তবারুকুল ইসলাম: ব্রিটিশ বেকিং কন্যা নাদিয়া হোসেনের সাফল্য উদ্যাপনের রেশ কাটতে না-কাটতেই আরেক নাদিয়ার আবির্ভাব। রান্নাবান্নার নয়, তিনি রাজনীতির নাদিয়া। পুরো নাম নাদিয়া শাহ। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশিদের সাফল্যের গল্পে যুক্ত করেছেন নতুন উপাখ্যান। লন্ডন শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ক্যামডেন কাউন্সিলের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। ১১ মে কাউন্সিল মিলনায়তনে এক আড়ম্বর আয়োজনে শপথ গ্রহণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নেন লেবার দলীয় কাউন্সিলর নাদিয়া।
যুক্তরাজ্যের সংসদে যেখানে বর্তমানে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তিনজন এমপি রয়েছেন, সেখানে কাউন্সিলের মেয়র হওয়া নিয়ে এত হইচই কেন? কারণ, নাদিয়া কাউন্সিলের যে সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, সেই পদটিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কোনো নারী এর আগে বসেননি। তাই নাদিয়ার মেয়র নির্বাচিত হওয়াটা ইতিহাসের সেই শূন্যতা পূরণ করেছে। সেই সঙ্গে তিনি যুক্তরাজ্যের প্রথম কোনো মুসলিম নারী মেয়র।
তাক লাগানো ব্যাপার হলো নাদিয়ার উঠে আসা। ২০১৪ সালে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে রাজনীতির সূচনা। শুরুতেই স্থান পেলেন কাউন্সিলের কেবিনেটে (কাউন্সিলের মন্ত্রিসভা)। পরের বছর দায়িত্ব পেলেন ডেপুটি মেয়র হিসেবে। আর এবার ২০১৬-১৭ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে গেলেন মেয়র।
প্রসঙ্গত, যুক্তরাজ্যে কাউন্সিলের সর্বোচ্চ পদ হলো মেয়র। কিছু কাউন্সিলে জনগণের সরাসরি ভোটে চার বছরের জন্য মেয়র নির্বাচিত হন। এই মেয়ররা নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী। আর বেশির ভাগ কাউন্সিলে নির্বাচিত কাউন্সিলররা ভোটাভুটির মাধ্যমে প্রতিবছর একেক জনকে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব দেন। নির্বাচিত মেয়র নিজের মতো কেবিনেট গঠন করে সংশ্লিষ্ট মেয়াদে কাউন্সিল পরিচালনা করেন। ক্যামডেন কাউন্সিলের ৫৪ জন কাউন্সিলর রয়েছেন। তাঁদের ভোটাভুটিতেই নাদিয়া মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রথম নারী মেয়র হওয়ার গৌরব অর্জন করে উচ্ছ্বসিত নাদিয়া। তাঁর সঙ্গে ই-মেইল আর মোবাইল ফোনের খুদে বার্তায় চলল কথোপকথন। নাদিয়ার জন্ম ক্যামডেনেই। বাবা নজরুল ইসলাম ১৯৬০-এর দশকে সিলেটের এমসি কলেজ থেকে স্নাতক করে বিলেতে পাড়ি জমান। আর মা আম্বিয়া ইসলাম বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কিছু পরেই মাত্র ১২ বছর বয়সে যুক্তরাজ্যে আসেন। নাদিয়ার পৈতৃক বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ায়।
রাজনীতিতে এলেন যেভাবে:
