মনির হোসেন : বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি বৃহৎ দেশে জনশক্তি রফতানি কয়েক বছর ধরেই বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে প্রতি মাসে হাজার হাজার শ্রমিক পাড়ি জমাচ্ছে। চলতি বছরের সাড়ে ছয় মাসে দেশটিতে প্রায় সোয়া লাখের মতো বাংলাদেশী শ্রমিক পাড়ি জমিয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, ওমানে থাকা এসব কর্মীর মধ্যে অনেকেই চুক্তি মোতাবেক ঠিকমতো বেতনভাতা পাচ্ছে না। কোনো কোনো কোম্পানিতে শ্রমিকদের ওপর চলছে মানসিক নির্যাতন। যার কারণে তাদের এখন দিন কাটছে অনেকটা মানবেতরভাবে।
সর্বশেষ ওমানের রাজধানী মাস্কাট থেকে শত কিলোমিটার দূরের মার্ককাট শহরের আলফা ওমান এলএলসি কন্সট্রাকশন কোম্পানির ভাড়া করা একটি বাড়িতে রাজশাহী উপজেলার ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে মকবুল হোসেন বাচ্চু, টাঙ্গাইলের গাজী মাজহারসহ ৫৭ শ্রমিকের দিন কাটছে মানবেতরভাবে।
ইতোমধ্যে কোম্পানি থেকে তাদের বাড়িভাড়া পরিশোধ না করায় ওই বাড়ির মালিক বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এতে পানির তীব্র সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি কোম্পানির মালিককে জানানো হলেও তিনি বেতন সমস্যার দ্রুত সমাধানের কথা বলে সময় ক্ষেপণ করছেন। এ অবস্থায় তাদের থাকা ও খাওয়াসহ নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গতকাল শনিবার রাতে ওমানের ওই বাসা থেকে টেলিফোনে মকবুল হোসেন বলেন, আমরা মোট ৫৭ জন লোক দুই বছর ধরে এই কোম্পানিতে কন্সট্রাকশনের কাজ করছি। চুক্তি মোতাবেক ১২০ রিয়াল বেতন দেয়ার কথা থাকলেও মালিক শুরুতেই ২০ রিয়াল বেতন কম দিয়েছে। এক রিয়াল সমপরিমাণ ২০০ টাকা। পরে বেতন বাড়ানোর আশ্বাস দিলেও সেটি আর মালিক বাড়ায়নি। এ অবস্থায় আমাদের কোম্পানিতে কাজ না থাকার দোহাই দিয়ে ছয়-সাত মাস ধরে ৫৭ জন শ্রমিকের বেতন ঠিকমতো দিচ্ছে না মালিক। তিনি বলেন, গত দুই মাসের পুরো বেতন আটকে রেখেছেন কোম্পানির মালিক খামিজ।
এক প্রশ্নের উত্তরে মকবুল হোসেন বলেন, আমরা এখন মালিকের ভাড়া করা যে বাসায় আছি ওই বাসার বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেয়া হয়েছে। ফলে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে পানির। তিনি বলেন, এই দেশে এত গরম বেশি এসি ছাড়া এক মুহূর্ত থাকা যায় না। কিন্তু এখন বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন হওয়ায় আমাদের সবার কি ভয়াবহ কষ্ট হচ্ছে তা কাউকে বলে বোঝাতে পারব না।
এসব সমস্যা বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানানো হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের বেতন নাই। দূতাবাস অনেক দূরে। তাই চেষ্টা করেও দূতাবাসে এসব অভিযোগ জানাতে পারিনি। মালিক তাদের বলেছে, দু-এক দিনের মধ্যে বেতন সমস্যার সমাধান করে দেবে। কিন্তু এভাবে দু’ মাস পার হয়ে গেছে। বর্তমানে আমরা অনেকটা বদ্ধ ঘরে আটকে রয়েছি জানিয়ে তিনি বলেন, এখান থেকে আমাদের উদ্ধারের ব্যবস্থা করেন।
এ দিকে রাজশাহী থেকে আমাদের তানোর সংবাদদাতা লুৎফর রহমান জানান, মকবুল হোসেন বাচ্চুর গৃহবন্দী থাকার সংবাদ পাওয়ার পর থেকেই তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মাতম শুরু হয়ে গেছে। তারা তাদের প্রিয় মানুষটিকে দ্রুত ওমান থেকে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের কাছে দাবি জানান।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিসংখ্যান ঘেঁটে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত দেশটিতে শ্রমিক রফতানি হয়েছে এক লাখ ৯ হাজার ৫৭২ জন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১৫ হাজার ৫৫৬ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ১৫ হাজার ৭৭৪, মার্চে ১৭ হাজার ৪৯, এপ্রিলে ১৭ হাজার ১৮২, মে মাসে ১৭ হাজার ৪৬৮ ও জুন মাসে ১৯ হাজার ২৯১ জন। আর চলতি মাসের ১৬ জুলাই পর্যন্ত দেশটিতে সাত হাজার ২৫২ জন পাড়ি জমিয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ওমান ছাড়া আর কোনো দেশেই এত বিপুল পরিমাণ শ্রমিক পাড়ি জমায়নি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ওমানে শ্রমিক যাওয়ার হার ২৭.৬৮।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো থেকে ওমানগামী শ্রমিকদের নামে যেসব ছাড়পত্র দেয়া হচ্ছে সেগুলো দেয়ার আগে অবশ্যই বেতনভাতা ঠিক রয়েছে কি না তা যাচাই-বাছাই করতে হবে। তারা বলছেন, সম্প্রতি ওমানে পাড়ি জমানো অনেকেই চুক্তি মোতাবেক বেতনভাতা পাচ্ছে না। ওমানে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাস ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে মনিটরিং করার আহ্বান জানান তারা। কারণ এমনিতেই মালয়েশিয়া, দুবাইসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু শ্রমবাজার এখনো বন্ধ রয়েছে। এই মুহূর্তে ওমানের বাজার হাতছাড়া হলে তখন জনশক্তি রফতানির গতি আরো কমে যাবে বলে তারা মনে করছেন। -নয়া দিগন্ত
২৪ জুলাই ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস