বৃহস্পতিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ০৫:১৬:২৪

দেড় কিলোমিটার হেঁটে টিভিতে মেয়েদের খেলা দেখেন আনুচিং-আনাইয়ের বাবা-মা

দেড় কিলোমিটার হেঁটে টিভিতে মেয়েদের খেলা দেখেন আনুচিং-আনাইয়ের বাবা-মা

স্পোর্টস ডেস্ক: খাগড়াছড়ি শহর থেকে দুই কিলোমিটার রাস্তা। তারপর সাতভাইয়া পাড়া। এই পাড়াতে বেড়ে উঠেছে এএফসি অনুর্ধ্ব ১৬ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে চার ম্যাচে পাঁচ গোল করা আনুচিং মগিনী। আনুচিং মগিনী আর আনাই মগিনী জমজ হয়ে জন্ম নিয়েছে। এখন তাদের বয়স তের। এই ১৩ বছরে এ জমজসহ কৃষ্ণা, মার্জিয়ারা ইতোমধ্যে রীতিমত ফুটবলের পায়ের জাদুতে রীতিমত বিশ্বজয় করে ফেলেছেন।

গেল মঙ্গলবার আনুচিং আর আনাই এর বাবা মার সাথে কথা হল দেশের প্রথম সারির একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের। নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো পার হয়ে যেতে হয় তাদের বাড়ি। সাত ভাইয়া পাড়া খাগড়াছড়ি সদরে পড়লেও বেশ দূর্গম এলাকা। বাড়িগুলো বেশির ভাগ বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি। আনুচিংদের বাড়ির উঠোনে লাগানো আছে এক জোড়া নারিকেল গাছে। সেই নারিকেল গাছ দুটোও আনুচিংদের মতই জমজ। যেন জমজে জমজে প্রকৃতির সাথে মানুষের নিবিড় মেলবন্ধন হচ্ছে। বিশেষ করে আনুচিং জমজের সাথে।

এবার গল্প শুরু করলেন আনুচিং এর বাবা রিপ্রু মগ। তিনি বললেন, আনুচিং আর আনাই জমজ আমাদের কনিষ্ঠ সন্তান। ওরাসহ আমার চার ছেলে চার মেয়ে আছে। কিন্তু আমার ছেলেরা ওদের মত আমাকে এত সম্মান এনে দিতে পারেনি।

কথার প্রসঙ্গে কি করেন এমন প্রশ্ন করতেই মুখটা একটু গম্ভীর হল, ‘দুই তিন বছর হল বনজ ঔষুধ বিক্রি করে কোন রকম সংসার চালাচ্ছি।  আমাদের জমিজমা যা আছে সেটি এ একটি বাড়ি। বনজ ঔষুধ বিক্রি করার আগে দিনমজুরী করে সংসার চালাতাম। ’

গল্পের ফাঁকে উপস্থিত হলেন আনুচিং এর মা আপ্রুমা মগিনী। তাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনাদের বাসায় টিভি আছে? উত্তরে বললেন নেই। তবে কীভাবে মেয়েদের খেলা দেখেন এমন প্রশ্ন করলে দুজনে বলে উঠলেন, এখান থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার রাস্তায় হেঁটে মধুপুর বাজারে গিয়ে টিভি দেখি। নিজের বাসায় এখনও বিদ্যুতের মিটার বক্স স্থাপন করতে পারেনি।

মেয়েদের ফুটবলার হবার পেছনের গল্প শুনতে চাইলে হাসিমুখে দুজনে বলতে লাগলেন, ওরা পাঁচ, ছয় বছর থেকে বাড়ির উঠোনে মামাত ভাই চাইহ্লা মগের সাথে ফুটবল খেলত। এছাড়াও পাড়ায় ছেলেদের সাথে মিলেমিশেও ফুটবল, ক্রিকেট সব খেলাই খেলত। আমরা কখনও এ কাজে বাঁধা দেয়নি। সবসময় উৎসাহ দিয়েছি। আমরা দুজনেই নিরক্ষর হলেও ওরা যেন আমাদের মত না হয় সেজন্য ওদেরকে সব কাজে স্বাধীনতা দিয়েছি। ওরা যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছিল তখন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ড কাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় টুর্নামেন্টের মাধ্যমে প্রথমবারের মত জাতীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ করে। রাঙামাটি মঘাছড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হয়ে অংশ নিয়ে সেবারের প্রথম রানার্সআপ হয়েছিল। এর আগে ওরা সাতভাইয়া পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছিল।

মেয়েদের লেখাপড়ার অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে আপ্রুমা মগ বলেন, হাই স্কুলের জীবন এপিবিএন উচ্চ বিদ্যালয়ে হলেও সেখানে পড়াশুনা চালাতে ব্যয় বেশী হওয়ায় ঘাগড়া বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। ওরা মানবিক শাখা নিয়ে সেখানে নবম শ্রেণিতে পড়ছে। ওদের জেএসসি রেজাল্ট ও ভালো। দুজনে জিপিএ চার এর উপরে পেয়েছে।

কখনো স্টেডিয়ামে গিয়ে মেয়েদের খেলা দেখেছেন কিনা জানতে চাইলে রিপ্রু মগ বলেন, ‘একবার বঙ্গমাতা টুর্নামেন্টের সময় গিয়েছি ট্রেনে করে। এরপর আর যেতে পারেনি। কারণ ঢাকায় গিয়ে ওদের খেলা দেখার মত সামর্থ্য নেই। তারপর ওদের খেলা যখন শুরু হয় তখন ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি ওরা যেন ভালো খেলে জিততে পারে।’ এসময় রিপ্রু মগের চোখ ছলছল করছিল।

আনাইদের মা আপ্রুমা নিজের মেয়েদের সাফল্যের স্মারক দেখাতে লাগলেন। খেলার মধ্যে তাদের সাফল্য বেশ ঈর্ষণীয়। কারণ এই ১৩ বছরের মধ্যে ওদের সাফল্যের পালকে জুটেছে ১২ জোড়া বিভিন্ন সংগঠন থেকে পাওয়া সার্টিফিকেট! এছাড়াও গেল মে মাসে কাজাকিস্তানে গিয়ে জিতে আসা মেয়েদের সেই বিজয়ের পেপার কাটিং ছবিটিও দেখালেন।

আনুচিং আনাইয়ের বাবা একটু আক্ষেপ করে বলেন, আমার দুই মেয়ে আনসার ব্যাটেলিয়ন থেকে মাসে ৬৫০০ টাকা করে বৃত্তি পেত। এখন আনাই এ বৃত্তি পেলেও আনুচিং এর টা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেছে। এর কারণটাও এখনও অজানা। ও যদি এ বৃত্তি পেত তাহলে ওর পড়ালেখার খরচটা নিজেই চালাতে পারত।

আনুচিং এর সাথে ফোনে কথা হলে এ অদম্য বলেন বলেন, আমি আমার পার্ফরম্যান্স নিয়ে খুব খুশি। বড় হলে দেশের হয়ে নারী বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করতে চাই।

আনুচিং এর মামাত ভাই থোয়াই অং মগ বলেন, ‘আনুচিং আর আনাই দেশের সম্পদ। ওরা ওদের খেলার মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে যাবে। তবে এক্ষেত্রে সকলেই তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। না হলে ওরাও একসময় ঝরে পড়ে যাবে। দেশটা হারাবে অমূল্য মুক্তা।’
আর যাই হোক, দেশের এই অমূল্য সম্পদকে হারিয়ে ফেলা চলবে না!-প্রিয়.কম
৮ সেপ্টেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে