শুক্রবার, ১২ আগস্ট, ২০১৬, ০৬:৪১:৪৬

বগুড়ার ক্রিকেট পাগল মেয়েরা

বগুড়ার ক্রিকেট পাগল মেয়েরা

আনোয়ার পারভেজ, বগুড়া থেকে : বগুড়ার অজপাড়াগাঁর মেয়ে রিতুমনি আর শারমিন সুলতানা জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়। বগুড়া শহরের মেয়ে খাদিজাতুল কুবরাও খেলছেন জাতীয় দলে। একই জেলার এই তিন নারী দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক মাঠে রেখেছেন উজ্জ্বল প্রতিভার স্বাক্ষর। কী করে ঘটল তাদের এই বিস্ময়কর রূপান্তর?

এর পেছনে আছে একটি মাঠ আর আছেন একজন নিরলস প্রশিক্ষক। বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের মাঠে গেলে দেখা মিলবে ব্যাট-বল হাতে একঝাঁক তরুণীর ক্রিকেট প্রশিক্ষণের দৃশ্য। কেউ স্পিন বল করার চেষ্টা করছে, কেউ ফাস্ট বল। কেউ স্কয়ার-কাট করার চেষ্টা করছে, কেউ রপ্ত করার চেষ্টা করছে পুল বা হুক করার কায়দা-কানুন। আর মেয়েদের হাতে ধরে ক্রিকেটের কলাকৌশল শেখাচ্ছেন কোচ মোসলেম উদ্দিন। সাত বছর ধরে বিনা পারিশ্রমিকে এই কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। তার হাতেই গড়ে উঠেছে একের পর এক প্রতিভাধর খেলোয়াড়।

চান্দু স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয় না বছর সাতেক ধরে। এটির সুসজ্জিত মাঠে মেয়েদের ক্রিকেট শেখানোর অনুমতি স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছেন মোসলেম উদ্দিন।

২০-২২ জন কিশোরী নিয়মিত প্রশিক্ষণে আসে এই সবুজ ঘাসের ময়দানে। রিতুমনি, খাদিজাতুল কুবরা কিংবা শারমিন সুলতানা জায়গা করে নিয়েছেন জাতীয় প্রমিলা ক্রিকেট দলে। দেশে তো বটেই, বিদেশের মাটিতেও অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন তারা। ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত জায়গা করে নিয়েছেন এই দলের আরও ছয় খেলোয়াড়।

এ বছর থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলে খেলেছেন দুজন। ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে রাজশাহী বিভাগে টানা তিন বছর সেরা হয়েছে বগুড়া জেলা দল। চান্দু স্টেডিয়ামের এই অনুশীলনকারী মেয়েদের কারণেই বগুড়া ক্রিকেট দলের এই দাপট।

মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘ইচ্ছা আছে বগুড়া থেকেই একটা শক্তিশালী জাতীয় দল গড়ার। বগুড়ার মেয়েরা বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে যেদিন ক্রিকেট বিশ্বে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট নিয়ে আসবে, সেদিন নিজের পরিশ্রম সফল হয়েছে মনে করব।’

গাবতলী উপজেলার সোন্দাবাড়ি গ্রামের শারমিন সুলতানা প্রতিদিন স্কুটি চালিয়ে অনুশীলনে আসেন। এখন আবাহনী লিমিটেডের হয়ে খেলছেন। তিনি বলেন, ‘স্যার আমাকে মাঠে আসতে বললেন। সালোয়ার-কামিজ পরে ভয়ে ভয়ে মাঠে আসি। প্রথম দিন ব্যাট ধরা আর বল করা শিখিয়ে দিতেই ভয় কেটে যায়। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।’

সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনাপারের প্রত্যন্ত গ্রাম বাড়ইপাড়ায় রিতুমনিদের বাড়িতে এখনো বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। এখন পুরো গ্রামে আলো ছড়াচ্ছে রিতুর ক্রিকেট প্রতিভা। সারিয়াকান্দি ডিগ্রি কলেজপড়ুয়া মেয়েটি জাতীয় দলের খেলোয়াড়।

রিতুমনি বলেন, ‘সারিয়াকান্দি গার্লস স্কুলে পড়ার সময় ভালো অ্যাথলেট ছিলাম। ২০০৯ সালে বগুড়ায় আন্তস্কুল অ্যাথলেটিকসে খেলতে গিয়ে মোসলেম ভাইয়ের চোখে পড়ি। তিনি ক্রিকেট খেলার প্রস্তাব দিলেন। বললেন, অন্য খেলা ছাড়তে হবে। রাজি হয়ে যাই।’

সারিয়াকান্দি থেকে বগুড়া শহর দীর্ঘ পথ। যোগাযোগব্যবস্থাও খারাপ। সপ্তাহে দুই দিন অটোরিকশায় চেপে, ভ্যানে-টেম্পোতে ভেঙে ভেঙে অনুশীলন মাঠে আসা। এভাবে ২০১০ সালে ১৫ দিনের ক্যাম্পে অংশ নেওয়া। সেবার জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে রাজশাহী বিভাগের দলে জায়গা হয়ে যায় তার। নৈপুণ্যের কারণে ওই বছরই জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পেয়ে যান। দুই বছরের মধ্যে যমুনাপারের মেয়ে রিতুমনি আয়ারল্যান্ড সফরে।

বগুড়া শহরের কলোনিতে বেড়ে ওঠা খাদিজাতুল কুবরা ২০০৯ সালে পত্রিকায় ক্রিকেট ক্যাম্পের খবর পড়ে নিজে এসে অনুশীলনে যোগ দেন। ভিক্টোরিয়া ক্লাবের হয়ে খেলেছেন। খেলেছেন আবাহনী লিমিটেড ও মোহামেডানের হয়ে। থাইল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ৫ উইকেট সংগ্রহ করেছেন তিনি। কুবরা বলেন, ‘বিশ্বসেরা ক্রিকেটারের তালিকায় নিজের নাম লেখানোর স্বপ্ন এখন আমার।’

কুবরার বাবা জামিল আখতার বলেন, ‘ওর ভেতরে ক্রিকেটার হওয়ার মেধা ও প্রতিভা ছিল। তবে মোসলেম স্যারের সঙ্গে পরিচয় না হলে এত দিন অজানাই থেকে যেত।’

যিনি মেয়েকে এত স্বপ্ন দেখিয়ে যাচ্ছেন, তার নিজের স্বপ্ন কিন্তু অপূর্ণ থেকে গেছে। মোসলেম উদ্দিন ক্রিকেট খেলেছেন বগুড়ার জেসিসি, সোনালী ক্লাব ও ঢাকা সিটি ক্লাবে। জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন ছিল প্রবল। সেটা পূরণ হয়নি। সেই স্বপ্নের বীজ তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন বগুড়ার ছেলেমেয়েদের মধ্যে।

প্রথমে ছেলেদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন বিনা পারিশ্রমিকে। ২০০১ সালে বিকেএসপি থেকে নিজেও প্রশিক্ষণ নেন। ২০০৭ সালে বগুড়ায় একটি প্রমিলা ক্রিকেট দল গঠন করা হয়। ওই বছরের শেষ দিকে দলটির প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেন মোসলেম উদ্দিন।

কিন্তু খেলোয়াড় পাবেন কোথায়? খেলোয়াড় সংগ্রহ করতে আক্ষরিক অর্থেই বাড়ি বাড়ি গেছেন মোসলেম উদ্দিন। শহরের পাড়া-মহল্লায় গেছেন, গেছেন উপজেলা পেরিয়ে গ্রামে গ্রামে। যেখানেই খেলাধুলায় প্রতিশ্রুতিশীল কিশোরীর খবর পেয়েছেন, ছুটে গেছেন। অভিভাবকদের বুঝিয়েছেন। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে একটি ক্রিকেট দল।

মোসলেম উদ্দিন বলেন, শুরুতে কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। মেয়েদের ক্রিকেট খেলাটা অনেকেই ভালোভাবে দেখেনি। অভিভাবকদের রাজি করাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। তবে মেয়েরা নৈপুণ্য দেখিয়ে সাফল্য আনতে শুরু করায় শুরুর বাধাটা আর থাকেনি।

রিতুমনির বড় ভাই জুয়েল মিয়া বলেন, ‘রিতু যখন গ্রাম থেকে প্রতিদিন অটোরিকশা-টেম্পোতে অনুশীলনের জন্য যেত, তখন পাড়া-প্রতিবেশীরা নানা কথা বলত। এখন রিতু তারকা ক্রিকেটার হওয়ায় এলাকার সবাই আমাদের সম্মান করে, খাতির-যত্ন করে।’

মোসলেম উদ্দিন বলেন, মেয়েদের বিনা পয়সায় প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে প্রতি মাসে যে ব্যয়, তা জোগাতে ‘ইয়ং টাইগার্স ক্রিকেট একাডেমি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়েছেন তিনি। এখানে পৌনে দুই শ শিশু-কিশোরকে বয়সভিত্তিক ক্রিকেট প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। প্রতিদিন সকালে মেয়েদের প্রশিক্ষণ শেষে বিকেলে একাডেমিতে প্রশিক্ষণ দেন। একাডেমির শিশু-কিশোরেরা প্রত্যেকেই দু-এক শ টাকা দেয়। সেই টাকায় মেয়েদের প্রশিক্ষণের খরচ চলে। তবে গত নভেম্বর থেকে বিসিবির সহকারী কোচ হিসেবে কাজ শুরু করেছেন। ওই পদের দায়িত্ব হিসেবে কিশোর ও তরুণদের প্রশিক্ষণ দেন। পাশাপাশি মেয়েদের প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছেন নিজস্ব উদ্যোগে।

বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের ভেন্যু ব্যবস্থাপক জামিলুর রহমান বলেন, ‘মোসলেমকে বাদ দিয়ে বগুড়ার ক্রিকেট কল্পনা করা যায় না। প্রায় ২০ বছর ধরে দেখছি তাকে। ১০ বছর ধরে বগুড়া জেলা দলের চৌকস ক্রিকেটার ছিলেন তিনি। এখন নারী ক্রিকেটার তৈরির কাজ করছেন। তার কারণেই বগুড়ার মেয়েরা ঘরের বাইরে পা রেখে এখন ব্যাট-বল হাতে তুলে নিয়েছে।’

বগুড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান বলেন, নানা বাধা পেরিয়ে মাত্র কয়েক বছরে বগুড়ার মেয়েরা ক্রিকেটে দুর্দান্ত সাফল্য অর্জন করেছে। এই অনুশীলন তাদের অনেক দূর নিয়ে যাবে। একদিন এই মেয়েরাই জাতীয় ক্রিকেটে গৌরব বয়ে আনবে।
রিতু-কুবরারা এখন দৃষ্টান্ত হয়ে গেছেন। জনা বিশেক স্কুলপড়ুয়া কিশোরী প্রতিদিন ভোরবেলা বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসছে বগুড়ার মাঠে। দূরত্ব তাদের কাছে কোনো বাধা নয়। সামাজিক কটাক্ষও উপেক্ষা করতে শিখে গেছে তারা। তাদের সামনে এখন সাফল্যের হাতছানি। - প্রথম আলো

১২ আগস্ট ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস‌‌‌‌

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে