শুক্রবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৭, ০৯:৩১:৩৯

“আবেগী প্রেম”

“আবেগী প্রেম”

মারিয়া সুলতানা: বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। রীতা আর মিতা সিদ্ধান্ত নিলো বড় খালার বাড়িতে বেড়াতে যাব । আজই তারা বড় খালার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করবে।

তারাই প্রস্তুতি চলছে। ড্রাইভারের সব মালামাল উঠানোর পেরেশানি। সব কিছু ওকে । সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে মিতা আর পিছনের সিটে পাশাপাশি রীতা আর তার বাবা-মা ।

বিলে ঝিলে সাদা বক ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে , গরুর পাল নিয়ে রাখালের ছুটে বেড়ায় তেপান্তরে , মাঠে-ঘাটে কৃষাণেরা দলবেঁধে ভাটিয়ালি গান গায় , গভীর রজনীতে বাঁশি-ওয়ালার মিষ্টি বাঁশির সুর মন কেড়ে নেয় ।

ছোট-ছোট ছেলে-মেয়েরা নদীর জলে লাফিয়ে লাফিয়ে গোসল করে এবং বিভিন্ন গাছের কাঁচা-পাকা কূল খেয়ে মনের আনন্দে গাছের ছায়ায় দল বেঁধে খেলা করে। সেই গ্রামেই যাচ্ছে সে । তাই মিতার মন আনন্দে চঞ্চল হয়ে ওঠে।

মিতা সামনের দিকে ঝুঁকে সামনে ও পাশের গ্লাস দিয়ে চারদিকের পরিবেশ মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে । দেখতে দেখতে তারা খালার বাড়িতে এসে উপস্থিত ।

সন্ধ্যায় পরিবেশ যেন অন্যরকম আমেজ সজ্জিত। গোধুলিময় শান্ত। মানুষ সব গৃহে ফিরছে। পাখিরা সব ডানা ঝাঁপটিয়ে নীড়ে ফিরছে। মিতা , খালাতো বোন শিরীন , কেয়া , রীতা ও খালাম্মা রাস্তা ধরে হাঁটছিলেন।

হঠাৎ করেই কেয়া থমকে দাঁড়াল। সবাই হেঁটে বাড়ির দিকে চলল। কিন্তু মিতা ও রীতা কেয়া সঙ্গে দাঁড়ালো। তাদের দৃষ্টিতে দৃষ্টি দিয়ে দেখলাম অদূরেই বাঁশ ঝাড়ের নিচে একটি কবর । পাশেই পাঁচ বছরের ছোট্ট একটি মেয়ে।

অঝোর ধারায় কাঁদছে । কারণটা কী ? আপুদের চোখেও অশ্রু । মিতা বাচ্চা মেয়েটির দিকে এগুতেই রীতা মিতার হাত ধরল । ইশারায় যেতে নিষেধ করল ।

-- ধ্যাৎ ! কিছুতেই বুঝতে পারছি না । কেয়াকে জড়িয়ে ধরে মিতা বললো  আপু প্লিজ ! বলনা ঘটনাটা কী ?

রাতে , মিতা বিছানায় শুয়ে কিছুতেই চোখ এক করতে পারছে না । নিঃশ্বাস ছেড়ে বলা শুরু করল কেয়া ,-- ঐ যে কবর ! তার ভিতরে যে শুয়ে আছে সে হল শহরের এক মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে নায়েলা । পড়ত ওখানকার কলেজে অনার্সে ।

তো আমাদের দূর-- সম্পর্কের চাচাতো ভাই সিয়াম ঐ শহরেই একটি কোম্পানিতে চাকরি করত । কিভাবে কিভাবে যেন পরিচয় । পরিচয়ে বন্ধুত্ব । বন্ধুত্ব থেকে প্রেম ।

আর এই প্রেমের বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায় নায়েলার পরিবারে । নায়েলার দুই ভাই বড় । সবার ছোট নায়েলা । বলতে গেলে বাবা- মা, ভাইদের স্বপ্ন নায়েলাকে ঘিরেই । তারা পর্যাপ্ত শাসনে রাখতে শুরু করল । কিন্তু তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রেমের টানে ছুটে এল সিয়ামের কাছে । বেশ সঙ্গে সঙ্গে কোর্ট ম্যারেজ করল ।

শুরু হল দাম্পত্য জীবন । প্রায় বছর খানেক সময়ের মধ্যে জানাজানি হয়ে গেল সিয়ামের ফ্যামিলিতে । আর ওদিকেও নায়েলার পরিবার প্রধান বাবা নায়েলাকে ডেকে নিয়ে দু'লাখ টাকার চেক ধরিয়ে দিয়ে বলল - " তোমাকে তো নিঃস্ব হিসেবে বিদায় দিতে চাইনি তাই এই নাও ব্যাংকে রাখা তোমার টাকাটা ।

তবে হ্যাঁ আর কোনদিন যেন তোমার ঐ মুখ না দেখতে হয় "। অনেক কান্নাকাটি করেও লাভ হয়নি । সিয়াম নায়েলাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে আসে । সিয়ামের মা বৌমার প্রতি রেগে থাকলেও প্রথমে ধরা দেয়নি । তবে পুরো এলাকা জুড়ে একটাই কথা তা হল দেখার মত বৌ এনেছে ।

মানে নায়েলা যথেষ্ট সুন্দরী ছিল । বেশ কয়েক মাস কাটতেই নায়েলার জীবনে " কালির সন্ধ্যা " শুরু । সিয়াম চাকরিতে বদলি হয়ে ঢাকায় আসে । আর নায়েলা এই গ্রামেই ।

সম্পূর্ণ অচেনা অজানা এক গ্রামে । তাও আবার সবার মুখে এক কথা সিয়ামের মা খাড়া দাজ্জাল । রুঢ়ভাষীনি এই মহিলার আশে পাশে কেউ সহজে দাঁড়ায়না । যার প্রমাণও নায়েলা পেয়েছে সেদিন । কেয়া সঙ্গে কথা বলতে দেখে বলল -- কেয়া কখনো বৌ - এর কাছে আসবে না । আমার বৌকে তাল দিতে আস ?

তারপর বহুদিন কেটে গেছে কিন্তু নায়েলার জীবন সুখ বলে কিছু ছিলো না । শাশুড়ির রুসী আচরণ দিন দিন নায়েলাকে মানসিক শাস্তিতে ফেলে । কিন্তু নিশ্চিত বিধায় কখনো খারাপ ভাষায় প্রতিবাদ করনি ।

শহরে বেড়ে উঠা মেয়ে কী করে গ্রামে এসেই সব কাজ আয়ত্ব করতে শিখবে । কিন্তু সিয়ামের মার এক কথা -"কাজ পারে না তো বিয়ের শখ জাগল কেন? "

বহু নির্যাতনের মাঝেও নায়েলা সকাল হলে চা নাস্তার ব্যবস্থা , গরুর ঘর পরিষ্কার , ধোয়া - মোছা , রান্নাবান্না থেকে শুরু করে গৃহের সকল কাজেই করে । কিন্তু দুর্ভাগ্য শাশুড়ি তাতেও জয় হয়না ।

ওদিকে সিয়াম চাকরি হারায় । সম্বল বলতে নায়েলার টাকাটাই ব্যাংকে ছিল । শুরু করল তা দিয়ে ব্যবসা । ব্যবসাও মন্দভাব দেখে বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছা করল। ব্যবস্থাও হয়ে গেল । কিন্তু এত ঝামেলার মাঝে কখনো নায়েলাকে জিজ্ঞাসা করেনি তুমি কতটা সুখী !

নায়েলা যখন পাঁচ মাসের গর্ভবতী তখন সিয়াম ইতালী চলে যায় । তো নায়েলা সেদিন প্রসব ব্যথা তুমূল পর্যায়ে তখনো কোন দাই শাশুড়ি ডাকেনি (আর ডাক্তার তো দূরে) । আরও উল্টো বলল,- " আজ যদি তোর মরণটা হত। তাইলে সিয়াম আমি বেঁচে যেতাম। বহুত কষ্টে জন্ম দেয় চাঁদের মতই সুন্দর এক কন্যা সন্তান । শাশুড়ি বেজায় নাখোশ হল মেয়ে হওয়ার জন্য ।

একদিন সকালেই শাশুড়ি কী কথার প্রেক্ষিতে যেন নায়েলার তলপটে বরাবর লাথি মারে । কষ্টে ছুটে আসে কেয়াদের বাড়ি । শুধুই একটা দাবি নিয়ে তা হল নায়েলা একেবারে শূন্যহাত । কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করতে । কারণ ও বাবার বাড়ি চলে যাবে । কাজ কর্ম করতে করতে নিজেই শেষ হয়ে যাচ্ছে । অথচ চোখ তুলে তাকাবার কেউ নেই ।

পরেরদিন ভোরবেলায় নায়েলা আর দরজা খোলেনি । দরজা ভেঙ্গে প্রবেশ করতেই দেখা গেল মৃত্যু!! এর জন্য কি দায় ওই প্রথম বয়সের আবেগী প্রেম নয় ? আর এভাবে কত নায়েলা এই ফাঁদে আটকা পড়ে আজীবন বন্দি থাকবে । অবশেষে মৃত্যুর পথযাত্রী হবে?
লেখাঃ Mariya Sultana.(মেঘলা আকাশ)
এমটিনিউজ২৪ডটকম/জয়নাল

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে