বরগুনা : বরগুনায় আলোচিত রিফাত শরীফ হ'ত্যা মামলার চার্জশিট (পুলিশের অভিযোগপত্র) দাখিলের ১৮ দিন পর বৃহস্পতিবার (চার্জশিট) তার কপি বাইরে প্রকাশিত হয়েছে। গেল ২৬ জুন হ'ত্যাকা'ণ্ডের ৬৬দিন পর এক সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও বরগুনা থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. হুমায়ূন কবির।
তবে আদালতে চার্জশিট দাখিল করলেও মামলার আসামিপক্ষ অথবা মিডিয়াকর্মীরা চার্জশিটের কপি এতদিনে হাতে পায়নি। ১৮ সেপ্টেম্বর (বুধবার) চার্জশিট আদালত গ্রহণ করার পর বৃহস্পতিবার কপি বাইরে প্রকাশ হয়েছে। আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির আইনজীবী মাহাবুবুল বারী আসলামের কাছ থেকে চার্জশিটের কপি পাওয়া গেছে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, নি'হত রিফাত শরীফ বরগুনা থানা এলাকায় ডিস লাইনের ব্যবসা করতেন। রিফাত শরীফ ও মামলার এক নম্বর আসামি (বন্দু'কযু'দ্ধে নি'হত) নয়ন বন্ড অনেক আগে বরগুনা জিলা স্কুলে একসঙ্গে লেখাপড়া করেছে। সে সুবাদে তাদের উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। রিফাত শরীফের সঙ্গে আনুমানিক দুই বছর আগে থেকে আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সে সময় সরল বিশ্বাসে রিফাত শরীফ তার বন্ধু নয়ন বন্ডের সঙ্গে (তৎকালীন প্রেমিকা) মিন্নির পরিচয় করিয়ে দেয়। এদিকে মিন্নির সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালীন সময়েও রিফাতের অন্য মেয়েদের সঙ্গেও প্রেমের সম্পর্ক ছিল যা মিন্নি জানতে পারে। ২০১৮ সালের রমজান মাসে রিফাত শরীফ মোটরসাইকেল দু'র্ঘটনায় আ'হত হয়ে দেড়মাস চিকিৎসাধীন ছিল। এসব কারণে রিফাত শরীফের সঙ্গে মিন্নির সম্পর্কের কিছুটা দূরত্ব হয়। এ সুযোগে আসামি নয়ন বন্ড মিন্নির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে প্রেম নিবেদন করে এবং মিন্নিও তার প্রেম নিবেদনে সাড়া দিয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে। একপর্যায়ে মিন্নি রিফাত শরীফ ও নয়ন বন্ড দুজনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক বজায় রাখে।
একপর্যায়ে ২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর মিন্নি ও নয়ন বন্ড বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ওই বিবাহে নয়ন বন্ডের পক্ষে সাক্ষী ছিলেন মামলার দুই নম্বর আসামি রাকিবুল হাসান রিফাত ফরাজী এবং মিন্নির পক্ষে সাক্ষী হিসেবে ছিলেন নয়ন বন্ডের প্রতিবেশী ও বন্ধু সাইফুল ইসলাম মুন্না ও তার স্ত্রী মোসা. জান্নাতুল ফেরদৌস। বিয়ের পর মিন্নি ও নয়ন বন্ড স্বামী-স্ত্রী হিসেবে প্রকাশ্যে এবং গোপনে সম্পর্ক বজায় রাখে। কিন্তু নয়ন বন্ডের সঙ্গে বিবাহের পর মিন্নি ধীরে ধীরে জানতে পারে নয়ন বন্ড মা'দকসেবনসহ বিভিন্ন অ'পরাধে জড়িত এবং থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। এ কারণে নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির সম্পর্কের কিছুটা অবনতি হতে থাকে এবং রিফাত শরীফের সঙ্গে পুনরায় সম্পর্ক শুরু হয়। পরে মিন্নি ও তার পরিবার নয়ন বন্ডের সঙ্গে বিবাহ গোপন রেখে কোনও বিচ্ছেদ ছাড়াই গেল ২৬ এপ্রিল রিফাত শরীফের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়।
কিন্তু রিফাত শরীফের সঙ্গে বিবাহের পরে কলেজে যাওয়া আসার নানান অজুহাতে মিন্নি নয়ন বন্ডের সঙ্গে দৈহিক মেলামেশাসহ সকল প্রকার যোগাযোগ রক্ষা করে আসছিল। বিষয়টি রিফাত শরীফ জানতে পেরে মিন্নিকে নয়ন বন্ডের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে নিষেধ করে। এ ঘটনায় মিন্নি এবং রিফাত শরীফের সঙ্গে পারিবারিক কলহসহ বিভিন্ন সময় ঝ'গড়াঝা'টি হয়। একপর্যায়ে মিন্নি রিফাতের কাছে ডিভোর্স চায় এবং পূর্বের স্বামী নয়ন বন্ডের কাছে ফিরে যেতে চায়।
এদিকে রিফাত শরীফের সঙ্গে মিন্নির বিবাহের পূর্বে এ বছরের মার্চ মাসে নয়ন বন্ড স্থানীয় ইউটিডিসি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে জন্মদিন পালন করে।ওই অনুষ্ঠানে প্রধান মেহমান ছিল আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি। অনুষ্ঠানটি নয়ন বন্ডের বন্ধু হেলাল শিকদার তার মোবাইলে ভিডিও করে এবং তার ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করে। পরে রিফাত শরীফ ওই ভিডিওটি দেখতে পায়।এরপর গেল ২৪ জুন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হেলাল শিকদারকে ডেকে তার ব্যবহৃত মোবাইল সেট রিফাত শরীফ নিয়ে যায়। বিষয়টি হেলাল শিকদার নয়ন বন্ডকে জানালে নয়ন বন্ড আসামি রিফাত ফরাজীকে জানায়।
পরবর্তীতে রিফাত ফরাজী মোবাইল ফোনে রিফাত শরীফকে হেলালের মোবাইল ফেরত দেওয়ার কথা বললে-রিফাত শরীফ আসামি রিফাত ফরাজীকে মা-বাবা তুলে গালি-গালাজ করে। পরে রিফাত ফরাজী মিন্নিকে ফোন করে রিফাত শরীফের কাছ থেকে মোবাইলটি উদ্ধার করে ফেরত দিতে বলে। যে অনুযায়ী হেলালের মোবাইল নেওয়ার কারণে রিফাত শরীফকে মিন্নি গা'লাগা'ল করে। এ কারণে রিফাত শরীফ ক্ষুব্ধ হয়ে মিন্নিকে চ'ড়, থাপ্প'ড়সহ তলপেটে লা'থি মারে। রিফাত শরীফ মিন্নিকে নয়ন বন্ডের সঙ্গে প্রেমে বাঁধা দেওয়াসহ নিজের ইচ্ছেমতো চলাচলে বাধা দেওয়া, কলেজে গিয়ে মিন্নির ওপর নজরদারি করা এবং সর্বশেষ হেলালের মোবাইল ফোন উদ্ধারকে কেন্দ্র করে মিন্নিকে মা'রধ'র করার কারণে রিফাত শরীফের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে রিফাতকে খু'ন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বলে আসামি নয়ন বন্ডকে মিন্নি কা'ন্নাকা'টি করে মোবাইল ফোনে জানিয়েছে।
সে অনুযায়ী রিফাতকে হ'ত্যার একদিন আগে ২৫ জুন মিন্নি কলেজে যাওয়ার কথা বলে নয়ন বন্ডের বাসায় যায় এবং দীর্ঘ সময় ধরে রিফাত শরীফকে হ'ত্যার পরিকল্পনা করে। নয়ন বন্ড মিন্নির কাছ থেকে রিফাত শরীফকে হ'ত্যার প্রস্তাব পেয়ে পথের কাটা দূর করতে রিফাত শরীফকে হ'ত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে এবং হ'ত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে ‘বন্ড ০০৭’ গ্রুপের সদস্য এবং তার অনুসারী আসামি রিফাত ফরাজী, রিশান ফরাজী, রায়হান, অলিউল্লাহ্ অলি, টিকটক হৃদয়, রাব্বি আকন, মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, রাকিবুল হাসান রিফাত হাওলাদার, রাকিবুল হাসান নিয়ামত, তানভীর, নাজমুল হাসানকে নিয়ে ২৫ জুন বিকেল সাড়ে পাঁচচার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজের শহীদ মিনারে মিটিং করে রিফাত শরীফকে হ'ত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ছক করে এবং হ'ত্যাকা'ণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য ২৬ জুন সকাল নয়টায় বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দেয়। তারই ধারাবাহিকতায় ২৬ জুন সকালে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হ'ত্যা করা হয়।