এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির, বাগেরহাট থেকে: রাস পূর্ণিমা উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এবারও সুন্দরবনের দুবলারচরে সুন্দরবনের দুবলার চরের আলোরকোলে শনিবার (১২ নভেম্বর) থেকে শুরু হচ্ছে।
ঐতিহ্যবাহী রাস পূর্ণিমা পুণ্যস্নান অনুষ্ঠিত হবে। এ উপলক্ষে ৩ দিনের রাসমেলা শুরু হবে আগামী শনিবার ১২ নভেম্বর তিন দিনব্যাপী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রাস উৎসব। ১৪ নভেম্বর সকালে পূণ্যস্নানের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এ উৎসব।। বেসরকারি একাধিক পর্যটন কোম্পানি সূত্রে জানা যায়, রাস উৎসবে যোগ দিতে এরই মধ্যে অনেক পর্যটক লঞ্চ ও স্পিডবোট বুকিং নিতে প্রস্তুতি শুরু করেছেন।
এদিকে, রাস উৎসবকে কেন্দ্র করে সুন্দরবনে নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা। সুন্দরবনে আসা সনাতন ধর্মাবলম্বী ও পর্যটকদের নিরাপত্তায় বনবিভাগের পাশাপাশি পুলিশ, কোস্টগার্ড ও র্যাবের টহল জোরদার করা হয়েছে।
এছাড়া হরিণসহ যেকোন বন্যপ্রাণী শিকার রোধেও থাকছে বাড়তি কড়াকাড়ি। রাস উৎসব চলাকালীন এ বছর সুন্দরবনে অভ্যন্তরে মাছ ধরাসহ সব পাশ বন্ধ থাকবে।
সর্ববৃহৎ প্রাচীন রাসমেলা সুন্দরবনের সাগদুহিতা দুবলারচরে। কথিতমতে ১৯২৩ সালে গোপালগঞ্জে ওড়াকান্দির হরিচাঁদ ঠাকুরের অনুসারী হরিভজন নামে এক সাধু সুন্দরবনের দুবলাচরে রাস পূর্ণিমায় পূজা- পাবর্নাদি অনুষ্ঠান শুরু করেন। এরপর থেকে প্রতিবছর শুরু হয় রাসমেলা।
শত বছরের এ ঐতিহ্যবাহী রাসমেলা সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বন বিভাগ, আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী, আয়োজক কমিটি সহ বিভিন্ন সংস্থা ইতমধ্যো নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
রাসমেলা আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দর্শনার্থী ও তীর্থযাত্রীদের পুণ্যস্নানে নিরাপদে যাতায়াতের জন্য ১০টি পথ নির্ধারণ করেছে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ। ওই পথগুলোতে তীর্থযাত্রী ও দর্শনার্থীদের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে বন বিভাগ, পুলিশ, বিজিবি ও কোস্টগার্ড বাহিনীর টহল দল।
অনুমোদিত ৮টি পথ হলো- বুড়িগোয়ালিনী, কোবাদক থেকে বাটুলানদী-বলনদী-পাটকোষ্টা হয়ে হংসরাজ নদী হয়ে দুবলার চর; কদমতলা হতে ইছামতি নদী, দোবেকী হয়ে আড়পাঙ্গাসিয়া-কাগাদোবেকী হয়ে দুবলার চর; কৈখালী স্টেশন হয়ে মাদার গাং, খোপড়াখালী ভাড়ানী, দোবেকী হয়ে আড়পাঙ্গাসিয়া-কাগাদোবেকী হয়ে দুবলার চর; কয়রা, কাশিয়াবাদ, খাসিটানা, বজবজা হয়ে আড়ুয়া শিবসা-শিবসা নদী-মরজাত হয়ে দুবলার চর; নলিয়ান স্টেশন হয়ে শিবসা-মরজাত নদী হয়ে দুবলার চর; ঢাংমারী/চাঁদপাই স্টেশন হয়ে পশুর নদী দিয়ে দুবলারচর; বগী-বলেশ্বর-সুপতি স্টেশন-কচিখালী-শেলার চর হয়ে দুবলার চর এবং শরণখোলা স্টেশন-সুপতি স্টেশন-কচিখালী-শেলার চর হয়ে দুবলার চর।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মুহাম্মদ সাঈদ আলী স্বাক্ষরিত পত্রে বলা হয়েছে, ১২ নভেম্বর থেকে ১৪ নভেম্বর মেলা চলাকালে দুবলার চলে প্রবেশে দর্শনার্থী ও তীর্থযাত্রীদের কোনো এন্ট্রি ফি দিতে হবে না। দিনের বেলায় নির্ধারিত রুটের যেকোনো পথ ব্যবহারের সুযোগ পাবেন তারা। বনবিভাগের চেকপয়েন্ট ছাড়া অন্য কোথাও নৌকা, লঞ্চ বা ট্রলার থামানো যাবে না।
এতে আরও বলা হয়েছে, প্রতিটি ট্রলারে রং দিয়ে বিএলসি/সিরিয়াল নম্বর লিখতে হবে। পূণ্যার্থীদের সুন্দরবনে প্রবেশের সময় জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা ইউপি চেয়ারম্যানের নিকট থেকে প্রাপ্ত সনদপত্র সঙ্গে রাখতে হবে। পরিবেশ দূষণ করে এমন বস্তু, মাইক বাজানো, বাজি ফোটানো, বিস্ফোরক দ্রব্য, দেশীয় যেকোনো অস্ত্র এবং আগ্নেয়াস্ত্র বহন থেকে যাত্রীদের বিরত থাকতে হবে।
পূণ্যার্থীদের সুন্দরবনে প্রবেশের সময় জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা ইউপি চেয়ারম্যানের নিকট হতে প্রাপ্ত সনদপত্র সাথে রাখতে হবে। পরিবেশ দূষণ করে এমন বস্তু, মাইক বাজানো, পটকা ফোটানো, বিস্ফোরক দ্রব্য, দেশীয় যে কোনো অস্ত্র এবং আগ্নেয়াস্ত্র বহন থেকে যাত্রীদের বিরত থাকতে হবে।
রাসমেলায় পূর্ণিমা তিথিতে চরে নির্মিত মন্দিরে রাধাকৃষ্ণ, কমল কামিনি ও বনবিবির পূজা অনুষ্ঠিত হবে। পুর্ণিমার পূন্যতিথিতে সকালে সাগর ঢেউয়ে পূস্নান্নের জন্য লক্ষাধিক নারী পুুরুষবিভিন্ন ধরনের প্রসাদ নিয়ে মানত ও মনোবাসনা পূন্যের জন্য চরে সারীবদ্ধ হয়ে বসবে। সাগর ঢেউয়ে স্নান শেষে পূন্যাথিরা বাড়ী ফেরা শুরু করে। অটুট বিশ্বাস আর পূন্যভক্তিতে কমল কামিনীর দর্শন মেলে। পূন্যাথিরা কমল কামিনী দর্শনের আশায় নিলকোমলের সাগর মোহনায় সাগর ঢেউঢেয় স্নান করে। রাস পূর্ণিমায় প্রথম আসা সমুদ্র ঢেউকে নিলকোমলের ঢেউ বলা হয়। এই প্রথম ঢেউয়ে পূন্যাথিরা প্রসাদ উৎসর্গ করে পূন্যস্নান করে। এ বছর ১৩৩ তম রাসউৎসব অনুষ্ঠিত হবে। মেলায় প্রায় ১০/১৫ লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটে। এসব রুটগুলোতে আগামী ১০ নভেম্বর থেকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহনের পাশাপাশি র্যাব, কোষ্টগার্ড, পুলিশ, বনকর্মীরা ও নৌবাহিনীর টহল শুরু হবে। এছাড়াও দর্শনার্থীদের নামে বনে প্রবেশ করে কেউ হরিণ শিকার করতে না পারে সে ব্যাপারেও প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুন্দবনের কয়েকজন ব্যবসায়ীর সাথে আলাপ করে জানা যায় মেলার সময় দর্শনার্থীদের আগ্নেঅস্ত্র বহন নিষিদ্ধ থাকলেও চোরা শিকারীরা ফাঁদ, বশিসহ নানা কৌশলে হরিণ শিকারে মেতে ওঠে। তীর্থ যাত্রীরা গত বারের ন্যায় এবারও জ্বালানী কাঠের অনুমতি পাচ্ছে না। সুন্দরবন বাগেরহাট পূর্ব বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোঃ সাইদুল ইসলাম বলেন গত বারের মতো এবারও তীর্থ যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য আমাদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১৬টি মোবাইল টিমের টহল জোরদার থাকবে। এছাড়া দুবলায় আলাদা ৩টি টিমের টহল থাকবে। তাছাড়া টুরিষ্ট বিভাগের লঞ্চগুলোতে সর্বচ্ছ ৭৫ জনের বেশী যাত্রী থাকলে বনে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না এবং তীর্থ যাত্রীদের প্রত্যেকের আইডি কার্ড সঙ্গে থাকতে হবে। রাসমেলায় কোনভাবেই যেন হরিণ শিকার ও বনজ সম্পদের ক্ষতি না হয় সে জন্য প্রয়োজনীয় সব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
১১ অক্টোবর ২০১৬/এমটিনিউজ/এইচএস/কেএস