মঙ্গলবার, ২৪ মে, ২০১৬, ০২:৩৮:৪৫

কে এই ব্যাক্তি, কাগজের অভাবে কবিতা লিখেছেন সিমেন্টের বস্তায়?

কে এই ব্যাক্তি, কাগজের অভাবে কবিতা লিখেছেন সিমেন্টের বস্তায়?

প্রবাস ডেস্ক: কঠিন বাস্তবতার কষাঘাতে জীবনের স্বপ্নগুলোকে সবাই জাগিয়ে রাখতে পারে না। সক্ষমতা থাকলেও সবার পক্ষে সম্ভব হয় না যাপিত জীবনের ক্লিষ্টতাকে অতিক্রম করে নিজের আবেগ-অনুভূতিকে কাব্যে-গদ্যে ফুটিয়ে তোলার। যারা পারেন তারাই অনন্য। তাদেরই একজন মো. মুকুল হোসাইন। স্বজনদের থেকে সহস্র ক্রোশ দূরের প্রবাসের নিরানন্দ, কর্মময় জীবনের মধ্যেও নিজের কাব্য-সত্ত্বাকে মলিন হতে দেননি। সামান্য উপার্জনের কাছে হারিয়ে যেতে দেননি অন্তরের কোমলতাকে। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পরেও রাতের পর রাত পার করেছেন জেগে, কেবল কবিতা লেখার জন্য। কাগজের অভাবে কবিতা লিখেছেন সঙ্গে থাকা সিমেন্টের বস্তায়। নিষ্ঠা, শ্রম আর নিবেদনের এমন উদাহরণ বৃথা যায়নি মুকুল হোসাইনের। শেষ পর্যন্ত এ মাসের শুরুতে তার একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে সিঙ্গাপুরে। ২৫ বছর বয়সী মুকুলই প্রথম কোনো প্রবাসী শ্রমিক, যার কোনো কবিতার বই প্রকাশিত হলো দেশটিতে।

 

সিঙ্গাপুরের দ্য স্ট্রেইট টাইমসের এক প্রতিবেদনে মুকুলের এমনই নিষ্ঠা আর সাফল্যের গল্প উঠে এসেছে। তাতে বলা হয়, নির্মাণ খাতের কর্মী মুকুলের সাবেক এক বস হুমকি দিয়েছিলেন মজুরি কেটে নেয়ার। ছোটবেলা থেকেই কবিতা লেখার অভ্যাস থাকা মুকুল এমন ঘটনার পর নিজের ক্রোধকে প্রকাশ করতে আশ্রয় নেন সেই কবিতারই। সঙ্গে থাকা সিমেন্টের বস্তায় লিখতে শুরু করেন কবিতা। সেটা ২০১৪ সালের কথা। সেই থেকে শুরু। এরপর আর থেমে থাকেননি। একের পর এক লিখে যেতে থাকেন কবিতা। প্রবাসের সহকর্মীরা যখন সারা দিনের খাটুনি শেষে ঘুম ছাড়া অন্য কিছুর কথা ভাবতে পারত না, তখন মুকুল রাত জেগে জেগে পাতার পর পাতায় তুলে নিয়ে আসতে থাকেন মনের জমানো কথা। বেশকিছু কবিতা জমে গেলে সেগুলোকে বাংলাদেশি একজন শিক্ষককে দিয়ে ইংরেজিতে অনুবাদ করিয়ে নেন মুকুল। সিঙ্গাপুরের কবি সাইরিল ওং সেগুলোতে আরেকবার হাত বুলিয়ে দেন। তারপরই স্থানীয় প্রকাশ ইথোস বুকস থেকে প্রকাশিত হয় মুকলের ইংরেজি ভাষার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মি মাইগ্র্যান্ট’ বা ‘আমি প্রবাসী’।


মুকলের এই বইয়ে উঠে এসেছে তার প্রবাস জীবনের কথা, সঙ্গে রয়েছে তার জীবনের যা কিছু প্রিয় সেগুলোর কথা। যেমন তার একটি কবিতায় তিনি তুলে ধরেছেন অনমনীয় বশের বিরুদ্ধে ক্ষোভের কথা। তাতে মুকুল লিখেছেন, ‘আমি তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে চাই... আমি চাই দরিদ্রদের সম্রাট হতে।’ আরেক কবিতায় উঠে এসেছে তার স্নেহময়ী মায়ের কথা, যাতে তিনি লিখেছেন ‘বন্দি প্রবাসে’র ‘অন্তহীন নির্জনতা’র কথা। মুকুল বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমি অন্য একটি দেশে বাস করছি। কঠিন পরিশ্রম আমার অনেক অনুভূতিই ভোঁতা করে দিয়েছে। এটা ছিল তাই আমার পরিবার, আমার স্বজনদের স্মরণ করার একটি মাধ্যম।’


মুকুলের জীবনের গল্পটা সংগ্রামের, বঞ্চনার। ছোটবেলা থেকেই কবিতা লেখার অভ্যাস ছিল তার। দেশে দুইটি কবিতার বইও বের হয়েছিল। একজন লেখক অথবা সংগীতশিল্পী হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু তার এই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো বা বিদেশে পাঠানোর মতো সামর্থ্য ছিল না তার পরিবারের। বরং পরিবারের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হয় তাকে কাজের জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানোর। ২০০৮ সালে ভিটেমাটি বিক্রি করে আট লাখ টাকা জোগাড় করে প্রথমবারের মতো সিঙ্গাপুরের পথে মুকুলকে এগিয়ে দেয় তার পরিবার। কিন্তু যে প্রতিষ্ঠানের হয়ে তিনি সিঙ্গাপুরে যাচ্ছিলেন সেই প্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া হয়ে যায়, মুকুলের ওয়ার্ক পারমিটও বাতিল হয়ে যায়। সেবার আর সিঙ্গাপুর যাওয়া হয়নি তার।

 

২০০৯ সালে আরেকবার মায়ের শেষ গয়না বিক্রি করে সিঙ্গাপুর যাওয়ার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন মুকুল। কিন্তু সেবারও তার ওয়ার্ক পারমিট বাতিল হয়ে যায় অজানা কারণে এবং যে এজেন্টের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছিল সেই এজেন্টও লাপাত্তা হয়ে যায়। এভাবে সিঙ্গাপুর যাওয়ার জন্য কয়েকবারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে মুকুল মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। নিজেকে তুচ্ছ মনে হয় তার। দরিদ্র পরিবারের সম্বলগুলো একে একে তার পেছনে ব্যয় হয়ে যেতে থাকলেও তা কোনোই কাজে লাগছিল না। তবে তার বাবা ছিলেন তার পক্ষে। তিনি মুকুলকে বলেছিলেন, প্রয়োজনে নিজের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও তিনি মুকুলকে সিঙ্গাপুরে পাঠানোর চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। শেষ পর্যন্ত ২০১০ সালে একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের হয়ে সিঙ্গাপুর যাত্রা করেন মুকুল।

কিন্তু এমন কায়িক পরিশ্রম করার জন্যও প্রস্তুত ছিলেন না মুকুল। সিঙ্গাপুর গিয়ে কাজ শুরুর চার দিনের মাথায় গরম আর পরিশ্রম সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞানও হয়ে পড়েন তিনি। সেখানকার ডরমিটরির ঘিঞ্জি পরিবেশে ঘুমাতেও পারতেন না তিনি। সেখানকার পচা গন্ধে বমিও করতেন শুরুর দিকে। খেতে পেতেন বাসি-পঁচা খাবার, যা গলা দিয়ে নামত না তার। কঠিন এই জীবনের কথাই শেষ পর্যন্ত তিনি লিখতে শুরু করেন। কাজের সাইটে নোটবুক নিতে পারতেন না। তাই হাতের কাছে থাকা সিমেন্টের বস্তাতেই লিখে রাখতেন কবিতা। একটু ফুসরত মিললেই সেগুলো আবার লিখে নিতেন মোবাইলে। এক সময় সিঙ্গাপুরে কর্মরত বাংলাদেশিদের জন্য বাংলা পত্রিকা ‘বাংলার কণ্ঠে’ ছাপা হতে থাকে তার কবিতা। স্থানীয় সাহিত্যের আসরেও আনাগোনা শুরু হয় তার। এভাবেই সিঙ্গাপুরের ওই কঠিন জীবনও সহনীয় হয়ে আসে তার।


