তসলিমা নাসরিন: নির্বাসন বইটি বের করছে পেঙ্গুইন। অক্টোবরে উদ্বোধন। ‘নির্বাসন’ লিখেছিলাম প্রায় পাঁচ বছর আগে। বইটি বের হয়েছিল কলকাতা বইমেলায়। উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন আমার প্রকাশক। কিন্তু অনুষ্ঠানটি করতে দেননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। আমার নামটি বাংলাদেশে থেকে আমার নির্বাসন হওয়ার পর যেমন নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, তেমনি নিষিদ্ধ হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর।
নির্বাসনে আমি বর্ণনা করেছি কী করে আমাকে প্রথমে পশ্চিমবঙ্গ থেকে, তারপর রাজস্থান থেকে, তারপর পুরো ভারত থেকেই তাড়ানো হয়েছিল। কী করে আমাকে গৃহবন্দি করা হয়েছিল। কী ভীষণ অনিরাপদ ছিলাম আমি রাষ্ট্রের নিরাপদ গৃহে। সরকার আমাকে ছলে-কৌশলে দেশে থেকে তাড়াতে চাইছে। আর আমি অসহায় এক নির্বাসিত লেখক – যার পাশে কোনও রাজনৈতিক দল নেই, সংগঠন নেই, সাধারণ কিছু মানুষ ছাড়া নামী দামী মানুষ নেই-- একা বিশাল এক রাষ্ট্রযন্ত্রের সামনে অনড় দাঁড়িয়ে থেকেছি, সরকারি কোনও উপদেশ বা আদেশ মানিনি, শুধু মনোবল ছাড়া আর কিছুই ছিল না সম্বল। আমি কোনও অন্যায় করিনি, আমি কেন শাস্তি পাবো! পৃথিবীর সন্তান আমি, ভালোবেসে যে দেশটিতে বাস করতে চাইছি, সে দেশটিতে বাস করার কেন আমার অধিকার থাকবে না! সেক্যুলার গণতন্ত্র বলে দাবি করছে যে দেশ, সে দেশ কেন একজন সৎ-সাহসী আর সেক্যুলার লেখককে দেশ থেকে তাড়াবে, কিছু নারীবিরোধী, অসৎ আর অসহিষ্ণু মৌলবাদীকে খুশি করার জন্য!
একসময় জীবন বাঁচাতে ভারত থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম বটে, কিন্তু শত নিষেধ, শত বাধা, শত তাণ্ডব, আর শত হুমকি সত্ত্বেও ফিরে এসেছি ভারতে। ভারত ছাড়া আমার উপায় নেই বলে নয়, ভারত যেন মুক্তচিন্তাকে সম্মান করে, সে কারণে। আমি আমার মত প্রকাশ করবো, সে মত অন্যের মতের চেয়ে ভিন্ন হোক, এবং ভারতে বাস করবো। ভারতকে দেখে যেন শেখে ভারতের প্রতিবেশি দেশগুলো যেন অনুপ্রাণিত হয় তারা, যারা এখনও জানে না বাক স্বাধীনতা ঠিক কাকে বলে।
এখনও যে আমি খুব নিশ্চিন্তে বাস করি ভারতবর্ষে তা নয়। এখনও মৃত্যুর হুমকি পাচ্ছি। কলকাতার এক ইমাম আমার মুখে চুনকালি মাখিয়ে দিয়ে আমাকে অপদস্থ করার মূল্য কুড়ি হাজার ঘোষণা করেছিলেন, প্রায় বারো বছর আগে। তারপর মাথার মূল্য ধার্য করেছিলেন পঞ্চাশ হাজার টাকা, এরপর তো বলেই ফেললেন ‘আনলিমিটেড অ্যামাউন্ট অব টাকা’ দেবেন আমার মুণ্ডুটি যে কেটে নিয়ে যেতে পারবে, তাকে। উত্তর প্রদেশ থেকে মুসলিম ল’ বোর্ডের এক পরিচালক ঘোষণা করেছিলেন পাঁচ লাখ টাকা। নতুন ফতোয়া তো আগের চেয়ে ভয়ঙ্কর। কেরালার আইসিস গোষ্ঠী ফেসবুকে ঘোষণা করে দিয়েছে আমাকে যেন অতি শিগগির মেরে ফেলা হয়। পার্লামেন্টে একজন বড় নেতা তো ইসলাম সম্পর্কে কবে কোথায় কী বলেছি, তা নিয়ে ভীষণ ক্ষুব্ধ। বলে দিয়েছেন ইসলাম সম্পর্কে আমি যেন ভারতীয় কোনও মিডিয়ায় আমার মত প্রকাশ করার সুযোগ না পাই।
সরকার কোথায় মৌলবাদীদের রুখবে তা নয়তো মৌলবাদীদের দাবিই এক এক করে মেটায়। আমার বই নিষিদ্ধ করা, আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাড়ানো, পত্র পত্রিকায় আমার লেখালেখি বন্ধ করা, টিভিতে আমার মেগা সিরিয়ালের প্রচার বন্ধ করে দেওয়া, ভারত থেকে আমাকে তাড়ানো—এসবের পেছনে আছে ভোটব্যাংকের হিসেব, মৌলবাদীদের চোখ রাঙানিকে ভয় অথবা তাদের তোষণ। এই তোষণের রাজনীতি গণতন্ত্রকে বড় দুর্গন্ধ করে দেয়। রাজনীতিকদের কি জানেন না যে ধর্মীয় মৌলবাদীরা সমাজকে অন্ধকারে ফেলে রাখতে চায়, তারা নারীর অধিকারে তো নয়ই, মানবাধিকারেই বিশ্বাস করে না, তাদের মতের সঙ্গে যারা একমত নয়, তাদের বাক স্বাধীনতায় তারা বিশ্বাস করে না।
পৃথিবীতে শুধু আমি নই, আরও অনেক লেখককে সইতে হচ্ছে নির্যাতন। লেখককে চাবুক মারা হচ্ছে, জেলে ভরা হচ্ছে, নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে অথবা মেরে ফেরা হচ্ছে। বাক স্বাধীনতার গুরুত্ব এখনও একনায়করা তো নয়ই, অধিকাংশ গণতান্ত্রিক সরকারও বুঝতে চায় না। বাক স্বাধীনতার কথা বলতে গেলে অনেককে বলতে শুনি, এটির একটা সীমা আছে। বাক স্বাধীনতা মানে কারও অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া নয়। কখনও কারও অনুভূতিতে কোনও আঘাত লাগবে না-- এভাবে সারাজীবন বাঁচতে চাওয়ার দাবি করাটা খুব অদ্ভুত। অন্যের কথায় এবং কাজে আমাদের সবার মনে অহরহই আঘাত লাগছে। মনে আঘাত লাগবেই, কারণ সমাজে নানা মানসিকতার মানুষ বাস করে। কারও মতের সঙ্গে নিজের মত না মিললে যদি অনুভূতিতে আঘাত লাগে, সে আঘাতকে পুষিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আমাদের সবারই থাকে। শুধু ইসলামে বিশ্বাসীদের মধ্যে কিছু কট্টর লোক অনুভূতির আঘাতকে সহ্য করবে না বলে চারদিকে অশান্তি করছে।
গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে যায় যদি মানুষের বাক স্বাধীনতা বা মত প্রকাশের অধিকার না থাকে। সমাজ বদলাতে হলে নানান লোকের নানান অনুভূতিতে আঘাত লাগে। কারও কোনও অনুভূতিতে আঘাত দিতে না চাইলে সমাজটাকে বদলানো যাবে না। রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করতে গেলে বা নারীবিরোধী আইন দূর করতে গেলেও মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগে। ধর্মানুভূতিতে আঘাত না দিয়ে খুব বেশি ভালো কাজ আজ অবধি সমাজে হয়নি। ইউরোপ থেকে গির্জার দুঃশাসন বন্ধ করার সময়ও প্রচুর লোকের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছিল। গ্যালিলিওর কথায়, ডারউইনের ভাষ্যে লোকের ধর্মানূভূতিতে আঘাত লেগেছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে কুসংস্কাচ্ছন্ন মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে। কিন্তু তাদের আঘাত লাগবে বলে যদি আমরা মত প্রকাশ করা বন্ধ করে দিই, যদি আমরা বিজ্ঞানের আবিষ্কার এবং ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দিই, সভ্যতার চাকাকে থামিয়ে রাখি, তবে সমাজটাকে স্থবির জলাশয় হিসেবেই রেখে দিতে হবে, একে আর স্বতঃস্ফূর্ত স্রোতস্বিনী করে গড়ে তোলা হবে না আমাদের। মানুষের মন জুগিয়ে কথা বললে মত প্রকাশের অধিকারের বা বাক স্বাধীনতার কোনও প্রয়োজন পড়ে না। বাক স্বাধীনতা একমাত্র তাদের জন্যই, যাদের মতের সঙ্গে অধিকাংশ লোকের মত মেলে না। যে কথাটা তুমি শুনতে চাও না, সে কথাটি বলার অধিকারের নামই বাক স্বাধীনতা। বাক স্বাধীনতা তাদের দরকার নেই যাদের মত শুনে কেউ মনে আঘাত পায় না। বাক স্বাধীনতার পক্ষে না থেকে যখন সরকার বাক স্বাধীনতা বিরোধীদের পক্ষ নেয়, তখন নিজের দেশটার ধ্বংস নিজেই ডেকে আনে।
বাক স্বাধীনতা বিরোধী একটি আইন সেদিন ভারতবর্ষে নিষিদ্ধ হলো। কালো আইনটি বাতিল করার লড়াইয়ে হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যে ছিলাম আমিও। আমি ভারতের নাগরিক না হয়েও ভারতের একটি অসাংবিধানিক আইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি, এবং জিতেছি। ভারতের মত-প্রকাশ-বিরোধী আইন হঠাতে আমার একটি ভূমিকা রয়ে গেল। কালো আইনটি বাতিল করার লড়াইয়ে হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যে ছিলাম আমিও। এই আইনটির কারণে অনেক নিরপরাধ মানুষের ভোগান্তি হয়েছে। আমারও হয়েছে। নারীবিরোধী ও মানবতাবিরোধী ধর্মান্ধদের তথাকথিত ধর্মানুভূতিতে যেন আঘাত না লাগে, সে কারণে জগৎ সজাগ। এখনও কি জগতের সময় হয়নি সবাইকে সমান চোখে দেখার! ধর্মান্ধদের বাড়তি খাতির না করার! যুক্তিবাদীদের মানবাধিকারকে সম্মান করার!
শুধু ভারতবর্ষেই নয়, সারা পৃথিবীতেই এই লড়াই চলছে। লড়াইটা কিন্তু বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে নয়, এই লড়াই দুটো মতবাদের মধ্যে, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মৌলবাদ। লড়াইটা বিজ্ঞানমনস্কতা আর ধর্মান্ধতার মধ্যে, যুক্তিবাদিতা আর কুসংস্কারের মধ্যে, জ্ঞান আর অজ্ঞানতার মধ্যে, সচেতনতা আর অচেতনতার মধ্যে, স্বাধীনতা আর পরাধীনতার মধ্যে। এই লড়াইয়ে আমি জানি, আমি কোন পক্ষ। বিপক্ষের মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে আমি, কিন্তু তার মতকে মেনেও নিতে চাই না, শ্রদ্ধাও করতে চাই না। তার মানে এই নয় যে ভোরবেলায় বিপক্ষের কেউ যখন মর্নিং ওয়াকে বেরোবে, আমি তাকে গুলি করে মারবো বা সে যখন ফুটপাতে হাঁটতে থাকবে, তাকে আমি চাপাতি চালিয়ে খুন করবো। না, কারও মত আমার অপছন্দ হলে তাকে আমি চুমু খাবো না, তার গালে আমি চড়ও দেবো না। আমি লিখবো। লিখে আমি আমার মত প্রকাশ করি। কারও যদি আমার লেখা পছন্দ না হয়, লিখে আমার লেখার প্রতিবাদ করতে পারেন, আমার মতের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতে পারেন, কিন্তু আমাকে মারতে আসতে পারেন না। বাক স্বাধীনতার এই শর্তটি আজকাল অনেকেই জানেন। জানলেও কিছু কিছু ধর্মীয় মৌলবাদী-সন্ত্রাসী এই শর্তটি মোটেও মানতে চান না।
এভাবে কি ধর্ম টিকে থাকে? পৃথিবীতে শত শত ধর্ম ছিল। এখন তারা বেশির ভাগই বিলুপ্ত। কোথায় আজ অলিমাপিয়া পাহাড়ের সেই ডাক সাইটে গ্রীক দেবতারা, কোথায় শক্তিশালী রোমানদের নামীদামী ঈশ্বর? কোথায় মিশরীয় ফারাওদের ঈশ্বর? সব আজ ইতিহাস। সব ধর্ম একসময় ইতিহাস হবে। যুগোপযুগি নতুন ধর্ম আসবে অথবা যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানমনস্কতায় মানুষের বিশ্বাস বাড়বে।
এভাবেই হয়তো চলবে পৃথিবী। অশিক্ষা, জড়তা আর মূর্খতা চলবে শিক্ষা আর সচেতনতার পাশাপাশি। ধর্মান্ধ আর রাজনীতিক নিজেদের স্বার্থ দেখবে, সমাজটাকে অন্ধকারেই ফেলে রাখবে, শুধু সুস্থ সচেতন মানুষই সমাজ পাল্টাবে। হাতে গোনা কিছু মানুষই সমাজ পাল্টায়। চিরকাল তাই হয়েছে।
শুধু ভিন্ন মত হওয়ার কারণে পৃথিবীর আর কারও যেন নির্বাসন দণ্ড ভোগ করতে না হয়। আর কাউকে যেন আমার মতো ভুগতে না হয়।
লেখক: কলামিস্ট
৩১ জুলাই,২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এইচএস/কেএস