আল-আমিন: ‘এ এক নতুন কিসিমের জীবন। সারাদিন কাজ করাতো। নিয়মিত খেতে দিতো না। কাজে কোনো ক্রটি হলে নেমে আসতো নির্যাতনের খড়গ। কিল-ঘুষি মারতো। খুন্তি দিয়ে ছ্যাঁকা দিতো। কখনও শরীরের ওপর উঠে লাথি মারতো। কখনও আবার চুল কেটে দিতো। মাস গেলে স্বল্প বেতনের কথা বললে আরও নির্যাতন করতো। দুঃখ কষ্টে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল। তবুও রুটি ও রুজির আশায় সেখানে পড়ে ছিলাম। কিন্তু, আর কত কষ্ট সহ্য করা যায়? অবশেষে দেশে চলে এলাম।’ কথাগুলো কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন লেবানন থেকে ফেরত আসা বাংলাদেশি নারীকর্মী নাজমা বেগম। শুধু নাজমা বেগম নন ফেরত আসা নারীরা অনেকেই এমন অভিযোগ করলেন।
গতকাল ভোর ৫টা এবং সকাল সাড়ে ৯টায় অ্যারাবিয়া এয়ারলাইন্স নামে দুই ফ্লাইটে ২০ জন নারী কর্মী লেবানন থেকে বাংলাদেশে ফেরত আসেন। তারা বিমানবন্দরে এসে অনেকেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তাদের বিমানবন্দরে নিতে আসা স্বজনেরা সান্ত্বনা দেন। এ সময় ওই এলাকার পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। ফেরত আসা নারী কর্মীদের গ্রহণ করার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়য়ের কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে দেখতে পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন কারণে অবৈধ হয়ে পড়া প্রায় ৩ হাজার বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত পাঠাবে লেবানন। এদের প্রায় ৮০ ভাগ নারী। গতকাল হযরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, সকাল সাড়ে ৯ টার দিকে অ্যারাবিয়া এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট ঢাকায় অবতরণ করে। ওই ফ্লাইটের ১০ জন নারী কর্মী লেবানন থেকে ফেরত এসেছেন। তারা হলেন- পারুল আক্তার (৩০), নাজমা বেগম (৩০), নার্গিস বেগম (৪৫), পারুল বেগম (৩৫) , রেখা আক্তার (৩৫), বিউটি (৩০), লতা বেগম (৪০) ও মরিয়ম খাতুন (৩৭)। অন্য দুইজনের নাম জানা যায়নি। তারা বিমানবন্দরের নিচতলার ১ নম্বর টার্মিনালে দিয়ে বের হয়ে আসেন। তাদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের বিস্তর কথা হয়।
লেবানন থেকে ফেরত আসা নাজমা বেগম জানান, সংসারে অভাব ও অনটনের কারণে ৩ বছর আগে লেবাননে যায়। নিজ জেলার নরসিংদীর এক দালালের মাধ্যমে তিনি ওই দেশে যান। ভিসায় গৃহকর্মী বলে উল্লেখ করা ছিল। তিনি আরও জানান, যাওয়ার আগে দালালেরা অনেক রকম কথা বলে প্রলোভন দেখিয়েছিল। বলেছিল ৩০০ ডলার বেতন পাওয়া যাবে। বাড়তি আয় করা যাবে। গৃহকর্মীর কাজে বাড়ির মালিক খুশি হলে অনেকেই বাড়তি বেতন দিয়ে থাকে। সংসারে সচ্ছলতার আশায় এবং সন্তানদের মানুষ করার জন্য স্বামীকে দেশে রেখে প্রায় পৌনে ২ লাখ টাকা খরচ করে লেবাননে গিয়েছিলাম। কিন্তু, বাস্তবতা হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন।
বিউটি বেগম নামে আরেক নারী জানান, লেবাননের বৈরুতের উপকণ্ঠ সাঈদা নামক এলাকায় তিনি একটি বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করতেন। দেশ থেকে যাওয়ার আগে দালালেরা তাকে বলেছিলেন যে, ৩০০ ডলার বেতন দেয়া হবে। কিন্তু, ওখানে গিয়ে মাত্র ১৭৫ ডলার বাংলাদেশি সমপরিমাণের সাড়ে ৯ হাজার টাকা বেতন পাই। তিনি আরও জানান, বাড়ির মালিক সারাদিন কাজ করাতো। ঠিকমতো খেতে দিতো না। কোনো মাসে বেতন দিতো আবার কোনো মাসে দিতো না। বেতনের কথা বললেই বিভিন্ন নির্যাতন করতো। বাড়ির মালিক, মালিকের স্ত্রী, সন্তান এমনকি তাদের নাতি এবং নাতনিরাও নির্যাতন করতো। নির্যাতনের ধরন ছিল ভিন্ন রকমের। যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। অনেক চেষ্টা করেছি ওই দেশ থেকে কিভাবে বাংলাদেশে আসবো। পরে এক বড় ভাইয়ের সহযোগিতায় সেখানে বাংলাদেশি দূতাবাসের সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশে ফেরত এসেছি। বিউটির গ্রামের বাড়ি ঢাকা জেলার দোহার থানা এলাকায়।
নার্গিস বেগম নামে অপর এক নারী জানান, ৮ মাস আগে লেবাননে গৃহকর্মীর ভিসায় গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি বৈরুতে যে বাসায় আমার কাজে যোগদানের কথা ছিল ওই বাসাটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে লুকিয়ে লুকিয়ে অন্যের বাসায় কাজ করেছি। তারা ইচ্ছা হলে বেতন দিতো নইলে দিতো না। বেতনের কথা বললেই মারধর করতো। এমন হাজার হাজার বাংলাদেশি নারী লেবাননের বৈরুতে অসহায় হয়ে জীবন যাপন করছেন। তারা বৈরুতের বাংলাদেশের দূতাবাসে যোগাযোগ করে কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না। শুধুই সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দেয়া হয়। বাধ্য হয়ে ৮ মাস পর ওই দেশ থেকে বাংলাদেশে চলে আসলাম।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, লেবাননের চাইতে বাংলাদেশে গৃহকর্মীর কাজ করে অনেক শান্তি আছে। তার গ্রামের বাড়ি ঢাকার কেরানিগঞ্জের হযরতপুর ইউনিয়নে। পারুল বেগম নামে অন্য এক নারী কর্মী জানান, বাংলাদেশে এসে মনে হচ্ছে একটি নতুন জীবন পেলাম। দেড় বছর আগে লেবাননে গিয়েছিলাম। গৃহকর্মীর কাজ করতে গিয়ে মালিকের নির্যাতনে নিজের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছিল। যে বাড়িতে কাজ করতাম ওই বাড়ি থেকে পালাবার অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু, বাড়ির মালিক জোর করে আটকে রাখতো। গভীর রাতে ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে বৈরুতে থাকা নিজ জেলার সিরাজগঞ্জের এক বড় ভাইয়ের কাছে আশ্রয় নেই। লেবানন থেকে ফেরত আসা শ্রমিকদের গ্রহণ করতে আসা বেসরকারি সংস্থা অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের কাউন্সিলর নাশিদ কামরুন নাহার জানান, বিদেশ থেকে যারা ফেরত আসেন তারা আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হন। অনেকেই ভেঙ্গে পড়েন। কেউ হতাশায় নিমজ্জিত হন। ওই লোকজনকে আমাদের এনজিও সহযোগিতা করে থাকেন। লেবানন থেকে ফেরত আসা নির্যাতিন এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত নারী কর্মীরা একেবারে ভেঙ্গে পড়েছেন বলে তিনি জানান।-এমজমিন
২৫ জুন, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