এমনই এক সাহিত্যের আসরে তার পরিচয় হয় সিঙ্গাপুর সাহিত্য পুরস্কারজয়ী সাইরিল ওংয়ের সঙ্গে। সেই পরিচয় বন্ধুত্বে রূপান্তরিত হতে সময় লাগেনি। ওং তার সম্পর্কে বলেন, ‘মুকলের লেখার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তার সততা। তার কবিতায় একইসঙ্গে উঠে এসেছে নিজের আবেগ ও অন্তর্মুখিতার কথা।’ গত বছর মুকুল সিঙ্গাপুরের প্রকাশনা সংস্থা ইথোস বুকের প্রকাশক ফং হোয়ে ফ্যাংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তার কবিতার বই ছাপানোর জন্য। মুকুলের কবিতায় উঠে আসা নিঃসঙ্গতা, বাড়ির প্রতি টান আর প্রবাসী জীবনে তার হারিয়ে যাওয়ার ‘বিশ্বজনীনতা’ তাড়িত করে ফ্যাংকে। তিনি বলেন, ‘মুকুলের কবিতা পড়ে আমার মনে হয়েছিল সেই সব মানুষের কথা যারা চীন থেকে এসে সিঙ্গাপুরকে গড়ে তুলেছিলন। কিন্তু তারা তাদের নিজেদের সংস্কৃতি, ছেড়ে আসা স্বভূমের প্রতি ভালোবাসা আর সেখানকার স্মৃতি কখনই ভুলতে পারেননি।’ আর সে কারণেই মুকুলের বইটি ছাপার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

সাইরিল ওং মুকুলের কবিতার অনুবাদ আরও একটু পরিশীলিত করে তোলেন। ছাপা হয় মুকুলের স্বপ্নের কবিতার বই ‘মি মাইগ্র্যান্ট’। প্রবাসী কোনো কর্মীর এমন কোনো কবিতার বই আগে কখনও সিঙ্গাপুরে প্রকাশিত হয়েছে কি না, সে কথা স্মরণ করতে পারেননি ফ্যাং। মুকুল বলেন, বিদেশি শ্রমিকদের নিয়ে সিঙ্গাপুরিয়ানদের যে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে, বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি কর্মকাণ্ডের অভিযোগে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশির আটক হওয়ার খবর যে ধারণাকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে, সেই ধারণার বিপরীতে কথা বলবে তার কবিতা।

লেখালেখির বাইরে তার আগের ডরমিটরিতে একটি অলাভজনক স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিকে তিনি দোভাষী হিসেবে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে থাকেন সপ্তাহে একদিন। এর বাইরে এখন তিনি একটি গল্পের বইয়ের কাজ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। তার প্রথম এই গল্পের বইটির মাধ্যমে তিনি সিঙ্গাপুরের সাহিত্য অঙ্গনে বিদেশি একজন শ্রমিকের প্রতিনিধি হয়ে উঠতে চান। কিন্তু সবকিছুর মূলে যেন তার পরিবার। মুকুল বলেন, ‘আমি বলতে পারব না যে আমার বাবা একজন প্রকৌশলী, আইনজীবী বা পাইলট। আমি চাই তিনি যেন বলতে পারেন, ‘আমার ছেলে একজন বিখ্যাত লেখক।-এমজমিন

২৪ মে,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে