আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ: কখনো মাটি কেটেছেন, রিকশা চালিয়েছেন। কখনো বা পত্রিকা অফিসে কাজ করেছেন। তবু থমকে যায়নি রাজশাহী কলেজের ছাত্র শরিয়তুল্যাহর উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন। সব বাধা পেরিয়ে এখন স্নাতকোত্তর পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। আজ মহান মে দিবস উপলক্ষে পাঠকদের জন্য থাকল এক শ্রমিকের সাফল্যের গল্প
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীরই যখন সকাল হয় না, রাজশাহী কলেজের ছাত্র শরিয়তুল্যাহ তখন তাঁর বাইসাইকেলের প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে ক্লান্ত হন। কি শীত, কি গ্রীষ্ম শরিয়তের ছুটি নেই। প্রতিদিন সকালে এজেন্টদের কাছ থেকে অবিক্রীত পত্রিকার কপি সংগ্রহ করে একটি পত্রিকা অফিসে জমা দিতে হয়। দিলেই ছুটি হয় না। ছুটতে হয় আবার ক্লাসে। এভাবেই শরিয়ত এবার স্নাতকোত্তর পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
শরিয়তুল্যাহ রাজশাহী কলেজের দর্শন বিভাগের একজন নিয়মিত ছাত্র। বাড়ি নওগাঁর মান্দা উপজেলায়। মান্দা উপজেলার উত্তরা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর শরিয়তের স্বপ্ন ছিল উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার। কিন্তু পরিবারের সেই সংগতি ছিল না। এ জন্য ভর্তি পরীক্ষার আগে এক মাস রাজশাহীতে এসে ভ্যান চালান। এলাকার এক যুবকের সঙ্গে সকালে এসে সারা দিন ভ্যান চালিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেন।
বেশি টাকা লাগবে এই শঙ্কায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরমই তাঁর তোলা হয়নি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম পূরণ করে ঢাকায় গিয়েছিলেন মাটি কাটার কাজে। সেখান থেকে এক বন্ধুর মাধ্যমে খবর পান, তিনি ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু যে মালিকের মাটি কাটার কাজ নিয়েছেন, তিনি কাজ শেষ না করে আর আসতে দেবেন না। টাকাও দেবেন না। একদিন দেরি হয়ে গেল। অবশেষে সঙ্গের শ্রমিকেরা তাঁকে টাকা দিয়ে রাজশাহী পাঠালেন। রাজশাহী এসে দেখলেন, ভর্তির সময় পার হয়ে গেছে। পরদিন তাঁর এক বন্ধু খবর দেন, চাইলে দর্শনে ভর্তি হওয়া যাবে। শরিয়তুল্লাহ দর্শন বিভাগে ভর্তি হলেন, কিন্তু রাজশাহী শহরে থাকার মতো টাকা তাঁর হাতে ছিল না। তবু পণ করলেন, উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন তাঁকে সফল করতেই হবে। কয়েক দিন টিউশনি খোঁজার চেষ্টা করলেন, কিন্তু এলাকায় নতুন বলে কেউ টিউশনি দিতে চান না। সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রয়োজনে রিকশা চালাবেন। তা-ই করতে লাগলেন। প্যান্ট পরে একটি রিকশা গ্যারেজে যান। সেখানে গিয়ে লুঙ্গি পরে রিকশায় ওঠেন। ফেরার সময় আবার প্যান্ট পরে মেসে ফেরেন। কিন্তু এভাবে আর কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। সকালে ক্লাস আর বিকেলে রিকশা চালানোর ক্লান্তি নিয়ে রাতে যখন মেসে ফেরেন, তখন আর পড়ার টেবিলে বসতে পারেন না। হতাশ হয়ে মাস ছয়েক পরে তাই ভর্তি বাতিল করতে গিয়েছিলেন।
নিয়মিত ক্লাস করা একটি ছেলে ভর্তি বাতিল করছেন দেখে বিভাগের একজন শিক্ষক কাছে ডেকে সমস্যার কথা শুনতে চাইলেন। সব শুনে তিনি টিউশনির ব্যবস্থা করে দিলেন। কিন্তু শুধু টিউশনি দিয়ে শেষের দিকে আর চলতে পারছিলেন না।
বাধ্য হয়ে গত বছর একটি পত্রিকা অফিসে যোগাযোগ করে তাদের অবিক্রীত পত্রিকা সংগ্রহের কাজ নেন। এখন টিউশনি ও পত্রিকা অফিসের আয় দিয়ে তিনি পড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। কষ্টের টাকায় ছোট বোনের পড়াশোনার জন্য সহযোগিতা করেছেন। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ার পরে বোনের বিয়ে দিয়েছেন।
আগামী ১৭ মে শরিয়তের মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা। এই হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে শরিয়ত বলেন, ‘আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে নিজে আয় করে পড়ছি। কারও দয়া বা দানের চেয়ে নিজে কাজ করাটা আমি সম্মানের এবং পবিত্র বলে মনে করি। অনেক বড় মনীষীদের জীবনী পড়ে দেখেছি, তাঁরা কোনো কাজকে ছোট মনে করেননি।-প্রথম আলো
১ মে,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সুবজ/এসএ