রফিকুল ইসলাম, বরগুনা থেকে ফিরে : পায়রা তীরের লবন প্রবণ এলাকা বরগুনা। জেলা শহর থেকে পিচ ঢালাই পথে সাগরতীরের পাথরঘাটা। সদর উপজেলা শহর থেকে কিছু দূর পিচ ঢালাই সড়ক পেরিয়ে মেঠো পথ মাড়িয়ে কড়ইতলা গ্রাম। গ্রামে প্রবেশ করলে চোখ আটকাবে গাছে থোকায় থোকায় ঝুলতে থাকা ফলের দিকে। ফলটি ছোট আকারের লম্বাটে, ডিম্বাকার বেগুনি কিংবা কালো রঙের। পূবলী বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফলের থোকাগুলি ঝুলছে গাছে গাছে।
এটি জাম, মৌসুমি ফল। দেখতে যেমন সুন্দর, খেতেও তেমন রসালো ও সুস্বাদু। নুনের গ্রামের এই জাম খেতে হালকা টক আর মিষ্টি স্বাদের। এই জাম ফলিয়েছেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত কড়ইতলার কৃষক আহসান হাবিব। একটি দুটি নয়, তার ৪৩টি গাছে ধরেছে থোকায় থোকায় জাম। জাম বিক্রি করেই তার প্রতিদিন আয় ৫০ হাজার টাকা। একমাসে জাম বিক্রি করে আয় হবে তার ১৫ লাখ টাকা।
নুনের গ্রামে কীভাবে জামের রাজ্য গড়ে উঠেছে তা জানতেই এ প্রতিবেদক ১৩ জুন গিয়েছিলেন কড়ইতলা। বরগুনা থেকে পাথরঘাটা যেতে পিচ ঢালাই পথ। মাত্র পাঁচ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েই বরগুনা সদর উপজেলার কড়ইতলা গ্রাম। মোঠে পথ ধরে কিছু দূর গেলেই আহসান হাবিবের খামার বাড়ি।
আশির দশকেই পরিচিত ওই গ্রামটি। তাও কৃষির জন্য। তখনকার কৃষিমন্ত্রী নিজেই এসেছিলেন হাবিবের খামার বাড়িতে। কৃষিতে ভরা খামারটি দেখে রীতিমতো চমকে গিয়েছিলেন কৃষিমন্ত্রী। পরবর্তিতে তরমুজ আর সবজি ফলিয়ে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার লুফে নিয়েছিলেন আহসান হাবিব।
তবে পুরস্কারের আগেই তিনি পাড়ি জমান বিদেশে। সেখানে গিয়েও কৃষি পেশা হিসেবে বেছে নেন। সিডরের পর দেশে ফিরেন। তখন কৃষিতে দুর্দিন চলছিল। কিন্তু কৃষির নেশা থেকে হাবিকে আলাদা করা যায়নি। তিনি এসেই নেমে পড়েন কৃষিতে।
আগেই গড়ে তোলা বাগানে ৫০টি জামের চারা রোপন করেন। বছর দুয়ের আগে গাছে ফুল ধরলেও জামের দেখা মিলছিল না। তাতে একটুও হতাশ হননি। উল্টো জাম গাছের পরিচর্যায় বেশি বেশি করে সময় দিত থাকেন। এবার তিনি সফল হলেন। মে মাসের শুরুতে গাছ কানায় কানায় জামে পরিপূর্ন হয়ে যায়। বলতে গেলে জামে পুরো গাছ ঢেকে যায়। মে মাসে প্রতিদিন গড়ে ৮ মন করে বাগান থেকে জাম সংগ্রহ করতেন। শুরুর দিকে প্রতিমন জাম আট হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। আস্তে আস্তে জামের উৎপাদন বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে জামের দর মন প্রতি চার হাজার টাকায় নেমে আসে। বৃষ্টি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন কমে আসতে শুরু করে। পাশাপাশি জামের দর এখন দুই হাজার টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। সব মিলিয়ে এই মৌসুমে তিনি প্রায় ১৫ লাখ টাকার জাম বিক্রির শেষ পর্যায়ে পৌছেছেন। এর বিপরীতে তার ব্যায় নেই বললেই চলে।
আহসান হাবিবের মেয়ে হুমায়রা আক্তার। বাবার কাজে তিনি সহযোগিতা করেন। তবে সেটা ডিজিটাল পদ্ধতিতে। সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রথম জাম নিয়ে পোস্ট দেন। মুহূর্তের মধ্যেই সেই পোস্ট ভাইরাল হয়। প্রতিবেশিরাও সেই পোস্ট দেখে বিশ্বাস করতে পারছিল না, ৪৩টি গাছে এত জাম! হুমায়রা আক্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফলেই জামের বিষয়টি সবার নজরে আসে। এমনকি ক্রেতাদের ৯৫ ভাগ অনলাইনে কিনছেন। কেউ কেউ অনলাইন ঘেটে জাম বাগান দেখতে আসনে।'
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের ডিন অধ্যাপক আকম মোস্তফা জামান বলেন, জ্যৈষ্ঠের শেষ থেকে আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহ মিলে প্রায় ২০ দিন খাওয়ার উপযুক্ত জাম পাওয়া যায়। ব্যবসায়িক উদ্যোগে উন্নত জাতের জাম বা হাইব্রিড জামের চাষ এই অঞ্চলে হয় না। তাই বাজারে পাওয়া জামের সবটাই দেশি জাতের। কিন্তু বরগুনায় যেটা হয়েছে এটি ব্যাতিক্রম। এছাড়া কোথাও কোথাও কিছু থাই (থাইল্যান্ড) জামও দেখা যায়।
তিনি আরও বলেন, পাবনা, নাটোর, কুষ্টিয়া, যশোর, রাজশাহী এবং গাজীপুরে জামের ফলন সবচেয়ে বেশি। এছাড়া প্রায় সব অঞ্চলেই কমবেশি জাম হয়। পুষ্টি ও ঔষধিগুণ সমৃদ্ধ জাম সুস্বাদু খাবার। এখন সখ করে অনেকেই ছাদ বাগানে আমের পাশাপাশি জামও চাষ করেন। কিন্তু সেটা চার দেয়ালে বন্দি। বরগুনার চাষি আহসান হাবিবের সাফল্য দেখে আগামীতে অনেকেই হয়তো জাম চাষে এগিয়ে আসবেন।-কালের কণ্ঠ