীদের নাম নিবন্ধন করছি। সৌদি সরকার চাইলেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের পাঠাতে পারব। দেশটির চাহিদার আলোকেই আমাদের প্রস্তুতি। তিনি বলেন, গৃহকর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে আমাদের কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। তারা যে সংখ্যক কর্মী চাইবে, আমরা তা সরবরাহ করতে পারব।
দূতাবাসের পরামর্শ
এখন থেকে সৌদিতে বাংলাদেশি নারীকর্মী পাঠানোর আগে ৬ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ দূতাবাস। এগুলো হলো এক. রিক্রুটিং এজেন্সি সম্পর্কে আরও যাচাই করে তাদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত।
দুই. মেগা ব্যতীত অন্য সৌদি রিক্রুটিং এজেন্সির ক্ষেত্রে বহির্গমন ছাড়পত্র ইস্যুর আগে দূতাবাসের মতামত নেওয়া।
তিন. যেসব সৌদি রিক্রুটিং এজেন্সি চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে স্পন্সর পরিবর্তন করেছে তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা।
চার. বহির্গমন ছাড়পত্র পাওয়া গৃহকর্মী, সংশ্লিষ্ট এজেন্সি ও স্পন্সর সম্পর্কিত তথ্যাদি বিএমইটি থেকে জরুরি ভিত্তিতে দূতাবাসে পাঠানো।
পাঁচ. নতুন কর্মী পাঠনোর আগে তাদের বয়স, স্পন্সরের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ও পুরুষ সদস্যদের বয়স বিবেচনা করে অতি সতর্কতা অবলম্বন করা।
ছয়. পুরুষ কর্মী এবং অন্য সেক্টরে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে সৌদি কর্তৃপক্ষের অবস্থান ও ইতোমধ্যে পাঠানো গৃহকর্মীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে নতুন নারীকর্মী পাঠানোর ব্যাপারে কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ।
পুরুষকর্মী নিতে অনাগ্রহ
মালিকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন বাংলাদেশি পুরুষকর্মীরা এ অজুহাতে বাংলাদেশ থেকে পুরুষকর্মী নিতে আগ্রহী নয় সৌদি আরব। জানা গেছে, অনেক চাকরিদাতাই পুরুষ শ্রমিক নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। দেশটির প্রভাবশালী গণমাধ্যম আরব নিউজ এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
দেশটির একটি রেস্তোরাঁ মালিক আব্দুল রহমান কাইরের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে বলা হয়, ১০ বছর আগে তিনি ২ বাংলাদেশিকে কাজ দিয়েছিলেন; কিন্তু তারা গ্রাহকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছিল। এরপর থেকে তিনি বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ বন্ধ রেখেছেন। সৌদির নির্মাণ ব্যবসায় জড়িত আহমেদ নাবিল। তিনি জানান, কাজে ধীরগতি ও অদক্ষ হওয়ার কারণে তিনি তার সব বাংলাদেশি কর্মী বদলে অন্যদের নিয়োগ দিয়েছেন।-দৈনিকআমাদেরসময়
৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে