তসলিমা নাসরিন : ১. ইউরোপের যে দেশগুলোয় বামপন্থী দল ভোটে জিতত, সেই দেশগুলোয় এখন চরম ডানপন্থী দলের জনপ্রিয়তা। মুসলিম জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়তে এবং মুসলিম মাইগ্রেশন বন্ধ করতে চরম ডানপন্থীরাই ভালো পারবে বলে জনগণ বিশ্বাস করছে। পাশ্চাত্যের উদার নীতি এখন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে আতংকে। যে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবাধিকার আর মানবতার জয়গান গাইছিল ওরা, সেসব আগের মতো উচ্চস্বরে গাইতে পারছে না। ইউরোপে বারবার জঙ্গি হামলায় ওরা সন্ত্রস্ত। বার বার থামিয়ে দিতে হচ্ছে গান। চরম ডানপন্থী দল ক্ষমতায় এলে কাদের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি? ইউরোপের বাস করছে যে অগুনতি সাধারণ মুসলমান, তাদের। যতই নিরপরাধ হোক তারা, তাদের দেখে দূরে সরবে ইউরোপীয়রা, তাদের দিকেই ঘৃণা ছুড়ে দেবে।
মানবাধিকারকে সম্মান দিতে ভিনদেশি ভিনধর্মী ভিনসংস্কৃতির মানুষকে ওরা গ্রহণ করেছিল। এখন উদারতাকে গুটিয়ে নিতে চাইছে অনেকে। মানবাধিকারকে সম্মান দিতে গিয়ে ওরা আর কোনও মুসলিমকে আশ্রয় দিতে চায় না, কারণ ওই মুসলিমদের মধ্যে ঘাঁপটি মেরে থাকতে পারে আতংকবাদী। জার্মানিতে এর মধ্যেই কিছু মানুষ খুন হয়েছে, মেয়েদের ওপর যৌন আক্রমণ হয়েছে। যে জার্মান আর সুইডিশরা সিরিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে আসা লক্ষ উদ্বাস্তু আরবকে সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, তারাই এখন ভয়ে সিঁটিয়ে আছে।
মুসলিম জঙ্গিদের কারণেই ভেঙে যাচ্ছে ইউরোপের উদারনীতি, মানবাধিকার রক্ষার ঐতিহ্য।
২. আমেরিকার ফ্লাইট থেকে মুসলমানদের নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেদিনও প্যারিস থেকে সিনসিনাটি যাওয়ার জন্য আমেরিকার বিমানে ওঠা এক দম্পতিকে বের করে দেওয়া হলো। তাদের মুসলমান নাম। পুরুষটি নাকি সিটে বসে ঘামছিল। নারীটি নাকি মোবাইলে এসএমএস করছিল। দুজনে যখন কথা বলছিল, আল্লাহ শব্দটি উচ্চারণ করেছিল কেউ একজন। হয়তো ইনশাল্লাহ, মাশআল্লাহ এই ধরনের কোনও শব্দ। এসব দেখে এক কেবিন ক্রু পাইলটকে জানালো সে ভয় পাচ্ছে। পাইলট সিকিউরিটিকে জানালো। ব্যস, সিকিউরিটির লোক এসে দম্পতিকে বিমান থেকে নামিয়ে দিল। এরকম হামেশাই হচ্ছে আমেরিকার ডোমেস্টিক আর ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটগুলোতে।
আমার কী হবে? আমি তো পাঁড় নাস্তিক। কিন্তু আমার নামটি তো আরবি-ফার্সি। আমি যদি ঘামি বা টেক্সট করি, আমাকে তো মুসলিম সন্ত্রাসী ভেবে ফ্লাইট থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করবে। যতই বলবো আমি ইসলামে বিশ্বাস করি না, কে শুনবে আমার কথা? কেউই না।
ভাবছি সাধারণ শান্তিপ্রিয় মুসলিমদের কথা। মুসলিম সন্ত্রাসীরা বিশ্বময় সন্ত্রাস করে বেড়াচ্ছে। ওদের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে সাধারণ মুসলিমদের। বিশেষ করে যারা ইউরোপ আমেরিকায় থাকছে। এরা অমুসলিমদের ঘৃণার শিকার হচ্ছে প্রতিদিন। পাশ্চাত্যের রেসিস্টদের সবচেয়ে সুবিধে করে দিয়েছে মুসলিম সন্ত্রাসীরা। তারাই রেসিস্টদের ভেতর কালো-বাদামি বিদ্বেষ -ছাড়াও যে মুসলিম বিদ্বেষ আছে, সেটিকে যৌক্তিক করে তুলছে। এখন মুসলিম বিরোধিতা রেসিস্টদের আর সিক্রেটলি করার দরকার নেই, পাবলিকলি করলেও চলছে।
৩. আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা দেখে আমার খুব মন খারাপ হয়ে যায়। জানি যে ট্রাম্পের জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে আছে মুসলিম জঙ্গি ভীতি। যে কোনও সাধারণ মুসলমান দেখেই এখন ভয় জাগছে মানুষের। টুইন টাওয়ারে জঙ্গি হামলার পর মানুষ এমনই মুসলিমদের ঘৃণা করতে শুরু করেছিল যে মাথায় টারবান পরা শিখদের মুসলিম ভেবে গুলি করে মারতো। আর এখন তো বিশ্ব জুড়ে শুরু হয়েছে জঙ্গি হামলা। তটস্থ হয়ে আছে আমেরিকার লোকেরা। ট্রাম্পের মতো একটা গবেটের প্রেসিডেন্ট ইলেকশানে নমিনেশন পাওয়া তো সেটাই প্রমাণ করে।
আমি বার্নি স্যানডার্সের সমর্থক। কিন্তু বার্নির যেহেতু নমিনেশন জোটেনি, অগত্যা হিলারিকে সমর্থন করতেই হয়। ট্রাম্পকে পরাজিত করাই মূল উদ্দেশ্য। বার্নিও হিলারিকে সমর্থন করছেন। কিন্তু বার্নির সমর্থকদের অনেকে হিলারিকে কিছুতেই ভোট দেবে না। দিতে হলে গ্রিন পার্টিকে দেবে, হিলারিকে নয়। ট্রাম্পের ক্ষমতায় যাওয়া রোধ করার জন্য সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে সক্রিয় হতে হবে। ট্রাম্প জিতে গেলে শুধু মুসলমানদের সমস্যা নয়, সমস্যা আমেরিকার সব মানুষের। আমেরিকার নারীকূলের। সেদিন এক মুসলিম দম্পতি, আমেরিকার নাগরিক, যাদের সৈনিক পুত্র, ইরাকের যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে, ট্রাম্পের মুসলিম বিরোধিতাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, সংবিধান দেখিয়ে বলেছেন, কোথাও এমন কথা লেখা নেই যে কাউকে তার ধর্মবিশ্বাসের কারণে নির্যাতন করা যায়। ট্রাম্প অবশ্য পরে জানিয়েছেন, তিনি শুধু মুসলিম জঙ্গিদের বিরুদ্ধে, সাধারণ মুসলিমদের বিরুদ্ধে নন তিনি। তা যদি হয় তো ভালো। তারপরও আমি বলবো, ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য যোগ্য ব্যক্তি নন।
৪. এখন এক জঙ্গির কথা বলি, যার কাহিনী পড়ে আমি থ হয়ে গিয়েছি। তাকিউর রহমানের জীবনের কথা বলছি। তার বাবা বগুড়ার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। ১৯৯৬ সালে তাকিউর ভারতের দার্জিলিং-এ একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তে শুরু করে। ২০০৪ সালে সেখান থেকে ‘ও লেভেল’ এবং ২০০৬ সালে ঢাকার লন্ডন কলেজ অব লিগ্যাল স্টাডিজ থেকে ‘এ লেভেল’ পাস করে। এরপর লন্ডনের ক্যানটারবেরি ক্যান্ট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়। সেখানে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে ২০০৯ সালে। পরের বছর লন্ডন থেকেই বার-এট-ল (ব্যারিস্টার) শেষ করে। ইন্টার্নি শেষে ২০১১ সালের প্রথম দিকে দেশে ফেরে। এরপর থেকে হাইকোর্টে প্র্যাকটিসের পাশাপাশি লন্ডন কলেজ অব লিগ্যাল স্টাডিজ ও ভুঁইয়া একাডেমিসহ ৪-৫টি প্রতিষ্ঠানে আইন বিষয়ে শিক্ষকতা করে। ২০১১ সালে প্রেম করে এক কর্নেলের মেয়েকে বিয়ে করে। এরপর স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকার লাক্সারি ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করে। হাইকোর্টে প্র্যাকটিস, টিউশনি ও শিক্ষকতা করে মাসে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা আয় করতো। এই তাকিউরই হঠাৎ করেই দাড়ি রাখা আর নামাজ রোজা করতে শুরু করে। গত বছরের এপ্রিলের শুরুতে তাকিউর তার স্ত্রী কন্যাকে নিয়ে ওমরাহ হজ পালন করতে যায়। ১৩ এপ্রিল ফোনে আত্মীয়-স্বজনকে জানায়, তারা সৌদি আরবে আছে। ওমরাহ শেষ হলে ২২ এপ্রিল দেশে ফিরবে। কিন্তু ২২ এপ্রিলে তাকিউর দেশে ফেরে না। কয়েক মাস পর অজ্ঞাত একটি নম্বর থেকে বাবাকে ফোন করে তাকিউর বলে, তারা ভালো আছে।
কোথায় আছে তাকিউর? তাকিউর সিরিয়ায়। মানুষ মারার ট্রেনিং নিচ্ছে। একসময় দেশে ফিরে নিরীহ মানুষগুলোকে কুপিয়ে মারবে। কোপাতে তার হাত এতটুকু কাঁপবে না। বুক তো কাঁপবেই না।
সমাজের অনেক মেধাবী ছেলে জঙ্গি হচ্ছে। ভালো ছেলেরা ঘর ছাড়ছে। পড়ে থাকছে অরডিনারি ছেলে। ভালোরা হয় মারছে নয় মরছে। মাদ্রাসায় পড়া ছেলেগুলোর মধ্যেও অনেকে জঙ্গি হচ্ছে। কিন্তু তাকিউরের মতো উচ্চ শিক্ষিত ব্যারিস্টার কী করে জঙ্গি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, সেটিই ভাবনার বিষয়। মাদ্রাসা বন্ধ করে, বা সিলেবাস পাল্টে দিয়ে মাদ্রাসাকে জঙ্গি তৈরির কারখানা বানানো হয়তো রোধ করা যাবে। কিন্তু তাকিউরদের বাঁচানোর উপায় কী? ব্যারিস্টার ছেলেটি কি শুধুই মানুষের গলা কাটতে পারবে এই আনন্দে ঢুকেছে আইসিসে? নাকি হঠাৎ করে সে তার বড়বেলায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছে অবিশ্বাসীদের হত্যা করলে বেহেশত মিলবে। অথবা দুনিয়ার যত অমুসলিম আছে সবাইকে হত্যা করে পৃথিবীটাকে শুধু মুসলমানদের পৃথিবী বানানোটা মুসলমানদের প্রধান কাজ। এই ব্রেন নিয়ে কী করে ছেলেটা ও লেভেল, এ লেভেল, আর ব্যারিস্টারি পাস করলো, বুঝে পাই না।
এই জঙ্গিরাই সাধারণ শান্তিপ্রিয় মুসলমানদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে। তাকিউররা খুন করতে আসছে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষদের, এই নিরীহ মানুষের মধ্যে হিন্দু খ্রিস্টান যেমন আছে, মুসলমানও আছে। আমরা তো হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁতেই দেখেছি কী করে মুসলমানদের গলা কেটেছে জঙ্গিরা। কারও তো সামান্য হাত কাঁপেনি। -বাংলা ট্রিবিউন
০৮ আগস্ট, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম