রাজশাহী : গত ২৯ জুলাই জাতীয় দুইটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জেএমবির দুই সক্রিয় সদস্যকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি)। এদের মধ্যে গত ২ আগস্ট রাজশাহী নগরীর আশরাফের মোড় এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নজরুল ওরফে হাসান ওরফে বাইক হাসান (২৬) নিহত হন। আরেক জেএমবি সদস্য হলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র শরিফুল ইসলাম ওরফে খালিদ (২৫)।
এক বছর তিনমাস ধরে নিখোঁজ জেএমবির সক্রিয় সদস্য শরিফুল ইসলাম নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার রাজশাহী’র ব্যানারে চিকিৎসকসহ আরও মুক্তচিন্তার মানুষকে হত্যার পরিকল্পনাকারীর অন্যতম আসামি।
পুলিশের দাবি, রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার নীরেন্দ্রনাথ সরকার নামে এক চিকিৎসককে হত্যার পরিকল্পনাকারী হিসেবে আমিনুল ইসলাম ওরফে রুমি ও এনামুল হক ওরফে সবুজকে সোমবার রাতে গ্রেফতার করা হয়েছে।
কিন্তু তাদের পরিবারের দাবি পুলিশ ১০ আগস্ট রাত ১টার দিকে বাগমারা উপজেলার শ্রীপুর খামারপাড়া এলাকায় নিজ বাড়ি থেকে আমিনুলের বাবা সাইফুল ইসলামকে ধরে থানায় নিয়ে যায়। এ সময় বাড়ি থেকে আমিনুল পালিয়ে যায়। আমিনুলকে ফেরত পেলে পুলিশ বাবা সাইফুলকে ছেড়ে দেবে। শর্ত অনুযায়ী পরের দিন বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার সময় আমিনুলকে নিয়ে থানায় যায় তার পরিবার। এরপর আমিনুলকে আটক করে তার বাবা সাইফুলকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। এরপর থেকে আমিনুলকে তার পরিবারের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখতে দেয়নি পুলিশ।
এ ব্যাপারে আমিনুলের ছোট চাচা মোখলেসুর রহমান বলেন, ভাইকে পুলিশ নিয়ে যাওয়ার পরের দিন সকালে ভাতিজাকে (আমিনুল) আমরা পুলিশের কাছে তুলে দেই। তারা ভাইকে ছেড়েছে,কিন্তু ভাতিজাকে ছাড়েনি।
আমিনুল ইসলাম ও এনামুল হক নামে গ্রেফতার দুই জঙ্গি খালাতো ভাই। আর পুলিশের পুরস্কার ঘোষণার তালিকায় থাকা শরিফুল ইসলাম ওই দুইজনের মামাতো ভাই। শরিফুলের সন্ধান চেয়ে গত ৪ জুলাই বাগমারা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে তার পরিবার। শরিফুল আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে জানিয়েছেন রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও সিনিয়র সহকারী কমিশনার ইফতেখায়ের আলম।
বুধবার দুপুর দুইটায় রাজশাহী শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে বাগমারা উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের এক নিভৃত এলাকায় খামারপাড়ায় পুলিশের তালিকায় তিন জঙ্গির বাড়িতে যান এই প্রতিবেদক। মিলন নামের আট-নয় বছরের একটি ছেলে প্রথমে গ্রেফতার আমিনুল ইলাম ওরফে রুমির বাড়িতে নিয়ে যায়। এসময় বাড়ির প্রধান ফটকে বসে ছিলেন আমিনুলের মা তয়েজান বেগম। পরিচয় দিতে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যান।
তয়েজান বেগম ছেলে সম্পর্কে বলেন, ‘ছোট থেকেই সেই (আমিনুল) কম কথা বলে। দশটা প্রশ্ন করলে একটার উত্তর দেয়। নামাজের সময় হলেই মসজিদে যায়। মিথ্যা কথা একেবারে পছন্দ করে না। তবে তার মাথা প্রায় ব্যাথা করে। এতে করে তার পড়ালেখায় তেমন মনোযোগ ছিল না। বাপের সঙ্গে কৃষি কাজ করতো।
বাগমারা পাইলট হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও বাগমারা ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ভবানীগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ভর্তি হয়েছিল আমিনুল। কিন্তু ভর্তির পর থেকে তেমন লেখাপড়া করেনি। বেশিরভাগ সময় বাড়িতে সময় কাটাতো। আর মাঝেমধ্যে পাশেই মুদি দোকানে আড্ডা দিতো।
মুদি দোকানি আলী হোসেন বলেন, আমিনুল ও এনামুল প্রায় আমাদের দোকানে সময় কাটাতো। কখনও অন্য এলাকার লোকজন তাদের কাছে আসতে দেখিনি। তাদের মামাতো ভাই যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি আসতো তখন তারা তার সঙ্গে বেশি মিশতো।
তয়েজান বেগম বলেন,শরিফুল আমার বড় ভাইয়ের ছেলে। তার সঙ্গে মেলা-মেশা করত আমিনুল। আমরা বিষয়টা অন্য চোখে দেখতাম না। কারণ তাদের বড় ভাই শরিফুল। কিন্তু সে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখার পাশাপাশি কি করতো তা আমরা জানতাম না। তার সঙ্গে আমার ছেলে ও বোনের ছেলে মিশে এখন বিপদেই পড়েছি আমরা।
তিনি বলেন, আমার ছেলে কখনও কোনও পার্টি করেনি। তবে নতুন পার্টির নামের তাদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই পার্টির (আনসার রাজশাহী) পেছনে কারা আছে তাদেরকে সবার আগে ধরা উচিত।
আমিনুলের ফুপা রস্তুম আলী বলেন, আমাদের ছেলেরা দোষী হলে অবশ্যই উপযুক্ত শাস্তি পাবে। তাতে আমাদের দুঃখ থাকবে না। তবে তাদেরকে ধরার নাম করে পরিবারের অন্য সদস্যদেরকে পুলিশ যেন হয়রানি না করে।
আমিনুলের কয়েকটা বাড়ি পরেই এনামুল হকের বাড়ি। বাড়িতে এনামুল হকের মা ফাইজান বেগম ছাড়া কেউ নেই। চলতি বছরের এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে এনামুল হকের বাবা আব্দুর রাজ্জাক মালয়েশিয়া গেছেন। দুই ভাই-বোনের মধ্যে এনামুল ছোট। এনামুল ছিল শ্রীপুর এলাকার একটি মাদ্রাসা ছাত্র। এই মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করে।
এরপর বাগমারা ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হয়। কিন্তু এক বছর রাজশাহী কলেজে পড়ার পর তার পরিবার তাকে বাগমারায় ভর্তি করায়। কিন্তু সে রাজশাহী থেকেই পড়ালেখা করবে জানালে এনামুলের বাবা পড়ালেখার খরচ চালাতে অপারগতা প্রকাশ করে। পরে এনামুল বাড়ি এসে আর পড়ালেখা করেনি। সে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বিদেশ যাওয়া হয়নি।
এ ব্যাপারে এনামুলের মা ফাইজান বেগম বলেন, পাসপোর্ট করার জন্য সে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরাফেরার পাশাপাশি বাড়ির কাজকর্ম করে। কিন্তু তার আগে তার বাবা মালয়েশিয়া চলে যান। পাসপোর্ট ঠিক করার কথা বলে এনামুলকে গোয়েন্দা পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।
ফাইজান বেগম ছেলে সম্পর্কে আরও বলেন, আমি নিজে মোবাইল তেমন বুঝি না। আমার ছেলে কৃষিকাজ সেরে ঘরের ভেতরে ঢুকে মোবাইলে কি করে তা আমি বলতে পারবো না। তবে শুনেছি, তাদের মোবাইল থেকে কি যেন পুলিশ পেয়েছে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় রাজশাহীর পুলিশ সুপারের (এসপি) কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন এসপি মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে গ্রেফতার ব্যক্তিরা প্রযুক্তির ব্যবহার করতো। এজন্য তারা ফেসবুকের পাশাপাশি ‘থ্রিমা’ নামে একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করতো। গ্রেফতারের পর তাদের দু’জনের স্মার্টফোনেই থ্রিমা সফটওয়্যারটি ইনস্টল পাওয়া যায়। এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে তারা তাদের সংগঠনের অন্য সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতো। তাদের দুইজনের মোবাইলে এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে কথোপকথনের যে প্রমাণ পাওয়া গেছে, তা প্রিন্ট করে ৫৮ পৃষ্ঠা হয়েছে।
এসপি আরও জানিয়েছিলেন, রুমির (আমিনুল) মোবাইল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সম্প্রতি সে এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে তার সংগঠনের অন্য সদস্যকে বলছে- ‘ভাই, ওই ডাক্তার কে কি কোপ দিয়া দিব? আপনি কী খুব বিজি আছেন? আমি এখন ওই মালোয়ান ডাক্তারকে কোপ দিব, প্রবলেম হলো-থানা কাছাকাছি। আমার সঙ্গে কাজ করার জন্য একজন দরকার।’
আরেক বার্তায় সে বলেছে, ‘ওই হিন্দু ডাক্তার বলে, মুসলমান কেন হবো? খ্রিষ্টান হলে বাড়ি দেবে, গাড়ি দেবে। আর যে দিন মুসলমান হবো, তারপর দিন থেকে ভিক্ষা করতে হবে।
গুলশানের হোটেলে কমান্ডো অভিযানে জঙ্গিরা নিহত হওয়ার পর সে বার্তা পাঠিয়েছে, ‘ভাই, বাসায় থেকে আমার খুব আফসোস হচ্ছে। সবাই এরা শহীদ হয়ে যাচ্ছে, আর আমি পিছনে পড়ে গেলাম। আমার জন্য দোয়া করেন। যত হিন্দু ডাক্তার তাদের সবাইকে মারার হুমকি দিসি।
সবুজের (এনামুল) মোবাইল সেট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সেও সাম্প্রতিক সময়ে থ্রিমা সফটওয়্যার ব্যবহার করে বার্তা পাঠিয়েছে। একটি বার্তায় সে লিখেছে, ‘‘ওই যে কাজ করতে চাচ্ছে তার টাকা আমি নিজে দিতে চেয়েছি। যে দুই হাজার টাকা রাখতে বললাম, সেখান থেকে ৫০০ টাকা রুমিকে দেবেন। আমি ভালো আছি... বেশতো আছি। টাকাটা দরকার।’
রাজশাহীর বাগামারা থেকে আটকের পর সন্ত্রাস দমন আইন মামলায় নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার রাজশাহী’র দুই সদস্যর পাঁচ দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানিয়েছে পুলিশ। বুধবার দুপুরে রাজশাহীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলী আদালত-৪ এর বিচারক একরামুল করিমের কাছে এ আবেদন করা হয়। তবে আদালত শুনানির দিন ধার্য করেননি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রাজশাহী জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপ পরিদর্শক (এসআই) রুহুল আমিন জানান, মঙ্গলবার রাতে বাগমারার পৃথক দুইটি স্থান থেকে ‘আনসার রাজশাহী’র দুই সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন, উপজেলার শ্রীপুর খামারপাড়া গ্রামের সাইফুল ইসলাম ওরফে টিপুর ছেলে আমিনুল ইসলাম ওরফে রুমি (২৩) ও আবদুর রাজ্জাকের ছেলে এনামুল হক ওরফে সবুজ (২২)। মঙ্গলবার তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা দায়েরের পর বিকেলে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়। বুধবার তাদের রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়। আগামী রবিবার অথবা সোমবার রিমান্ড আবেদনের শুনানি হতে পারে বলে জানান তিনি। -বাংলা ট্রিবিউন
১৮ আগস্ট, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম