মোবাশ্বেরা জাহান, আঙ্কারা (তুরস্ক) থেকে: তুরস্কের আঙ্কারায় ট্যাংক দখলে নিয়েছে জনতা। ছবি: এএফপিতুরস্কে ঘটে গেছে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা। রাস্তায় ট্যাংক, মুহুর্মুহু গুলি, নিচ দিয়ে উড়তে থাকা জঙ্গি বিমান। সব মিলিয়ে ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতা। তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারা থেকে লিখেছেন একজন বাংলাদেশি
১৫ জুলাই ২০১৬। ঘড়িতে তখন রাত ১০টা বেজে ৩০ মিনিট। মাত্রই বাইরে থেকে ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে মোবাইল ফোন হাতে নিয়েছি। খুব ক্লান্ত লাগছে। আমি যেখানে থাকি, সেখান থেকে খিজিলার দূরত্ব আসা-যাওয়া মিলে কমপক্ষে দুই ঘণ্টা। আর খিজিলা হলো আঙ্কারার প্রাণকেন্দ্র। প্রায় সব কাজেই ওদিক হয়ে যেতে হয়।
এর মধ্যে সবচেয়ে বিরক্তিকর হলো মেট্রো স্টেশন থেকে নেমে বাসের জন্য লাইনে দাঁড়ানো। কারণ, শিক্ষার্থীদের জন্য মেট্রো থেকে ডরমিটরি পর্যন্ত পৌঁছানোর একটি মাত্রই পরিবহন আছে। আর সেটি হলো বাস। সে যা-ই হোক, মুঠোফোন হাতে নিয়ে কিছু জরুরি কল করার চিন্তা করছিলাম। এমন সময় তুরস্কে আছেন পরিচিত একজন ভাবি কল দিয়ে জিজ্ঞেস করেলন, ‘আজ কি কিছু হয়েছে? এত বিমানের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে কেন? তুমি কি কিছু জানো?’
আমি বললাম, একটু আগেই তো ফিরলাম। রাস্তাঘাট তো স্বাভাবিকই দেখলাম। তা ছাড়া আমার ডরমিটরি থেকে সেনানিবাস কাছে হওয়ায় এখানে বিমানের আনাগোনা সব সময়ই থাকে। তাই ঠিক বুঝতে পারছি না। ভাবি আবারও বললেন, ‘কিন্তু আজকের ব্যাপারটা একটু অন্য রকম মনে হচ্ছে!’ তারপর আরও কিছু টুকটাক কথা শেষে রেখে দিলাম ফোনটা। তখনো ভাবিনি সামনে নিদারুণ এক উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগের সময় অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
একটু পরেই বাংলাদেশি এক পরিচিত ছোট ভাইয়ের ফোন। ও বোঝানোর চেষ্টা করল আঙ্কারার অবস্থা ভালো নয়। আগামীকাল যেন কোথাও না যাই। কিন্তু আসলে কী হয়েছে, সেটা তখনো আমি জানি না। ধরেই নিলাম হয়তো আবার কোনো বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। আমিও বিষয়টি নিয়ে তেমন মাথা ঘামাইনি আর। রাত সাড়ে এগারোটা বাজে প্রায়। মোবাইল ফোনের চার্জ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ভাবলাম ফোনটাকে চার্জে দিয়ে নামাজ পড়ে আসি। নামাজের ঘরে যাওয়ার পথে দেখি লিফটের সামনে মেয়েদের বেশ ভিড়। সবার মুখেই উৎকণ্ঠার ছাপ। পরিচিত একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার? কোথায় যাও? ও বলল, ‘আমরা টিভিরুমে যাচ্ছি।’ ততক্ষণে লিফট চলে এসেছে। লিফটের দরজা খুলতেই দেখি দুজন কাঁদছে। এর মধ্যেই দেশ-বিদেশ থেকে ফোন আসতে শুরু করল একটার পিঠে আরেকটা। কিন্তু ইন্টারনেট বা নেটওয়ার্কের ঝামেলায় আমার কথা কেউ শুনতে পাচ্ছিল না পরিষ্কার। ফেসবুকেও কেউ কেউ জানতে চাইল কী হচ্ছে তুরস্কে? বুঝলাম অবস্থা সুবিধার নয়। তাড়াতাড়ি একটা ছোট্ট পোস্ট লিখলাম, ‘আমি ভালো আছি। চিন্তা কোরো না। সবাই শুধু দোয়া করো।’
জলদি আমার আগের রুমমেটের কাছে গিয়ে বললাম, তোমার ভাইবোন কল দিচ্ছে। তাড়াতাড়ি ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করো। তখনই আরেক রুমমেট এসে বলল, ক্যু সফল হয়েছে বলে জানিয়েছে রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল ‘টিআরটি’। দ্রুত নিচতলায় নেমে এলাম। টিভিরুমে ঢুকে দেখি সবাই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কেউ কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। কেউ আবার হাত তুলে মোনাজাত ধরেছে। তবে দলমতের যত পার্থক্যই থাক না কেন, সবার মুখে একটি কথাই শোনা যাচ্ছিল, ‘আমরা সেনাশাসন চাই না।’
১৫ জুলাই রাত প্রায় সাড়ে ১২টা। টেলিভিশন ঘরে উদ্বিগ্ন সবাই। এর মধ্যে হেলিকপ্টারের আনাগোনা ও গোলাগুলির শব্দটা বাড়তে লাগল। সবাই ভীষণ ভয় পেয়েছি। দরজাগুলো তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। টিভিতে সেনাবাহিনী কোথায় তাদের অবস্থান নিয়েছে, সেই সংবাদগুলো দেখাচ্ছিল। ইস্তাম্বুলের বসফরাস সেতুতে সেনাবাহিনীর অবস্থান নেওয়ার দৃশ্যটি বারবার দেখাচ্ছিল। কোথাও কোথাও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংঘর্ষ চলছে। আমি সাধারণ মানুষকে ট্যাংকের ওপরে উঠে যেতে দেখে পাশের তুর্কি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওরা এমন করছে কেন? ওরা কি সেনাবাহিনীকে সমর্থন করছে?’ মেয়েটি আমাকে বলল, ‘না। ওরা প্রতিবাদ করছে।’
সে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘তুমি কোন দেশ থেকে এসেছ? তোমার দেশে কি এমন কিছু হয়েছে কখনো?’ আমি জানালাম, হয়েছে, তবে ওরা টিকতে পারেনি। কারণ, সাধারণ মানুষ চায়নি।
রাষ্ট্রপতি এরদোয়ানের বার্তা
ঘড়িতে তখন রাত ১টা বেজে ৩০ মিনিট। হঠাৎ দেখি প্রধানমন্ত্রী ইলদিরিম ও রাষ্ট্রপতি এরদোয়ানের বার্তা এসেছে, ‘এই প্রচেষ্টা সফল হবে না। যারা এসব করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তখনো কোনো কোনো জায়গা থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছিল, রাষ্ট্রপতি অন্য দেশে পালিয়েছেন। এসব গুজবকে বেশিক্ষণ ডালপালা মেলার সুযোগ দিলেন না এরদোয়ান। সাংবাদিকদের সঙ্গে সরাসরি ভিডিও কলে কথা বললেন। সাধারণ জনগণকে রাস্তায় নেমে এসে এর প্রতিবাদ করতে বললেন। এরপরের দৃশ্যটি অন্য রকম। হাজার হাজার মানুষ দলমত-নির্বিশেষে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য রাস্তায় নেমে এসেছে। বিভিন্ন দলও গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন জানাতে শুরু করেছে। প্রাণ হাতে নিয়ে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবার রাস্তায় নেমে আসাটা আমাকে বেশ নাড়া দিয়েছে। ওদের দেশপ্রেম দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। এর মধ্যে ডরমিটরির প্রধান এসে হাজির। বললেন, ‘মেয়েরা, তোমাদের একা রেখে বাসায় স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। ভয় পেয়ো না। তর্কে লিপ্ত হয়ো না। সবাই সবাইকে সাহস দাও। কেউ বারান্দায় যেয়ো না।’
জনতার প্রতিরোধের মুখে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে গেছে সেনা অভ্যুত্থানরাত দুইটার সময় ভদ্রমহিলাকে দেখে মেয়েরা কিছুটা সাহস পেল। সবাই রুমে ফিরে এল। কিন্তু ১০ মিনিট না যেতেই বোমার শব্দে কেঁপে উঠল পুরো ভবন। সবাই আবার ছোটাছুটি শুরু করে দিল ভয়ে। এত ভয় পেয়েছি যে সমস্ত শরীর কাঁপছিল। ঠিক পাঁচ মিনিট পর আরও একটা বোমার বিস্ফোরণ। সারা রাত টিভিতে লাইভ দেখে আর বোমার শব্দে কেটেছে।
ততক্ষণে সরকার দাবি করছে, পরিস্থিতি ৯৯ শতাংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে। তবে এখনো আশঙ্কামুক্ত নয়। তাই জনগণকে রাস্তা না ছাড়ার অনুরোধ করা হয়। ১৫ জুলাই রাত থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত জনগণ রাস্তা ছাড়েনি। ১৮ তারিখ বিকেলে প্রধানমন্ত্রী ইলদিরিম সবাইকে আবার কাজ শুরু করার এবং বিকেলবেলা গণতন্ত্র মিছিলে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান।
আমি বেশ কজন তুর্কি মেয়েকেই বলতে শুনেছি, এরদোয়ানকে তাদের পুরোপুরি পছন্দ নয়। তাই বলে সেনাশাসনকেও তারা সমর্থন করে না। আবার কারও কাছে এরদোয়ান প্রাণের নেতা। তাঁর জন্য জীবন দিতে তারা প্রস্তুত। সে যা-ই হোক না কেন, তুর্কিরা নিজের দেশকে নিজের পতাকাকে কতটা ভালোবাসে, তা তারা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে। আর আমিও এই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকলাম। জনগণের শক্তির কাছে বন্দুক কীভাবে তুচ্ছ হয়ে যায়, সেটাই তারা জীবন বাজি রেখে দেখিয়ে দিল।-প্রথম আলো
লেখক: তুরস্কের আঙ্কারার গাজী ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যয়নরত
২৩ জুলাই ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এইচএস/কেএস