বাবা ছিলেন ব্যাংকার। তাই নাদিয়ার ঝোঁক ছিল সেদিকেই। গ্রিনউইচ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে ন্যাটওয়েস্ট ব্যাংকে বিনিয়োগ পরামর্শক হিসেবে চাকরি শুরু করেন। ব্যাংকিং পেশায় ভালো করলেও তা ছেড়ে দিয়ে স্থানীয় সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে কাজের অভিজ্ঞতা নেন। পাশাপাশি চালিয়ে যান সামাজিক কার্যক্রম। বিশেষ করে লেবার দলের পক্ষে প্রচার আর বাংলাদেশি নারীদের ভোটাধিকার প্রয়োগে সচেতন করতে কাজ করতেন তিনি। নির্বাচন করার কথা ভাবেননি। কিন্তু ২০১৪ সালে স্থানীয় রিজেন্ট পার্ক আসনে কাউন্সিলর পদ খালি হলে পরিচিতজনদের চাপাচাপিতেই প্রার্থী হন নাদিয়া। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। নাদিয়া বলেন, ‘বিশেষ করে স্থানীয় নারীরা ভেবেছেন, আমি রাজনীতি করলে তাঁর জন্য আরও ভালো কিছু করতে পারব।’
প্রসঙ্গত, নাদিয়ার আসনে আগে কাউন্সিলর ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক। টিউলিপ এমপি পদে প্রার্থী হলে ওই আসনটি খালি হয়। ২০১৫ সালের নির্বাচনে লেবার দলীয় এমপি হিসেবে নির্বাচিত হন টিউলিপ।
ওয়েস্টমিনস্টারের কথা কী ভাবছেন? নাদিয়া বেশ মজা করেই পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘ওয়েস্টমিনস্টার পার্লামেন্টে বর্তমানে আমাদের তিনজন নারী এমপি আছেন, কিন্তু আমাদের বাংলাদেশি পুরুষরা কোথায়?’ তারপর বললেন, ‘রাজনীতিতে এক সপ্তাহও অনেক লম্বা সময়। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। দেখি আমার যাত্রা কোথায় গিয়ে থামে।’
সংসারের চাবিও নিজের হাতে:
নাদিয়ার স্বামী জলিল শাহ ক্যামডেন কাউন্সিলেই প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। এই দম্পতির তিন সন্তান রয়েছে। পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ হলেও সংসারের চাবি কিন্তু নাদিয়ার হাতেই। নাদিয়া বলেন, সন্তান-পরিবার এসব অবশ্যই অন্য সবকিছুর আগে। তবে পেশাটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই পরিবার ও রাজনৈতিক কর্মের মধ্যে ভারসাম্য করেই চলতে হয়। এ ক্ষেত্রে স্বামীই তাঁর অন্যতম সহযোগী। তা ছাড়া বাবা-মায়ের পাশাপাশি বসবাস করেন বলে তাঁদের কাছ থেকেও প্রয়োজনীয় সহায়তা পেয়ে থাকেন। নাদিয়ার এই অর্জন হতে পারে বাঙালি নারীদের জন্য বিশেষ অনুপ্রেরণা।
নিজেকে বাঙালিই ভাবেন:
যুক্তরাজ্যে জন্ম হলেও ছোটবেলা থেকে বাবা-মা তাঁদের চার ভাইবোনকে বাঙালি মূল্যবোধ আর বাঙালি সংস্কৃতির শিক্ষা দিয়েছেন নাদিয়া জানালেন। নাদিয়া নিজে বাংলা গান জানেন, নাচ শিখেছেন। বাবা-মা তাঁকে বাংলা ভাষা শিখিয়েছেন, সেই সঙ্গে দিয়েছেন ধর্মীয় শিক্ষা। এই ভিন দেশে তাঁদের বাঙালি পরিবারের মতো নিবিড় বসবাস। নিজেকে একজন বাঙালি নারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে নাদিয়া বলেন, তাঁর এই অর্জন যুক্তরাজ্যে বাঙালি নারীদের সাফল্যের প্রতীক হিসেবে বেঁচে থাকবে। নিজেকে বাংলাদেশের একজন বার্তাবাহক বলে মনে করেন তিনি।
মাতৃভূমির বন্ধন এখনো অটুট:
নিজের আত্মপরিচয় আর শিকড়ের সঙ্গে বন্ধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নাদিয়া শাহ বলেন, ‘আমরা পারিবারিকভাবেই বাংলাদেশে নিয়মিত বেড়াতে যাই। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখি।’ নিজের সন্তানদেরও বাঙালি মূল্যবোধ আর বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে শিকড়ের যুক্ততায় তিনি দারুণভাবে গৌরবান্বিত। গত বছরও দেশ থেকে ঘুরে গেছেন নাদিয়া।-প্রথম আলো
২১ মে, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